মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকার দুই সিটির ভোট

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই বড় চ্যালেঞ্জ

সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসি এখনো দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ না নিলেও ভোটের দিন তারা এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ তৎপর থাকবে বলে আশা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের
সাখাওয়াত হোসেন
  ২৮ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

দেশে প্রথমবারের মতো কোনো নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গভাবে ইভিএমের ব্যবহার হওয়ায় তা সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলাই এখন নির্বাচন কমিশনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা এ ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হলে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটদানের বিষয়টি সর্বস্তরে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। ফলে আগামীতে ইভিএমে ভোটগ্রহণের ক্ষেত্রে জোরাল প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। এছাড়া সাধারণ ভোটারের ভোটাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর জন-আস্থার যে সংকট রয়েছে তা আরও কয়েক গুণ বাড়বে। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় ঢাকার দুই সিটির আসন্ন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করে তুলতে ইসি নানাভাবে আটঘাট বাঁধছে। অথচ অতিউৎসাহী রাজনীতিকদের ইন্ধনে ভোটের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে পালস্না দিয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘন, হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে, যা সাধারণ ভোটারদের মধ্যে নানামুখী উদ্বেগ ছড়ালেও সে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া ইসির পক্ষে যথেষ্ট কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারও এ ইসু্যটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। দুই সিটিতে ভোটে জয়লাভের চেয়ে ইভিএমএ ভোটারদের বিশ্বস্ততা অর্জনের বিষয়টি তাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলের নীতিনির্ধারকদের ধারণা, ঢাকার দুই সিটিতে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা গো-হারা হেরে যাবে না। খুব বেশি হলে যেকোনো এক সিটির মেয়রসহ অর্ধশতাধিক কাউন্সিলর পদে বিএনপি দলীয় প্রার্থীরা বিজয়ী হবেন। ভোটের ফল এমনটি হলে তা আওয়ামী লীগ ও সরকারের জন্য 'শাপে বর' হয়ে দাঁড়াবে। ইভিএমের মাধ্যমে যে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ভোট গ্রহণ সম্ভব- এ বিষয়টিও জনগণের আস্থায় আসবে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন তুললে তা দেশে-বিদেশে অগ্রহণযোগ্য হবে। কোনো মহল ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালালে সাধারণ জনগণই তাদের কণ্ঠরোধে তৎপর হবে বলেও মনে করেন আওয়ামী দলীয় নীতিনির্ধারকরা।

তবে ভোটের মাঠের পর্যবেক্ষকদের ধারণা, সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ঢাকার দুই সিটিতে ইভিএমএ সুষ্ঠু নির্বাচন চাইছে। এ মিশনে তারা সফল হলে বিগত নির্বাচনগুলোতে হারানো আস্থা যেমন ফিরবে, তেমনি আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংকের নতুন ভোটার যুক্ত হবেন, যার ইতিবাচক ফল আগামী জাতীয় নির্বাচনে মিলবে।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, আসন্ন নির্বাচনে ঢাকার দুই সিটির মেয়র ও কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সমান সংখ্যক প্রার্থী বিজয়ী হলেও মহানগরীর ক্ষমতা ঘুরেফিরে আওয়ামী লীগের হাতেই থাকবে। এছাড়া ক্ষমতার মোহে বিএনপি সমর্থিত জয়ী কাউন্সিলরদের অনেকে হয়তো ক্ষমতাসীন দলে ভিড়বে। এমনকি ইভিএমএ ভোট সুষ্ঠু হয়নি- বিএনপির পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ উঠলে দলের বিজয়ী প্রার্থীরাই এর বিরোধিতা করবে বলে মনে করেন তারা।

এদিকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন এখনো দৃশ্যত কোনো জোরাল পদক্ষেপ না নিলেও ভোটের দিন তারা এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ তৎপর থাকবে বলে আশা করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, 'সন্দেহ নেই, ঢাকার দুই সিটির নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একাদশ জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার কাঠামোর কয়েকটি স্তরের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার বিষয়গুলো আলোচনায় রয়েছে। ভোটের প্রচারণার মাঠে যে পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, তাতে আশা করা হচ্ছে, নির্বাচন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। এমন প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে এ নির্বাচন সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এ সত্য এড়ানো কঠিন যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন ভোটাধিকার রক্ষার ব্যাপারে মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। এই প্রেক্ষাপটে আমি বলব, মানুষের হৃত আস্থা পুনরুদ্ধারে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটি সুযোগ এনে দিয়েছে নির্বাচন কমিশনের সামনে। এ জন্য সর্বপ্রথম তাদের অবস্থান প্রশ্নমুক্ত করতে হবে। তাদের যে সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে, এর প্রয়োগ করতে হবে যথাযথভাবে।'

