শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পাপিয়ার দায় এখন কেউ নিতে রাজি নয়

যাযাদি রিপোর্ট
  ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০
যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা আক্তারের সঙ্গে একটি বিশেষ মুহূর্তে নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক (বহিষ্কৃত) শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ -ফাইল ছবি

হঠাৎ করেই যুব মহিলা লীগের জেলা সাধারণ সম্পাদকের পদ পেয়ে গিয়েছিলেন শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ; নানাজনের পৃষ্ঠপোষকতায় তার এই উত্থানের খবর মিললেও তাদের কেউ এখন আর সে দায় নিতে চান না। গ্রেপ্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাপিয়ার নানা অপকীর্তি প্রকাশ হওয়ার পর এখন আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে যুব মহিলা লীগের নেতা-নেত্রীরা একে অন্যকে দোষারোপ করছেন।

শনিবার গ্রেপ্তার হওয়ার পর পাপিয়াকে ইতোমধ্যে বহিষ্কার করেছে যুব মহিলা লীগ। পাপিয়ার পৃষ্ঠপোষকতা কারা করেছেন, তাদের খোঁজও বের করার আশ্বাস দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

পাপিয়া ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুব মহিলা লীগের নরসিংদী জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক। ২০১৪ সালে এই পদ পান তিনি।

পাপিয়া কি নরসিংদীতে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নরসিংদীর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের কাছে জানতে চাইলে তাদের উত্তর আসে- 'না'।

নরসিংদী জেলা শহরের ভাগদী মারকাজ মসজিদ এলাকার বাসিন্দা পেট্রোবাংলার অবসরপ্রাপ্ত গাড়িচালক সাইফুল বারীর মেয়ে পাপিয়া ২০০৯ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন, এরপর ২০১২ সালে স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলেন।

নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আহসানুল ইসলাম রিমন বলেন, 'কলেজে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে কোনোদিন তাকে দেখি নাই।'

ছাত্রলীগের সাবেক আরেক নেতা বলেন, "সে (পাপিয়া) তো ছেলেদের সঙ্গে প্রেমের ঝামেলা নিয়েই ব্যস্ত থাকত। সে কলেজে ভর্তির পর থেকেই মাসে অন্তত দুটা বিচার করতে হয়েছে। আজকে এই ছেলের সঙ্গে ঝামেলা, কালকে অন্য ছেলের সঙ্গে। সে কোনোদিন ছাত্র রাজনীতি করে নাই।'

যুব মহিলা লীগে পদ পাওয়ার আগে পাপিয়া বিয়ে করেন নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমনকে।

২০০১ সালে নরসিংদী পৌরসভার কমিশনার মানিক মিয়া হত্যাকান্ডের আসামি সুমন দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন। ২০১০ সালে তিনি কারাগার থেকে ছাড়া পেলে তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ ফুল দিয়ে তাকে বরণ করেছিলেন।

২০১২ সালে পাপিয়াকে বিয়ে করার দুই বছর পর নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক হন সুমন।

মানিক মিয়া হত্যা মামলার আসামি লোকমান হোসেন ২০০৪ সালে নরসিংদী পৌরসভার মেয়র হলে তার দেহরক্ষীর ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল সুমনকে। লোকমান নিজেও পরে হত্যাকান্ডের শিকার হন।

লোকমানের ছোট ভাই হলেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ, যার সময়ে সুমন পান শহর কমিটির আহ্বায়কের পদ।

এখন একজন দেখাচ্ছেন অন্যজনকে

২০১৪ সালে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল সম্মেলন করলেও নরসিংদীতে কমিটি দিতে পারেননি। পরে ঢাকায় ফিরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নরসিংদী জেলা কমিটি ঘোষণা করেন, তাতে পাপিয়াকে দেওয়া হয় সাধারণ সম্পাদকের পদ।

নরসিংদীর নেতাদের অনেকের দাবি, তাদের বিরোধিতার মুখে ঢাকায় গিয়ে পাপিয়াকে পদ দিয়ে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল।

নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম হীরু বলেন, '২০১৪ সালে সম্মেলনের মাঠে পাপিয়ার নাম প্রস্তাব করলে আমি বিরোধিতা করি। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন বিরোধিতা করেন।

'পরে সম্মেলনকেন্দ্রে নাম ঘোষণা করতে গেলে আমি বলি, এখানে পাপিয়ার নাম কোনোভাবেই কমিটিতে রাখা যাবে না। পরে নাজমা ও অপু নরসিংদীতে কমিটি দিতে না পেরে ঢাকায় গিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কমিটি দেয়।'

যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা আকতার বলেন, জেলা কমিটিতে পাপিয়া আগে কোনো পদে না থাকলেও তাকে পদ দিতে অনেকটা 'বাধ্য' হয়েছিলেন তিনি।

'নরসিংদীর একটি পক্ষ এই মেয়েকে পদ না দেওয়ার জন্য আমাদের বলেছিল। আমি পাপিয়াকে পদ দেওয়ার পক্ষে ছিলাম না। তারপরও শেষ পর্যন্ত দিতে হয়েছে।'

পাপিয়াকে অর্থের বিনিময়ে পদ দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগের বিষয়ে নাজমা বলেন, 'পদবাণিজ্য করে যারা পাপিয়াকে পদ দিয়েছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক, এমন মেয়েদের জন্য যুব মহিলা লীগের সম্মান যায়।'

কাদের আশ্রয়ে পাপিয়া এতদূর এগিয়েছে- জানতে চাইলে যুব মহিলা লীগের সভাপতি বলেন, 'সে কাদের সঙ্গে উঠাবসা করে, তাদের খুঁজে বের করলেই সব পেয়ে যাবেন। আমাদের অনেকের সঙ্গে পাপিয়ার ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল, তাদের বের করুন।'

ঢাকার পাঁচ তারকা ওয়েস্টিন হোটেলে বিলাসী জীবনে থাকা পাপিয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-মন্ত্রীদের ছবি এখন সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল।

তাকে পদ দেওয়ার ক্ষেত্রে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অপু উকিলের সমর্থন ছিল বলে সংগঠনটির বিভিন্ন নেতা জানিয়েছেন।

অপু উকিল তা অস্বীকার করে বলেন, নরসিংদী আওয়ামী লীগের নেতাদের সুপারিশে পাপিয়াকে পদ দেওয়া হয়েছিল।

'জেলার নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা কমিটি দিই। তখন স্থানীয় আওয়ামী লীগের (তৎকালীন) সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীদের অনেক তদ্বির ছিল, অনেকেই এই মেয়েকে পদ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন।'

নরসিংদী আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি হীরু বলেন, 'কমিটি দেওয়ার পর আমি অপুকে জিজ্ঞাসা করলে সে আমাকে বলেছিল, "উপর থেকে চাপ ছিল, তাই পাপিয়াকে নেত্রী বানিয়েছি"।

'আমি বলব, এখন প্রকাশ করুক কোন উপরের চাপে তাকে সাধারণ সম্পাদক বানানো হয়েছে।'

পাপিয়ার অপকীর্তির বিষয়ে কিছুই জানতেন না বলে দাবি করেন অপু উকিল।

'আমি ২০১৪ সালে যখন কমিটি দিয়েছি, তখন সে নরসিংদীতে ছিল। কবে ঢাকায় এসেছে, কবে ব্যবসা শুরু করেছে, এগুলো আমি কিছুই জানি না। আমি তো মনে করেছি, সে নরসিংদীতেই আছে।'

অপু উকিল যে পদধারীদের কথা বলেছেন, তাদের মধ্যে জেলা সভাপতি আসাদুজ্জামান মারা গেছেন, সাবেক মন্ত্রী রাজু অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী।

প্রয়াত লোকমানের ভাই নরসিংদীর বর্তমান মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল দাবি করেছেন, তিনি পাপিয়াকে পদ দেওয়ার ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন।

