শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধবিরতি মানতে কিসিঞ্জারের হুমকি

নতুনধারা
  ১১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট

১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার মেঘাচ্ছন্ন আকাশে ধীরে ধীরে উঁকি দিচ্ছিল স্বাধীনতার সূর্য। এ দিন ঢাকায় সকাল থেকে প্রচন্ড লড়াই চলে। ঢাকা বিজয়ের লক্ষ্য নিয়ে চারদিক থেকে ট্যাংকসহ আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে বাংলার বীর মুক্তিসেনারা এগিয়ে আসছিল। পথে পথে যেসব জনপদ, গ্রাম, শহর-বন্দর পড়ছিল সর্বত্রই মুক্তিসেনারা নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতে ওড়াতে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এদিন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রতিনিধি ভোরেন্ডসভকে হুশিয়ার করে বলেন, পরদিন (১২ ডিসেম্বর) মধ্যাহ্নের আগে ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে।

অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের এমন হুশিয়ারি সামান্যতম মনোবল ভাঙতে পারেনি মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর অকুতোভয় বীর সেনানিদের।

এদিন মুক্তিবাহিনী সকাল ১০টায় তোপখানা রোডের মার্কিন তথ্যকেন্দ্র অভ্যন্তরে প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটায়। গেরিলারা সারা ঢাকার প্রত্যেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টারে করে কমান্ডো নামানোর চেষ্টা করেও সফল হয়নি। ঢাকার চারপাশে মিত্রবাহিনী নির্দিষ্ট এলাকায় রাতে ছাত্রীসেনা অবতরণ করায়।

অন্যদিকে ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজির কাছে এক বার্তায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান

জানান, মার্কিন সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। চীনও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এদিকে পূর্ব পাকিস্তান গভর্নর ড. মালেকের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ১৯৭১ সালের আজকের দিনে জাতিসংঘের কাছে এক বার্তা পাঠান। পূর্ব পাকিস্তান থেকে সামরিক ও বেসামরিক পাকিস্তানিদের পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নেয়ার জন্য জাতিসংঘের সাহায্য চান তিনি। কিন্তু জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী দূত আগাশাহী সে বার্তা প্রত্যাখ্যান করার অনুরোধ জানান জাতিসংঘ বরাবর।

এভাবে পূর্ব পাকিস্তানে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন পরাজয় মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার তখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছিল।

ঢাকায় বেলা ৩টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর সহায়তায় ঢাকা থেকে ব্রিটিশ ও অন্য বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকায় বিদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সরিয়ে নেয়ার জন্য ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়ে মেরামত ও আন্তর্জাতিক বিমান অবতরণের সুযোগ দেয়া হয়। এজন্য বিমানবন্দরে বিমান হামলা বন্ধ রাখে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ও মিত্রবাহিনী।

১১ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত যশোরের টাউন হল ময়দানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বৈঠক করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন।

এ ঘোষণার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলোথ বাংলাদেশ সরকার ওয়ার ট্রাইবু্যনাল গঠন করেছে। এ ট্রাইবু্যনাল নরহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে যুদ্ধবন্দিদের বিচার করবে। ২৫ মার্চের আগে যিনি জমি, দোকানের মালিক ছিলেন তাদের সব ফিরিয়ে দেয়া হবে। সব নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামী ইসলামী নিষিদ্ধ করা হবে।

গুরুত্বপূর্ণ এসব সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ইয়াহিয়া খান বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা তা পারল না। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, এ শিশু রাষ্ট্রকে গড়ে তোলার দায়িত্ব এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের।

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রয়েছে পরস্পরের সার্বভৌম ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রেখে।

এই দিনে পাকিস্তানের আরেক শক্ত ঘাঁটি চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও উপকূলীয় অবকাঠামো, জাহাজ, নৌযান ইত্যাদি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করার জন্য ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমান ও যুদ্ধ জাহাজ ব্যাপক তৎপরতা চালায়। একের পর এক বোমা ও রকেট হামলা চালিয়ে বিধ্বস্ত করে দেয় পাক হানাদারদের সবকিছু।

আকাশ ও স্থলে আক্রমণে দিশেহারা পাকসৈন্যরা নদীপথে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সর্বত্র সতর্ক প্রহরা যে আগেই বসানো হয়েছিল, তা জানা ছিল না হানাদারদের। তাই পাক সামরিক পোশাক ছেড়ে সাধারণ বেশে নদীপথে অনেক পাক সৈন্য পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।

এদিন হিলি সীমান্তে মিত্রবাহিনী প্রচন্ড প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তুমুল লড়াই অব্যাহত থাকে। সন্ধ্যায় সম্মিলিত বাহিনী বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মধ্যবর্তী গোবিন্দগঞ্জে শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটির ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। সারারাত যুদ্ধের পর হানাদাররা ভোরের দিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

জামালপুর গ্যারিসন সম্মিলিত বাহিনীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে। জামালপুরের পূর্বে হালুয়াঘাট এলাকায় প্রচন্ড সংঘর্ষের পর পাকিস্তানি বাহিনীর আর একটি ব্রিগেড অস্ত্র গোলাবারুদ ফেলে টাঙ্গাইলের দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। পলায়নের সময় শত্রম্নবাহিনী রাস্তার সমস্ত বড় বড় সেতু ধ্বংস করে দিয়ে যায়।

অপরদিকে ময়মনসিংহে অবস্থানরত শত্রম্নবাহিনীর আর একটি ব্রিগেড শহর ত্যাগ করে টাঙ্গাইলে তাদের প্রতিরক্ষামূলক ঘাঁটিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সম্মিলিত বাহিনী রাতে বিনাপ্রতিরোধে জামালপুর দখল করে নেয়। একাত্তর সালের এ দিন, গাইবান্ধা, চন্ডীপুর, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, ফুলছড়িহাট, বাহাদুরাবাদ ঘাট, পিসপাড়া, দুর্গাদীঘি, বিলগ্রাম, মুন্সীগঞ্জ, আশুগঞ্জ, দিনাজপুরের হিলিসহ বিভিন্ন এলাকা শত্রম্নমুক্ত হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<79403 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1