শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন

ছয় কারণে বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ আ'লীগ

ফয়সাল খান
  ২১ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

মেয়র পদে বিজয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীরা। কেননা রাজধানীর মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকার ৭০টির বেশি ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি দলটি। এতে বিএনপি ও অন্যান্য দলের প্রার্থীরা সুবিধা পাচ্ছেন। ফলে অর্ধশতাধিক ওয়ার্ডে ক্ষমতাসীন দলের কাউন্সিলর পদ হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

আগের নির্বাচনগুলোতে বিদ্রোহী প্রার্থীদের ক্ষমা করে দেওয়া ও পুরস্কৃত করাসহ অন্তত ছয় কারণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে দলের দায়িত্বশীল নেতারা বলেন, এবার বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের মদদদাতাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের সবাইকে চিহ্নিত করে সাংগঠনিক শাস্তির মুখোমুখি করা হবে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সম্প্রতি দুই সিটি করপোরেশন এলাকার নেতাদের নিয়ে আলাদা বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। বৈঠক থেকে যেকোনো মূল্যে বিদ্রোহীদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে আনতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কোনো কিছুতেই তাদের বাগে আনতে না পারলে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে; কিন্তু এরপরও যার যার অবস্থানে অনড় বিদ্রোহী প্রার্থীরা।

আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে দলের জন্য কাজ করলেও মনোনয়ন পাননি অনেকেই। এ ক্ষোভ থেকে প্রার্থী হয়েছেন। তাদের দাবি, কেন্দ্রীয় নেতাদের ভুল বুঝিয়ে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর পেছনে স্বজনপ্রীতি, অবৈধ অর্থের লেনদেন ও নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ঘটনা রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পেছনে অতীতের উদাহরণই বেশি দায়ী। কেননা এর আগের নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী থাকলেও এ নির্বাচনে দলীয় সমর্থন পেয়েছে, এমন প্রার্থীর অভাব নেই। তাদের শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এতে নতুন করে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

বেশিরভাগ বিদ্রোহী প্রার্থীই দল ও দলের বাইরে প্রভাবশালী। অনেকেরই রয়েছে পেশিশক্তির জোর। তাদের ধারণা, মাঠে থেকে দলীয় প্রার্থীকে কোণঠাসা করে নিজেদের জয় নিশ্চিত করবেন। তাছাড়া ভুল প্রার্থী বাছাই, মাঠ পর্যায়ে এমপি, কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতা এবং মেয়রপ্রার্থীর নিজস্ব বলয়, এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের দাবি, ওয়ার্ডভিত্তিক কাউন্সিলর প্রার্থী বাছাইয়ে তৃণমূলের মতামত নেওয়া হয়নি। মহানগর নেতাদের দেওয়া তালিকা যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে ভুল প্রার্থী সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। পুরান ঢাকার একজন কাউন্সিলর প্রার্থী দলের জন্য তার অবদান তুলে ধরে যায়যায়দিনকে জানান, তৃণমূলের পূর্ণ সমর্থন নিয়েই প্রার্থী হয়েছেন। প্রত্যাহারের জন্য দল থেকে কেউ কিছুই বলেনি। বরং মাঠে থেকে জয় নিশ্চিত করতে উৎসাহ দিচ্ছেন বেশ কয়েকজন নেতা।

মিরপুর এলাকার একজন প্রার্থী জানান, মানুষ চাইছে, তাই নির্বাচন করছি। জিতে আসলে দল সবাইকে বরণ করে নেয়। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েও দল থেকে বহিষ্কার হবেন না বলে জানান তিনি।

ঢাকার একাধিক থানা ও ওয়ার্ডের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে আওয়ামী লীগের চেইন অব কমান্ড নেই। অনেক ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের সখ্য রয়েছে। এমন নেতারা থানা বা মহানগর নেতাদের কমান্ড মানেন না। তাছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য, মহানগর ও থানা পর্যায়ের নেতারা নিজস্ব বলয় ভারি করার জন্য প্রথমেই পছন্দের প্রার্থীকে দলের সমর্থন পাইয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন। যেখানে দলীয় সমর্থন পাননি, সেখানে নিজস্ব বলয়ে আলাদা প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন। এসব প্রার্থীকে মাঠে থাকতে ইন্ধনও জোগাচ্ছেন তারা।

আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, গত ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে আতিকুল ইসলাম ও শেখ ফজলে নূর তাপসের নাম চূড়ান্ত করা হয়। তাছাড়া ১২৯ জন সাধারণ কাউন্সিলর ও ৪৩ জন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরকে সমর্থন দেওয়া হয়। দল সমর্থিত প্রার্থীকে জয়ী করার নির্দেশনা ছাড়াও এর বাইরে কোনো নেতা যাতে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করেন, এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় সংগঠন। কিন্তু এরপরও আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের তিন শতাধিক নেতা মনোনয়নপত্র জমা দেন। কেন্দ্রের সব হুঁশিয়ারি উপক্ষো করে এখনো ঢাকার ১২৯ ওয়ার্ডের মধ্যে ৭৭টি ওয়ার্ডে দলের শতাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে এসব বিদ্রোহীর কারণে হাতছাড়া হতে পারে অর্ধশতাধিক কাউন্সিলর পদ।

এদিকে বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ন্ত্রণে সব চেষ্টা ব্যর্থ হলেও নানা ধরনের হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। তবে এতে বিচলিত নন বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীরা। দলীয় মেয়রপ্রার্থীর সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায়ও অংশ নিচ্ছেন কেউ কেউ। কাউন্সিলর পদে সরাসরি দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীক না থাকায় কেউ আবার নিজ ওয়ার্ডে দল থেকে কাউকে সমর্থন দেওয়া হয়নি বলেও গুজব ছড়াচ্ছেন। এতে বিভ্রান্ত হচ্ছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।

সূত্রমতে, বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রণে আওয়ামী লীগের নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনোটাই আলোর মুখ দেখেনি। গত ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব প্রার্থীকে গণভবনে ডেকে প্রত্যাহার ফরমে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। সেখানে অনেকেই কৌশলে প্রত্যাহার ফরম পূরণ করেননি। ফলে কাউন্সিলর পদে তিন শতাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী মনোনয়ন জমা দেন। এতে ক্ষুব্ধ হন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গত ৩ ও ৪ জানুয়ারি দলের নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ সভায় বিদ্রোহী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করাতে দুই সিটি নির্বাচন পরিচালনা সমন্বয় কমিটির নেতাদের নির্দেশ দেওয়া হয়। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের পৃথক বর্ধিত সভায় দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বিদ্রোহী মাঠ থেকে সরে দাঁড়াতে অনুরোধ করেন। তারা বলেন, মনোনয়নপত্র তুলে না নিলে দলীয় পদ-পদবি থেকে বহিষ্কার করা হবে। তাছাড়া ভবিষ্যতে পদবঞ্চিত করারও হুঁশিয়ারি দেন তারা।

এরপর দুই সিটির ওয়ার্ডভিত্তিক বিদ্রোহী প্রার্থীর তালিকা তৈরি করে তাদের প্রার্থিতা থেকে বিরত করতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়। মহানগরের এ চার শীর্ষ নেতা ক্ষুব্ধ এসব প্রার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রত্যাহারের শেষ দিন ৯ জানুয়ারির মধ্যে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের তাগিদ দেন। সে ক্ষেত্রে দলের অপূর্ণাঙ্গ ঢাকা মহানগর কমিটিসহ থানা-ওয়ার্ড কমিটিগুলো পুনর্গঠনের সময় তাদের বিভিন্ন পদে পদায়ন এবং ভবিষ্যতে বিভিন্নভাবে মূল্যায়নের প্রতিশ্রম্নতিও দেন। গত ৮ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকরা বিদ্রোহী প্রার্থীদের চিঠি পাঠিয়ে দল সমর্থিত প্রার্থীদের সমর্থন করে নিজ নিজ মনোনয়ন প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। দলের এসব উদ্যোগে অনেকেই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করলেও এখনো মাঠ দাপিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন শতাধিক বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, সব ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সরে যেতে কেন্দ্রের পর মহানগর থেকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। লিখিত চিঠি দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে বোঝানোও হয়েছে। এরপরও যারা দলের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবির বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষা করে যারা এখনো প্রার্থী আছেন, তারা আর যাই হোক; আওয়ামী লীগের লোক হতে পারেন না। এসব প্রার্থীর কেউ দলীয় পদে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<85343 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1