শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এদিন নেত্রকোনা দাউদকান্দি ও ত্রিশাল শত্রুমুক্ত

যাযাদি রিপোর্ট
  ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানি সেনাপতিরা ব্যঙ্গ করে বলেছিল, ‘আমরা স্কাউটদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি!’ কিন্তু মাত্র ৯ মাসেই মুক্তিপাগল বাঙালির কাছে এভাবে পরাস্ত হতে হবে, মাথা নিচু করে দুই হাত তুলে প্রাণটা বাঁচাতে আত্মসমর্পণ করতে হবে এটা হয়তো পাকিস্তানি সেনাদের কল্পনাতেও ছিল না। ডিসেম্বরের শুরুতে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের পতন স্পষ্ট আর বাঙালির বিজয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। তখন একে একে মুক্ত হতে থাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পিছু হটার মধ্যদিয়ে প্রতিদিনই তখন দেশের একাধিক এলাকা শত্রুমুক্ত হয়।

একাত্তর সালের ওই সময়ে দ্রুত পাল্টে যাওয়া দৃশ্যপট এটাই স্পষ্ট করে দেয় যে, খুব শিগগিরই অবসান হতে যাচ্ছে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের। এর ধারাবাহিকতায় ৯ ডিসেম্বর হায়েনা মুক্ত হয় নেত্রকোনা, কুমিল্লার দাউদকান্দি, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এবং ময়মনসিংহের ত্রিশাল। এছাড়া খুলনার ঐতিহ্যবাহী কপিলমুনি, কুষ্টিয়ার কুমারখালী এবং গাজীপুরের শ্রীপুর ও পূর্বধলাসহ বিভিন্ন এলাকা এদিনে মুক্ত হয়। তবে অকুতোভয় বাংলার দামাল ছেলেদের মনোবল ভেঙে দিতে তখনো ষড়যন্ত্র করছিল পাকিস্তান

আর দেশটির সহযোগী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন স্বাধীনতাযুদ্ধের শেষ সময়ে এসে পাকিস্তানকে সহযোগিতার পদক্ষেপ নেন। একাত্তরের ৯ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহরকে তিনি বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি ভেবেছিলেন এর মাধ্যমে অন্তত বাঙালির মনোবল ভেঙে দেয়া যাবে। কিন্তু সে ধারণা সঠিক হয়নি। রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা পলিমাটির সন্তানদের দৃঢ় মনোবল তো আর এত সহজে ভেঙে দেওয়া যায় না!

নেত্রকোনা : ৯ ডিসেম্বর ভোরে নেত্রকোনা শহরের দক্ষিণাংশে থানার পেছনে মিত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন চৌহান এবং প্লাটুন কমান্ডার আশরাফ আলী খান খসরু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মহেন্দ্রপুরে অবস্থান নেন। অন্যদিকে টাইগার কোম্পানির কমান্ডার আবু সিদ্দিকের নেতৃত্বে ৪২ জন মুক্তিসেনা শহরের উত্তরাংশের কৃষি ফার্মে অবস্থান নেন। তাদের কভারিংয়ের জন্য ইন্ডিপেনডেন্ট কমান্ডার আনোয়ারুল হক খানের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিসেনা আটপাড়া-কেন্দুয়া রাস্তার বালি নামক স্থানে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। তাদের সম্মিলিত আক্রমণে পাকসেনা ও তাদের দোসররা পিছু হটে। মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে উড়ান বিজয়ের রক্তস্নাত পতাকা।

দাউদকান্দি : একাত্তর সালের এদিনে মুক্ত হয় দাউদকান্দি। ৮ ডিসেম্বর সারারাত এবং ৯ ডিসেম্বর বেলা ১১টা পর্যন্ত যুদ্ধের পর পাকসেনারা দাউদকান্দিতে তাদের শেষ আশ্রয়স্থল সড়ক ও জনপথের ডাকবাংলোতে ওঠে এবং সেখান থেকে লঞ্চে মেঘনা নদী দিয়ে গজারিয়া হয়ে ঢাকায় পালিয়ে যায়। ফলে দাউদকান্দির পথে পথে সেদিন নামে বিজয়ের মিছিল।

আড়াইহাজার : একাত্তর সালের ৬, ৭, ৮ এবং ৯ ডিসেম্বর অপারেশন পাঁচরুখী, অপারেশন ডহরগাঁও, অপারেশন কালীবাড়ি, অপারেশন বিশনন্দী এবং অপারেশন বগাদীর যুদ্ধে পাকসেনাদের হটিয়ে ৯ ডিসেম্বর বিকালে আড়াইহাজার ডাকবাংলো ও থানা কার্যালয়ের হানাদারদের ক্যাম্প দুটি দখল করে নেন মুক্তিযোদ্ধারা। ফলে পাকবাহিনী মুক্ত হয় আড়াইহাজার। ঐতিহাসিক এ দিনটি ছিল আজ থেকে ৪৮ বছর আগের, একাত্তর সালের ৯ ডিসেম্বর।

ত্রিশাল: এদিনে ত্রিশালও শত্রুমুক্ত হয়। ৮ ডিসেম্বর রাতে ১১ নম্বর সেক্টরের সাবসেক্টর এফ জে সেক্টরের মেজর আফসার বাহিনীর অন্যতম মুক্তিবাহিনী কমান্ডার শাহ আনছার উদ্দিনের নির্দেশে কমান্ডার আবদুল বারী মাস্টার, কমান্ডার নাজিমউদ্দিন, কমান্ডার আইউব আলী এবং হাফিজ উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি কোম্পানির প্রায় ২০০ সদস্য ত্রিশালে ঘাঁটি গেড়ে থাকা পাকবাহিনী ও রাজাকারদের ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধারা রাত ১২টার দিকে সুতিয়া নদীর দক্ষিণ থেকে ও ত্রিশাল বাজারের পশ্চিম দিক থেকে অতর্কিতে হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করলে হানাদার ও রাজাকাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

এছাড়া একাত্তর সালের ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনির মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আনন্দের দিন ছিল। এদিনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় সুনিশ্চিত হতে থাকলে পাকিস্তানি সৈন্যরা বিভিন্ন স্থান থেকে পিছু হটে। কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে এদিন বীর মুক্তিযোদ্ধারা বেলা ১১টায় শহরের চারদিক ঘিরে ফেলে। একাত্তর সালের ৪ থেকে ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্ত হয় গাইবান্ধার সব থানা।

৯ ডিসেম্বর ১১ নম্বর সাব সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার আবদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে টু আইসি আবদুর রশীদ ও সিকিউরিটি অফিসার একলিম শাহসহ ১৫০ বীর মুক্তিযোদ্ধা নকলাকেও ৯ ডিসেম্বর মুক্ত করেন। এরপর তারা স্থানীয় নকলা পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে