শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ছোট শিশুদের 'মেজর কিলার' নিউমোনিয়া

নিপোর্টের জরিপ
যাযাদি রিপোর্ট
  ২৬ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ২৬ জানুয়ারি ২০২০, ০০:১৬

চলতি শীত মৌসুমের শুরু থেকেই ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে ১৭১ জন। এ বছর ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে আরও ১৬০ জন। নভেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট মারা যাওয়া শিশুর সংখ্যা ৭২ জন। এছাড়াও ঢাকার বাইরে, ১৪ জানুয়ারি নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে মারা যায় সাত মাসের শিশু প্রতিপ্রাত্য চাকমা। হাসপাতাল থেকে জানা যায়, গত বছরের ৬ নভেম্বর থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে সেখানে ভর্তি হয়েছে মোট ২২২ জন।

খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রাজেন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, 'উপজেলা পর্যায়ে শিশুরা নিউমোনিয়াতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা না নেওয়াতে জটিলতা বাড়ছে।' তিনি আরও বলেন, 'এসব শিশুর বেশির ভাগেরই বয়স ছয় থেকে ১৮ মাস। অনেকেই সিভিয়ার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।'

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুমৃতু্যর সবচেয়ে বড় কারণ নিউমোনিয়া। দশ বছর আগের তুলনায় সম্প্রতি নিউমোনিয়া পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এখনও প্রতিঘণ্টায় এই রোগে একজন করে শিশুর মৃতু্য হচ্ছে, অথচ নিউমোনিয়া প্রতিরোধযোগ্য।

২০ জানুয়ারি 'বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭-১৮'-এর প্রাথমিক ফল প্রকাশ করে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট)। এই জরিপকে দেশের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সবচেয়ে বড় জরিপ বলে বিবেচনা করা হয়। জরিপে নিউমোনিয়া এবং সংক্রমণকে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য 'মেজর কিলার' বলে উলেস্নখ করা হয়েছে।

এই জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়- এক মাস থেকে ১১ মাস বয়সি যত শিশু মারা যায়, তার মধ্যে অর্ধেক শিশু মারা যায় শুধু নিউমোনিয়া এবং সিরিয়াস ইনফেকশনে। একইসঙ্গে নবজাতক (শূন্য থেকে ২৮ দিন) মৃতু্যর তিন-চতুথাংর্শ ঘটে অ্যাস্ফিক্সিয়া (জন্মকালীন শ্বাসরোধ), নিউমোনিয়া বা বড় কোনো সংক্রমণ, অপরিণত এবং কম ওজনের জন্য।

নবজাতক মৃতু্যর ঘটনাগুলো থেকে জানা যায়- অপরিণত এবং কম ওজনের কারণে ১৯ শতাংশ, জন্মকালীন শ্বাসরোধ এবং জন্মকালীন ইনজুরি রয়েছে ২৯ শতাংশ এবং নিউমোনিয়া ও সংক্রমণ রয়েছে ২৫ শতাংশ।

এছাড়াও এক মাস থেকে ১১ মাস বয়সি শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয় ৪৮ শতাংশ, ডায়রিয়াতে ১৪ শতাংশ এবং জন্মগত ত্রম্নটিতে ছয় শতাংশ। একইসঙ্গে ১২ মাস থেকে ৫৯ মাস অর্থাৎ এক বছর থেকে পাঁচ বছর বয়সি শিশুদের মৃতু্যর কারণ নিউমোনিয়া এবং অন্যান্য সংক্রমণ ১৩ শতাংশ, ডায়রিয়াতে ছয় শতাংশ এবং পানিতে ডুবে মারা যায় ৫৯ শতাংশ।

তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, নভেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭২ জন যে শুধুই নিউমোনিয়ার জন্য মারা গেছে বিষয়টি তা নয়। নিউমোনিয়ার সঙ্গে অন্যান্য রোগের উপস্থিতিও ছিল।

শিশু হাসপাতালের রোগতত্ত্ববিদ কিংকর ঘোষ বলেন, 'একটি রোগী যদি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়, তারপরও সে শুধু নিউমোনিয়াতে মারা যায় না। এর সঙ্গে অন্যান্য সমস্যাও ছিল, অন্য রোগ যোগ হয়েই সে মারা যায়।'

সম্প্রতি সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় দুটি শিশু।

প্রতিষ্ঠানটির ন্যাশনাল সিচুয়েশন অ্যানালাইসিস রিপোর্ট অব নিউমোনিয়া শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের এখনও মৃতু্যর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া।

প্রতিষ্ঠানটির নিউমোনিয়া স্যানিটারি কমিটমেন্ট অ্যাডভাইজার সাব্বির আহমেদ বলেন, 'পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃতু্যর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া হলেও নবজাতক মৃতু্যর কারণ আবার ভিন্ন। আর বাংলাদেশের 'আন্ডার ফাইভ ডেথ' এর ষাট শতাংশই হচ্ছে নবজাতক মৃতু্য। এজন্য এখন দেশের প্রধান ফোকাস হচ্ছে নবজাতক মৃতু্যর দিকে। যার কারণে পাঁচ বছরের কম শিশু মৃতু্যর দিকে ফোকাসটা কম দেওয়া হচ্ছে- এটিও একটি বড় কারণ।'

এ কারণে জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় অসুস্থ শিশুর সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থা (ইনটিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট অফ চাইল্ড হুড ইলনেসেস) শক্তিশালী করা এবং নিউমোনিয়াকে আরেকটু ফোকাস করা দরকার বলেও জানান সাব্বির আহমেদ।

শিশু মৃতু্যর জন্য এখনও নিউমোনিয়াকে 'নাম্বার ওয়ান লিডিং কজ' বলে অভিহিত করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ ?মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুলস্না।

তিনি বলেন, 'আগে শিশু মৃতু্যর প্রধান তিন কারণ ছিল নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া এবং অপুষ্টি। কিন্তু এখন ডায়রিয়াতে অসংখ্য শিশু আক্রান্ত হলেও তাতে একেবারেই মৃতু্য নেই, অপুষ্টিজনিত মৃতু্যও কমেছে।' সেই হিসেবে নিউমোনিয়া কমলেও এটা এখন শিশু মৃতু্যর প্রধান কারণ বলেও জানান তিনি।

নিউমোনিয়ার প্রতিরোধের প্রসঙ্গে ডা. মোহাম্মদ সহিদুলস্না বলেন, 'এর প্রথম প্রতিরোধ হচ্ছে- ভ্যাকসিনের বাইরে যেন কোনো শিশু না থাকে, এটা নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে অপুষ্টিজনিত শিশুদের নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি, তাই নিউমোনিয়া কিছু কমাতে হলেও অপুষ্টির দিকে নজর দিতে হবে এবং যদি দ্রম্নত শ্বাস এবং জ্বর হয়, তাহলে যত দ্রম্নত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। কারণ নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত শিশুকে যদি প্রথম দুই দিনের মধ্যে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া যায়, তাহলে মৃতু্যর হার কমে যাবে। যদি সাতদিন পরে যাওয়া হয়, তাহলে মৃতু্যর হার বেড়ে যাবে।'

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যাটারনাল, নিউনেটাল, চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলোসেন্স হেলথ প্রকল্পের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক বলেন, 'নিউমোনিয়াতে মৃতু্যর হার আগে যা ছিল, তার চেয়ে অনেক কমেছে এবং একে আরও কমাতে হবে। তবে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃতু্যর কারণ হিসেবে নিউমোনিয়ার সঙ্গে আরও কারণ রয়েছে।'

তিনি আরও জানান, নিউমোনিয়াতে শিশু মৃতু্যর অন্যতম কারণ হচ্ছে সময়মতো চিকিৎসা শুরু না করা। এখানে কিছুটা সচেতনতার অভাব রয়েছে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পরই যদি তার চিকিৎসা শুরু করা যায়, তাহলে কিন্তু সে সিভিয়ার নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হতে পারছে না, আর সিভিয়ার নিউমোনিয়াতেই শিশুরা মারা যাচ্ছে। সেজন্যই আমাদের ইনটিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট অফ চাইল্ড হুড ইলনেসেস প্রটোকল এবং এর অধীনে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

তবে শহর এলাকায় বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বস্তি এলাকা এবং এসব বস্তি এলাকার মানুষ স্বাস্থ্যসেবায় সবসময়ই পিছিয়ে পড়ে বলেও মন্তব্য করেন ডা. মো. শামসুল হক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<85948 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1