শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দশ বছরে বদলেছে জঙ্গিবাদের ধরন

ঢাবি-সিটিটিসির প্রতিবেদন
যাযাদি রিপোর্ট
  ১৯ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

জঙ্গিবাদের যে অভিশাপ দেশ বয়ে বেড়াচ্ছে, তার ধরনে পরিবর্তন এসেছে গত ১০ বছরে। জঙ্গিবাদে জড়ানোর কারণও পরিবর্তিত হয়েছে অনেকাংশে। ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত জঙ্গিরা নিম্নবিত্ত, দরিদ্র, অশিক্ষিত ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের তাদের দলে ভিড়িয়ে ব্যবহার করত। বর্তমানে শিক্ষিত ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণ-তরুণীদের উগ্রবাদে ভেড়াচ্ছে তারা। আগে সংঘবদ্ধ হয়ে টার্গেট করে আক্রমণ চালালেও তারা এখন এককভাবে বা সর্বোচ্চ দু'জন মিলে আক্রমণে যাচ্ছে।

সম্প্রতি জঙ্গিবাদ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ক্রিমিনোলজি বিভাগ ও পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) চালানো এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

ওই গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, আগে চলিস্নশোর্ধ্বরা জঙ্গিবাদের পথে পা বাড়ালেও বর্তমানে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সিরা উগ্রবাদে লিপ্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ৫১ জন (বয়স ১৬-৩২) জঙ্গির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের ৪৭ শতাংশই বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট। ১২ শতাংশ মাদ্রাসাছাত্র, ৩ শতাংশ অশিক্ষিত।

১৪ জঙ্গির পরিবার, ১০ পুলিশ অফিসার ও ১৫ বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশে জঙ্গিবাদের গোড়াপত্তনের দিকে ধর্মীয় উগ্রপন্থি নেতাদের বই পড়ে যুবক

\হও বয়স্ক পুরুষরা এ পথে পা বাড়াত। তবে বর্তমানে জঙ্গিদের গডফাদাররা উগ্রবাদ ছড়ানোর জন্য ইন্টারনেটকে মূল হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। স্পর্শকাতর ভিডিও দেখিয়ে তারা মগজ ধোলাই করছে তরুণ-তরুণীদের। যোগাযোগের জন্য হোয়্যাটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রামের মতো এনক্রিপটেড অ্যাপ ব্যবহার করছে তারা। যে জঙ্গিদের ওপর গবেষণা চালানো হয়েছে তারা বলছে, তাদের বড় একটি অংশ ইন্টারনেটে প্রোপাগান্ডামূলক পোস্ট দেখে এ পথে উদ্বুদ্ধ হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, জঙ্গিদের যখন ট্রেনিং দেয়া হয় তখন তাদের টার্গেট ঠিক করে দেয়া হয় যে, কাকে হত্যা করতে হবে। ট্রেনিংয়ের সময় টার্গেটের ছবি দেখিয়ে তার 'কৃতকর্মের' বিষয়ে ব্রিফ করা হয়। ব্রিফের সময় তাদের কোরআন-হাদিসের কিছু আয়াতের অপব্যাখ্যা ও কু-যুক্তি দিয়ে বোঝানো হয় যে, 'এসব ব্যক্তির পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।' এরপর ট্রেনিং শেষেই তারা টার্গেটকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু করে। এ ছাড়া নব্য জেএমবির সদস্যদের টেলিগ্রামের মাধ্যমে বোমা তৈরি এবং তা শক্তিশালী করার গাইডলাইন দেয়া হয়।

গবেষণায় জানা গেছে, সাম্প্রতিককালে জঙ্গিবাদে জড়ানোর কারণ হিসেবে জঙ্গিরা দাবি করেছে, 'ইরাক ও সিরিয়ায় মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের রাগ ও ক্ষোভ' থেকে তারা এ পথে পা বাড়িয়েছে।

জঙ্গিবাদের পথে আগতদের পারিবারিক বিষয়ে গবেষণা বলছে, এ পথে আসা অধিকাংশই (তরুণ) তাদের ছোটকাল থেকে পরিবারে ঝগড়াঝাটি বা নানা ধরনের কলহ দেখে আসছিল। ছোটবেলা থেকে তাদের চলাফেরায়ও অনেক বাধা-বিঘ্ন ছিল। মেয়ে ও ভিন্নধর্মী কারও সাথে কথা বলতে দেয়া হতো না অধিকাংশকে।

