শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন

ভোটের ফল পর্যালোচনায় আ'লীগের কপালে ভাঁজ

নির্বাচনের পর বিভিন্ন ওয়ার্ডের ফল পর্যালোচনা করে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা, পেশিশক্তির ব্যবহার ও অন্তর্কোন্দলের প্রমাণ পাওয়া গেছে
ফয়সাল খান
  ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সদ্যসমাপ্ত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভরাডুবির পর বিএনপি যখন নানা অভিযোগে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে তখন দলীয় প্রার্থীদের বড় বিজয়েও আওয়ামী লীগের কপালে ভাঁজ পড়েছে। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর বিভিন্ন ওয়ার্ডের ফল পর্যালোচনা করে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা, পেশিশক্তির ব্যবহার ও অন্তঃকোন্দলের প্রমাণ পেয়েছেন নেতারা। বিভিন্ন ওয়ার্ডে দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর পরাজয়ের পেছনে মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের ইন্ধন রয়েছে বলেও আভাস পেয়েছেন তারা। যেসব কেন্দ্রে দলীয় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী পরাজিত হয়েছে অথবা সংঘর্ষ-উত্তেজনা তৈরি হয়েছে সেসব এলাকার ভোটের ফল ও দলীয় নেতাদের কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানিয়েছেন নেতারা।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, মেয়র পদে বড় বিজয় আর বেশিরভাগ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে জয়ের পরও খুশি নয় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আসলেও ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় দলীয় নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও আত্মঘাতী কর্মকান্ড বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দলের জন্য। এমন ঘটনাও ঘটেছে নিজের জয়ের জন্য দল সমর্থিত মেয়রপ্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করছেন অনেক কাউন্সিলর প্রার্থী। আঁতাত করেছেন বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গেও। এমনকি নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিন চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের দিয়ে দলীয় নেতাদের ভয়-ভীতি দেখানোর ঘটনাও রয়েছে। তাছাড়া এসব ঘটনায় স্থানীয় এমপি, মহানগার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের যেসব নেতারা জড়িত ছিলেন তাদের কর্মকান্ডে বিশেষ নজর রাখছে আওয়ামী লীগ। এসব বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান করে দলীয় সভাপতি ও প্রাধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উভয় সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে একক প্রার্থী নিশ্চিত করতে পারলেও কাউন্সিলর পদে তা পারেনি আওয়ামী লীগ। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে মহানগর নেতা অথবা স্থানীয় এমপির আশীর্বাদ নিয়ে বিদ্রোহ প্রার্থী হয়েছেন

অনেকেই। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডকে দলের পক্ষ থেকে উন্মুক্ত রাখার গুজব ছড়িয়েছেন তারা। যদিও দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ঢাকার কোনো ওয়ার্ডেই প্রার্থিতা উন্মুক্ত করেনি আওয়ামী লীগ। দলীয় সমর্থন উন্মুক্ত প্রমাণ করতে দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর পাশাপাশি বিদ্রোহীরাও নৌকার প্রচারণা চালিয়েছেন। তবে নির্বাচনের ফলাফলে তার প্রভাব পড়েনি। বিভিন্ন ওয়ার্ডে দলীয় এসব নেতাদের সমান ভোট পায়নি নৌকা। অনেক ক্ষেত্রে এর উল্টো ঘটনাও ঘটেছে।

সূত্রগুলো বলছে, ভোট পাওয়ার আশায়, স্থানীয়ভাবে বিএনপি-জামায়াতের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে আতাত করেছেন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। বিনিময়ে তাদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন। বিদ্রোহী প্রার্থীরা প্রভাবশালী হওয়ার কারণে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরাও এই সুযোগ লুফে নিয়েছে। ফলে মেয়র পদে ধানের শীষে ভোট দিলেও কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ভোট দিয়েছেন তারা। আবার কোনো কোনো ওয়ার্ডে নিজস্ব বলয় টিকিয়ে রাখতে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এ বিষয়ে দল থেকে ব্যবস্থা না নিলে আওয়মী লীগের ঢাকার রাজনীতি হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা যায়যায়দিনকে বলেছেন, নির্বাচনের আগে দলীয় নেতাকর্মী না পেয়ে নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করার জন্য অনেক কাউন্সিলর প্রার্থী বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তাদের নিয়ে নিজের ও নৌকার প্রচারণা চালিয়েছেন। ফলাফলের দিকে তাকালেই স্পষ্ট বোঝা যায়, বিএনপি জামায়াতের এসব নেতাকর্মী কাউন্সিলর প্রার্থীকে ভোট দিলেও মেয়র পদে কেউ নৌকায় ভোট দেয়নি। অনেক ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা পাস করেছেন কিন্তু মেয়র প্রার্থীরা বিএনপির মেয়র প্রার্থীর চেয়ে কম ভোট পেয়েছেন। আবার অনেক ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী অনেক বেশি ভোট পেলেও দলের কাউন্সিলর প্রার্থীরা তার অর্ধেক ভোট পেয়েছেন। আবার কিছু ওয়ার্ডে বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীর চেয়ে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী অনেক বেশি ভোট পেয়েছেন। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কর্ণেল (অব.) ফারুক খান যায়যায়দিনকে বলেন, ঢাকার নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী নিয়ে কিছু সমস্যা ছিল। বড় দল হিসাবে এটি অস্বাভাবিক নয়। নেতৃত্বের প্রতিযোগীতাকে আওয়ামী লীগ সব সময় সমর্থন করে। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করা আর বিশৃঙ্খলার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

সূত্রমতে, শাহজাহানপুর থানায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুটি ওয়ার্ড রয়েছে। এই দুই ওয়ার্ডেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত দুই কাউন্সিলর প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। এখানে বিদ্রোহীসহ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীরা যা ভোট পেয়েছেন তার চেয়ে মেয়র পদে শেখ ফজলে নূর তাপস প্রায় দুই হাজার ভোট কম পেয়েছেন। আবার বিএনপির মেয়রপ্রার্থী কাউন্সিলর প্রার্থীর চেয়ে দুই হাজার ভোট বেশি পেয়েছেন। যে ভোট কাউন্সিলর প্রার্থী পেলে বিএনপির কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে যেত। এই দুই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আঁতাতের বিষয়টি স্পষ্ট বলে মনে করছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা।

১১নং ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মির্জা আসলাম শরীফ ৪৬৮৯ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেছেন। এখানে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী হামিদুল হক শামীম পেয়েছেন ২৬৫৮ ভোট। অথচ আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস ভোট পেয়েছে ৪১৮৮টি। মেয়রকে যারা ভোট দিয়েছেন এমন প্রায় দেড় হাজার ভোটার আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীকে ভোট দেননি।

১২নং ওয়ার্ডে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উপ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মামুনুর রশিদ শুভ্র। তিনি ৩ হাজার ৯১০ ভোট পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ মনোনিত গোলাম আশরাফ তালুকদার ১ হাজার ৪৬০ ভোট পেয়েছেন, আরেক বিদ্রোহী শেখ সেকান্দার আলী পেয়েছেন ১ হাজার ৪৬৫ এবং বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী রুবায়েত হোসেন পাপ্পু ২ হাজার ৪৩৮ ভোট পেয়েছেন। এখানে ফজলে নূর তাপস পেয়েছেন ৪ হাজার ৬৮০ ভোট। অথচ এই ওয়ার্ডে বিদ্রোহীসহ আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মোট ৬ হাজার ৮৩৯ ভোট পেয়েছেন। তাপস প্রায় দুই হাজার দুই শো ভোট কম পেয়েছেন। বিএনপির মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল পেয়েছেন ৪ হাজার ৪৫৬ ভোট। অথচ বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী ভোট পেয়েছেন ২ হাজার ৪৩৮টি। এখানে বিএনপির মেয়রপ্রার্থীকে যারা ভোট দিয়েছেন তারা কাউন্সিলরকে ভোট দেননি।

৫৩ নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নূর হোসেনের পরাজয়ের পেছনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নারী সদস্য ও সাবেক সাংসদের ভূমিকা রয়েছে বলে জানা গেছে। বিএনপির প্রার্থী মীর হোসেন মীরু কে ওই সাংসদ সমর্থন দিয়েছেন বলে এলাকায় ওপেন সিক্রেট ছিল।

৪৯ নং ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থী বাদল সরদার, ৬৬ নং ওয়ার্ডে জাতীয় পার্টির মতিন সাউদ, ৬৯ নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী সালাউদ্দিন আহমেদের পক্ষে ওই এলাকার সাংসদের লোকজন প্রকাশ্যে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচনের দিন ওই সাংসদের ছেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে প্রকাশ্যে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া আওয়ামী লীগ সমর্থিত ২৮নং ওয়ার্ডে মো. সালেহিন, ৩০নং ওয়ার্ডে মোহাম্মদ হাসান, ৪৫নং ওয়ার্ডে হেলেন আক্তার, ৪৭নং ওয়ার্ডে নাসির আহমেদ ভূইয়া স্থানীয় আওয়ামী লীগের কারসাজিতে পরাজিত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৮নং ওয়ার্ড এ দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন দক্ষিণখান থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একেএম মাসুদুজ্জামান মিঠু। কিন্তু ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের দুইজন নেতা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতির কারণে পরাজিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন মিঠু। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের এই হেভিওয়েট নেতারা কেউ তার জন্য কাজ তো করেননি বরং বিএনপি বিজয়ী প্রার্থী আলী আকবর আলীর পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করেছেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, 'নৌকা ভোট পেয়েছে ৯৩০০ আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আমি পেয়েছি ৬ হাজার দুইশো'র কিছু বেশি। বড়ুয়ায় তিনটি কেন্দ্রে নৌকা ভোট পেয়েছে ২ হাজার সাতশো'র বেশি। ধানের শীষ ভোট পেয়েছে ১ হাজার ১৫৭। আর বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী কাউন্সিলর প্রার্থী পেয়েছেন ২ হাজার ১৪৬টি ও আমি ভোট পেয়েছি ১ হাজার ১৯৭টি। নৌকা যদি এত বেশি ভোট পায় তাহলে দলীয় প্রার্থী হিসেবে আমি প্রায় ষোলশ ভোট কম পেলাম কিভাবে। আমাদের দলের নেতারা বিএনপির সাথে আঁতাত না করলে এমনটা কখনো হতো না।'

৪৯নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক আনিছুর রহমান নাঈমের কাছে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত সফিউদ্দিন মোলস্না পনু। সফিউদ্দিন বলেন, স্থানীয় এমপি প্রকাশ্যে নাঈমের পক্ষে কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ডেকে ডেকে নাঈমের পক্ষে কাজ করার জন্য বলেছেন। 

এছাড়া ৩নং ওয়ার্ডে জিন্নাত আলী মাদবর, ৬নং ওয়ার্ডে সালাউদ্দিন রবিন, ১৪নং ওয়ার্ডে মইজুদ্দিন, ৩১নং ওয়ার্ডে আলেয়া সারোয়ার ডেইজি, ৪১নং ওয়ার্ডে আব্দুল মতিন, ৪২নং ওয়ার্ডে জাহাঙ্গীর আলম পরাজিত হয়েছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<88505 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1