বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন

শিক্ষা আইন বাস্তবায়নে কতটা প্রস্তুত সরকার

শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নিশ্চিত এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে এ ধরনের উদ্যোগ 'আত্মঘাতী' হবে বলে মন্তব্য করেন শিক্ষাবিদরা
সাখাওয়াত হোসেন
  ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

দীর্ঘ বিলম্বের পর শিক্ষা আইন প্রণয়নে ফের নতুন করে তোড়জোড় শুরু হলেও তা বাস্তবায়নে সরকার ততটা প্রস্তুত কিনা তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি খসড়া শিক্ষা আইন চূড়ান্ত হওয়ার পর তা মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেলে সড়ক আইনের মতো এটিও শুরুতেই মুখ থুবড়ে কিনা, তা নিয়েও সংশয়ে রয়েছেন অনেকেই।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের অভিমত, যে কোনো কার্যক্রম যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করতে হলে তার আগে এর 'গ্রাউন্ড ওয়ার্ক' প্রয়োজন। তা না হলে ওই কার্যক্রমের শুরুতেই হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অথচ শিক্ষা আইন প্রণয়নে দীর্ঘদিন ধরে নানামুখী তোড়জোড় চালানো হলেও এর 'আগাম প্রস্তুতির' বিষয়টি কখনো গুরুত্ব পায়নি। এমনকি শিক্ষা আইন প্রণয়নের পথে কোন বিষয়গুলো প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে তা চিহ্নিত করারও কোনো উদ্যোগ কখনো নেওয়া হয়নি। ফলে শিক্ষা আইন পাস হলেও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শুরুতেই নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন তারা।

শিক্ষাবিদরা বলেন, প্রস্তাবিত আইনে নোট-গাইড বই এবং কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনসংক্রান্ত যে বিধান রয়েছে, তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হলে গোটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। মাধ্যমিক থেকে বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ফল বিপর্যয়েরও ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নিশ্চিত এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে এ ধরনের উদ্যোগ 'আত্মঘাতী' হবে বলে মন্তব্য করেন শিক্ষাবিদরা।

তারা জানান, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের নাজুক অবস্থার কারণে দেশে রেকর্ডসংখ্যক শিক্ষার্থী টিউশনের দিকে ঝুঁকে আছে। ইউনিসেফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী টিউশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, মাত্র ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী এর বাইরে রয়েছে। এছাড়া উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না থাকায় বেশির ভাগ শিক্ষক সৃজনশীল পাঠদানে অক্ষম। আর এ কারণেই শিক্ষকরা অনেকটা দায়ে পড়েই শিক্ষার্থীদের নোট ও গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছেন। এ অবস্থায় আকস্মিকভাবে তা তুলে দেওয়া হলে শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, খোদ শিক্ষকরাও চরম বিপাকে পড়বেন। প্রস্তাবিত আইনে নোট-গাইড বই এবং কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনসংক্রান্ত যেসব বিধান রয়েছে, তা বাস্তবায়নের অন্তত বছরখানেক আগে থেকেই শিক্ষকদের সৃজনশীল শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে তারা শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে পাঠ্যদান করছেন কি না তা নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বিষয়টি শিক্ষকরা মানলেও এ ব্যাপারে নিজেদের কিছুটা সাফাই গেয়েছেন তারা। তারা জানান, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বর্তমানে দেশের গ্রাম ও শহরাঞ্চলে দুই ধরনের সমস্যা বিরাজমান। শহরের অনেক নামি প্রতিষ্ঠানে এক-একটি ক্লাসরুমে ৮০ থেকে ১০০ জন শিক্ষার্থী থাকে। ফলে শিক্ষকরা পাঠদানে শিক্ষার্থীদের প্রতি আলাদা করে মনোযোগ দিতে পারেন না। আবার গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের দক্ষতা ও যোগ্যতার ঘাটতি আছে। অনেক স্থানে শিক্ষকের সংখ্যাও কম বা কখনো কখনো দীর্ঘসময় পদ শূন্য থাকে। সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশিক্ষণ বেশিরভাগ শিক্ষকই পাননি। আবার যারা পেয়েছেন তাদের কার্যত দেওয়া হয়েছে নামেমাত্র প্রশিক্ষণ। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েরই ভরসাস্থলে পরিণত হয়েছে অনুশীলনমূলক গ্রন্থ।

এদিকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণাতেও বাংলাদেশের শিক্ষার মানের দুর্দশার কারণ হিসেবে দক্ষ শিক্ষকের স্বল্পতা, শিক্ষাদান পদ্ধতির দুর্বলতা ও শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ঘাটতির কথা উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের 'ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট: লার্নিং টু রিয়ালাইজ এডুকেশনস প্রমিজ' শীর্ষক প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে এ বিষয়গুলো তুলে ধরে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের তুলনায় শিখন মানে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। এ ঘটতি পূরণের সুপারিশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শিক্ষার মান মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষকদের মান বাড়াতে হবে। এছাড়া সরকারিভাবে শিক্ষা ব্যয় বাড়ানোর ব্যাপারেও এ প্রতিবেদনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