দেশে জঙ্গিবাদের আত্মপ্রকাশের প্রথম দিকে কেবল পুরুষরা জড়িত হলেও বর্তমানে নারীরাও এ পথে পা বাড়াচ্ছে। গবেষণায় এর কারণ জানতে চাইলে তারা (তরুণীরা) জানায়, তাদের অধিকাংশই পরিবারে নিগৃহীত ছিল। কেউ তাদের পাত্তা দিত না, তাদের কথার কোনো দাম ছিল না পরিবারে। অভাব-অনটনে, নানা নির্যাতন সহ্য করে বড় হয়ে শেষে মগজ ধোলাইয়ের কবলে পড়ে এ পথ বেছে নিয়েছে তারা।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েক বছরে জঙ্গিদের হামলার ধরনও বদলেছে। আগে তারা একটি গ্রম্নপ হয়ে কয়েকজন মিলে বিদেশি, বস্নগার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করত এবং অপারেশন বাস্তবায়ন করত। এখন এককভাবেই সব পরিকল্পনা ও হামলা চালায় জঙ্গিরা। যেকোনো অপারেশন বাস্তবায়নের জন্য এখন তারা একজন বা সর্বোচ্চ দু'জন কাজ করে।

এ বিষয়ে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, 'বর্তমানে যুবকদের টার্গেট করের্ যাডিকালাইজড (উগ্রবাদী মগজ ধোলাই) করছে জঙ্গিরা। আমরা জঙ্গিদের মোকাবিলার পাশাপাশি যুব সমাজকে তারা যেন নতুন করের্ যাডিকালাইজড না করতে পারে সে বিষয়েও কাজ করছি।'

সিটিটিসি ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, জঙ্গিদের আক্রমণের ধরন ও আচরণ সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে। আগে নব্য জেএমবির সদস্যদের টার্গেট ছিল বিদেশিরা। তবে বর্তমানে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে টার্গেট করছে। এছাড়া তারা নিজেরাই নিজেদের জন্য শক্তিশালী এক্সপেস্নাসিভ (বোমা) তৈরি করছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (এডিসি) রহমতুলস্নাহ চৌধুরী বলেন, জঙ্গিরা আগের চেয়ে অনেক উন্নত ও অত্যাধুনিক বিস্ফোরক ও অস্ত্র ব্যবহার করছে। আমরা গত বছর এক অভিযানে জঙ্গিদের কাছ থেকে শক্তিশালী বিস্ফোরক-আইইডি (ইমপ্রোভাইজড এক্সপেস্নাসিভ ডিভাইস) জব্দ করেছি। তারা অত্যাধুনিক রিমোট কন্ট্রোল সার্কিট ও মোশন সেন্সরও ব্যবহার করছে।

এদিকে গবেষণার পাশাপাশি গোয়েন্দা তথ্যেও উঠে এসেছে জঙ্গিবাদের ধরন বদলের তথ্য। জঙ্গিবাদ দমনে কাজ করে এমন একটি ইউনিটের গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জঙ্গি সংগঠন জেএমবি ২০১২ সালে অনলাইনে কার্যক্রম শুরু করে। পরের বছরের মার্চে বস্নগার ও অ্যাক্টিভিস্ট রাজীব হায়দারকে হত্যার মাধ্যমে তারা লাইমলাইটে আসে। এ ঘটনায় জড়িত পাঁচ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা তাদের জবানবন্দিতে জেএমবিকে নতুনভাবে পুনর্গঠনের কথা স্বীকার করে এবং নিজেদের প্রধান হিসেবে জসীমউদ্দীন রাহমানির (বর্তমানে কারাগারে) নাম বলে। এ গ্রম্নপের সদস্যরা উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ছিল।

২০১৪ সালের পর জেএমবিতে আদর্শগত মতপার্থক্য দেখা দিলে সংগঠনটি দুই ভাগ হয়ে যায়। একটি গ্রম্নপ মতাদর্শ বদলে নব্য জেএমবি নামে আলাদা সংগঠন করে এবং বিদেশিদের টার্গেট করে হত্যার মিশনে নামে। এ দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ছিল তামিম চৌধুরী ও সারোয়ার জাহান মানিক (অভিযানে নিহত)। ২০১৫ সাল পর্যন্ত এ গ্রম্নপটি ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো কাজ করে ফান্ড তৈরি করে। সেই টাকা দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র, ছুরি ও বোমা কেনে তারা। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ঘটে বর্বরোচিত জঙ্গি হামলা। দুই পুলিশসহ ২২ জনকে হত্যা করে তারা। নিহতদের বেশিরভাগই ইতালি ও জাপানের নাগরিক।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলাকারীরা সবাই উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের। তারা ইংরেজিও জানত। এতে সুস্পষ্ট যে, জঙ্গিরা তাদের কর্মকান্ডের কৌশল ও ধরন বদলেছে।

এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা বলেন, ইন্টারনেটে মতাদর্শ-গুরুদের অনুসরণ এবং তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী চলার কারণে দেশের উগ্রবাদীরাও তাদের ধরন বদলেছে। তবে এটা ভালো যে, উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও জঙ্গি দমনে একটি বিশেষায়িত কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট রয়েছে। তারা খুব ভালোভাবে গোয়েন্দা তৎপরতা ও অভিযান চালাচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<85027 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1