কী কারণে পাপিয়াকে নেতৃত্বে চাননি- জানতে চাইলে কামরুল বলেন, 'পাপিয়ার উচ্চাভিলাষী চলাচলের কারণে তখই আমরা চাইনি। আর এখন তো আপনারা দেখতেই পারছেন কেন চাইনি।'

নরসিংদীর ছাত্রলীগ নেতা রিমন বলেন, 'পাপিয়ার যে অনেক টাকা, সেটা টের পাওয়া যেত। নরসিংদীতে চলার সময় নিজে একটি কারে চলত, আর সঙ্গে ১০-১২টা বাইক থাকত। আমরা সব সময়ই ভাবতাম, এত টাকা আসে কোথা থেকে?'

পাঁচ তারা হোটেলে পাপিয়ার বিলাসী জীবনযাপনের সঙ্গে তার বৈধ আয়ের সঙ্গতি নেই। তাকে গ্রেপ্তার করের্ যাব কর্মকর্তারা বলেছেন, মাদক-অস্ত্র, চোরাচালান, যৌন ব্যবসা, তদবিরবাণিজ্য ছিল পাপিয়ার অর্থের উৎস।

তুহিনের অস্বীকার

যুব মহিলা লীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য সাবিনা আক্তার তুহিনের সঙ্গে পাপিয়ার সখ্যের বিষয়টি বেশ আলোচিত সংগঠনের মধ্যে। পাপিয়ার নানা কাজে তুহিনের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে, এমন অভিযোগও এসেছে।

তবে তুহিন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, পাপিয়ার সঙ্গে তার সাংগঠনিক সম্পর্কের বাইরে কিছু ছিল না।

'আমি মহানগর উত্তরের নেত্রী, রাজনীতির কারণে আমার অনেকের সঙ্গে মিশতে হয়েছে। আমাদের কেন্দ্রীয় সম্মেলন আছে, সে কারণে দেশের সব জেলার নেত্রীদের সঙ্গেই আমার মিশতে হয়।'

তুহিন দাবি করেন, ২০১৪ সালে পাপিয়া যখন নরসিংদী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হন, তখনও তাকে চিনতেন না তিনি।

'পাপিয়া ২০১৪ সালে নেতা হয়েছে, আর আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে ২০১৭ সালে। তাহলে কমিটিতে আসার ব্যপারে আমার কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। আর জেলা কমিটি গঠনে মহানগরের কোনো হাত থাকে না।'

তবে ২০১৭ সালে পরিচয়ের পর পাপিয়ার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠার স্বীকারোক্তি আসে তুহিনের কথায়।

'তারপর থেকে নিয়মিত আসত। আমি এমপি ছিলাম, তার বাসা আমার বাসা থেকে কাছে, নিয়মিতই আসত।'

তখন সখ্য থাকলেও এক বছর ধরে পাপিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না বলে দাবি করেছেন তুহিন।

'হঠাৎ গত বছরের শুরুর দিক থেকে আসা বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি আমি নরসিংদীতে গিয়ে ফোন করেও দেখা পাই নাই। বছর দেড়েক আগে আমার কাছে টাকা ধার চেয়েছিল, আমি দিই নাই। এরপর থেকে আমার এখানে আসে না।'

এত সখ্য থাকার পরও কেন ফোন ধরত না- প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়ানোর কারণেই হয়তবা আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে।'

তুহিন দাবি করেন, তাকে রাজনৈতিকভাবে হেয় করতে পাপিয়ার সঙ্গে তাকে জড়ানো হচ্ছে।

'রাজনৈতিকভাবে অনেকেই আমার পেছনে লেগে আছে। শুধু আমার সঙ্গে কেন, কার সঙ্গে তার ছবি নাই? এমপি-মন্ত্রী থেকে শুরু করে আমাদের পার্টির অনেক নেতার সঙ্গে পাপিয়ার ছবি আছে। আমাকে হেয় করতে একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিচ্ছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<90248 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1