অথচ শিক্ষা আইনে এসব বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে নোটবুক-গাইডবুক তুলে দেওয়া ও প্রাইভেট টিউশন বন্ধের ব্যাপারে যেসব নির্দেশনা রয়েছে তা 'ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার শামিল' বলে শিক্ষাবিদরা মনে করছেন।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, 'বিশ্বব্যাংক যা বলছে তা সম্পূর্ণ ঠিক না হলেও আংশিক সত্য। আমাদের শিক্ষার্থীদের ১১ বছরের স্কুলজীবনে যা অর্জন হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। আমাদের ভালো শিক্ষকের সংখ্যা কম। শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষকদের যোগ্যতার ঘাটতি আছে। শিক্ষকদের যেভাবে প্রশিক্ষণ হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। ফলে শিক্ষকদের যেভাবে পড়ানোর কথা তা তারা পারছেন না।'

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানান, শ্রেণিকক্ষে সিলেবাস সম্পন্ন না হওয়ায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থী অনুশীলনমূলক বইয়ের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য দিনে দিনে অপরিহার্য হয়ে ওঠা অনুশীলনমূলক বই বন্ধে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণনয়ের খবরে তাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। সংশিষ্টদের দাবি, বর্তমানে ৯৫ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী অনুশীলনমূলক বই পড়ে। তাই এসব বই বন্ধ করে দেওয়া হলে তা ফল বিপর্যয়সহ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, শ্রেণিকক্ষে যথাযথভাবে পাঠদান না হওয়া, সিলেবাস শেষ করার মতো সময় না পাওয়া ও সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে না পারার কারণে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়েই অনুশীলন বইয়ের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। বইগুলো শিক্ষার্থীদের নিজে থেকে পাঠগ্রহণ ও অনুশীলনে সহায়তা করায় সার্বিকভাবে শিক্ষা সহায়ক বইয়ের এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও অভিভাবকদের অনেকে মনে করেন, সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষাদানে শিক্ষকরা যথেষ্ট দক্ষ হলে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঠিকমতো লেখাপড়া হলে নোট-গাইডের দরকার হতো না।

বিষয়টি অনেকাংশে মেনে নিয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফওজিয়া রেজওয়ান বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতির ব্যাপারে সব শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাননি। শিক্ষক ম্যানুয়াল দেখে পাঠদানের সক্ষমতা তাদের সবার নেই। এ কারণে অনেক শিক্ষকই গাইড বইয়ের সহায়তা নেন। তিনি মনে করেন, নোট ও গাইড না থাকলেই ভালো। তবে রাতরাতি উঠিয়ে দিলে সমস্যা হবে।

উলেস্নখ্য, প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, আইন পাসের ৯০ দিন পর থেকে বাস্তবায়ন হবে নোট, গাইড এবং কোচিং, প্রাইভেট টিউশনসংক্রান্ত বিধান। আইনের ১৬ নম্বর ধারায় নোট-গাইড সম্পর্কে বলা হয়েছে, কোনো ধরনের নোট বা গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা যাবে না। এ বিধান লঙ্ঘন করলে অনূর্ধ্ব ৩ বছর কারাদন্ড বা ৫ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড দেওয়া যাবে।

অপরদিকে কোচিং-সংক্রান্ত বিধানে উলেস্নখ আছে, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট-টিউশনের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না। কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে অর্থের বিনিময়ে ইলেকট্রনিক বা অনলাইন পদ্ধতিতেও প্রাইভেট টিউশন বা কোচিংয়ের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না। করলে তা অসদাচরণ বলে গণ্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। তবে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের লিখিত সম্মতি সাপেক্ষে স্কুল সময়ের পরে বা আগে সরকার কর্তৃক প্রণীত বিধি বা নীতিমালা অথবা জারিকৃত পরিপত্র বা নির্বাহী আদেশ অনুসরণপূর্বক অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন।

এতে বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারকে বৈধতা দিয়ে বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে পাঠদানের উদ্দেশে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা বা কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করা এ আইনের অধীন নিষিদ্ধ হইবে না। এক্ষেত্রে দুটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এক. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলাকালীন সময় সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা যাইবে না। করা হলে উক্ত কোচিং সেন্টারের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা যাবে। দুই. কোচিং সেন্টারে কোনো শিক্ষক তার নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাতে পারবেন না। করালে তা অসদাচরণ হিসেবে শাস্তিযোগ্য হবে।

এদিকে শুধু নোটবুক-গাইডবুক, কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনই শুধু নয়, শিক্ষা আইন-২০২০ এসব বিধানসহ যে ৫৮টি ধারা সংবলিত খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে তার বেশিরভাগেরই বাস্তবায়নের পথে নানা অন্তরায় রয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। যা মোকাবেলায় শিক্ষা আইন পাস হওয়ার আগেই আগাম প্রস্তুতি জরুরি বলে অভিমত দেন তারা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<89728 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1