দায়িত্বশীল এ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক আরও বলেন, শুধু নির্বাচন কমিশনই নয়, সুষ্ঠু-অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব মহলসহ রাজনৈতিক দলগুলোর দায়ও কম নয়। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক মহল যদি চায়, স্বচ্ছ ও প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন হোক; তাহলে অবশ্যই এর ইতিবাচক প্রভাব পরিস্ফুটিত হতে বাধ্য। নির্বাচন কমিশনের সামনে ঘুরে দাঁড়ানোর যে সুযোগ ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে নিয়ে এসেছে, তা তারা হাতছাড়া করবে না বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।

তবে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনরা মনে করেন, স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের প্রধান ভূমিকা থাকলেও এ ক্ষেত্রে সরকারি দলের সদিচ্ছাটাই মুখ্য। সরকারি দল চাইলে সবার অধিকার নিশ্চিতকরণসহ ভীতিমুক্ত, চাপমুক্ত ও স্বচ্ছ নির্বাচনী পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে। একই সরকারের অধীনে একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হতে থাকলে এর ফল ভালো হতে পারে না বলেও হুশিয়ার করেন তারা।

এদিকে ঢাকার দুই সিটির ভোট সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও গ্রহণযোগ করে তোলার বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলও যে চাপে রয়েছে তা দলের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

গত রোববার মোটর শ্রমিক লীগের সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, 'নির্বাচন কমিশন একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করবে, নিরপেক্ষ নির্বাচন করবে- এখানে সরকারের কোনো এজেন্সি কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি যেন না করে। কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ যাতে না হয়, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার বার্তা দিয়েছেন।'

ওবায়দুল কাদের জানান, প্রধানমন্ত্রী সরকারের সব সংস্থার প্রধানদের বলেছেন, এ নির্বাচনে তিনি কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ, বাড়াবাড়ি চান না। নির্বাচনে জনগণ যা চান তা-ই হবে।

নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার মাঠের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকার্ যাব-পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তাদের সর্বোচ্চ তৎপর থাকতে উপরমহল থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের কোনো প্রার্থীর পক্ষে অনৈতিকভাবে কেউ কোনো তৎপরতা চালালে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও ঊর্ধ্বতনরা হুঁশিয়ার করেছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অপারেশন বিভাগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো ঘটনার সূত্র ধরে কেউ যাতে বিএনপিসহ বিরোধী দলীয় কোনো প্রার্থীর ওপর কোনো হামলা চালাতে না পারে সে ব্যাপারে পুলিশের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হয়েছে। এ দায়িত্ব পালনে কেউ ব্যর্থ হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া ভোটের দিন ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন, পথে যাতে কোনো কুচক্রী মহল তাদের বাধা দিতে না পারে এবং এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে যাতে তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার করা যায়- তার সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রেখে ভোটের মাঠের 'ডিউটি পস্ন্যান' সাজানো হচ্ছে।

গত ১০ জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হলেও শেষ সময়ে এসে রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্পটে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটায় রোববার ডিএমপির শীর্ষপর্যায় থেকে থানা পুলিশকে এ ব্যাপারে আরও সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান রাজধানীর একাধিক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা (ওসি)। সংশ্লিষ্টরা জানান, যেকোনো নির্বাচনেই সাধারণত এ ধরনের ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তবে এবার প্রশাসন তা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে চাইছে।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত কাউন্সিলরদের সঙ্গে কথা বলে একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জানান, দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে তাদের সব ধরনের সংঘাত-সহিংসতা এড়িয়ে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ভোটাররা যাতে নিরাপদে ভোটকেন্দ্রে এসে নিজের ভোট নিজে দিতে পারেন তা নিশ্চিত করতে দলীয় প্রার্থীর পাশাপাশি নেতাকর্মীদেরও তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোট আদায়, ভোটদানে বাধা কিংবা ভোটগ্রহণের কাজে সংশ্লিষ্ট কারও ওপর কেউ কোনো চাপ সৃষ্টি করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বলেও দলীয় হাইকমান্ড আগাম সতর্ক করেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<86297 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1