শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবার বাড়ল বিদ্যুতের দাম পানির দামও বাড়ছে

যাযাদি রিপোর্ট
  ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:৩০

বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে পানির দামও। বৃহস্পতিবার গ্রাহকসহ সবপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে খুচরা প্রতি ইউনিট ৩৬ পয়সা ও পাইকারিতে ৪০ পয়সা। নতুন এই দাম কার্যকর হবে আগামী মার্চ থেকে। অন্যদিকে পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসা। ঢাকা ওয়াসায় আবাসিকে প্রতি ইউনিটে (এক হাজার লিটার) ১১.৫৭ টাকা থেকে ২.৮৯ টাকা পয়সা বাড়িয়ে ১৪.৪৬ টাকা এবং শিল্প ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ৩৭.০৪ টাকা থেকে ২ টাকা ৯৬ পয়সা বাড়িয়ে ৪০.০০ টাকা করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম ওয়াসায় আবাসিকে ৯.৯২ টাকা থেকে ২ টাকা ৪৮ পয়সা বাড়িয়ে ১২.৪০ টাকা এবং শিল্প ও বাণিজ্যিকে ২৭.৫৬ থেকে ২ টাকা ৭৪ পয়সা বাড়িয়ে ৩০.৩০ টাকা করছে। তবে পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো ঘোষণা করা হয়নি।

বিদ্যুতের এই মূল্য বৃদ্ধির কারণে পাইকারি, খুচরা ও সঞ্চালনÑ তিন ক্ষেত্রেই ভোক্তাদের প্রতি মাসে বাড়তি টাকা গুনতে হবে। সাধারণ গ্রাহকপর্যায়ে (খুচরা) প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৬ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি দিতে হবে। প্রতি ইউনিটের বিদ্যুতের দাম ৬ টাকা ৭৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭ টাকা ১৩ পয়সা।

পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট গড়ে ৪০ পয়সা বা ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। ৪ টাকা ৭৭ পয়সা থেকে বেড়ে প্রতি ইউনিটের দাম হয়েছে ৫ টাকা ১৭ পয়সা।

এছাড়া বিদ্যুৎ সঞ্চালন মূল্যহার বা হুইলিং চার্জ প্রতি ইউনিটে শূন্য দশমিক ২৭৮৭ টাকা থেকে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছে শূন্য দশমিক ২৯৩৪ টাকা।

বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে মূল্য বৃদ্ধির এই ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল বলেন, মার্চ থেকে এ দাম কার্যকর হবে।

সর্বশেষ ২০১৭ সালের নভেম্বরে পাইকারি বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৫ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ায় সরকার, যা ওই বছর ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়।

গত বছরের জুনের শেষে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দুই মাসের মাথায় বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ানোর জন্য বিইআরসিতে প্রস্তাব পাঠাতে শুরু করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। এসব প্রস্তাবের ওপর গত ২৮ নভেম্বর শুরু হয় গণশুনানি।

তাতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) পাইকারিতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ২৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়।

তাছাড়া বিতরণকারী বা খুচরা বিক্রেতা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ডেসকো, ডিপিডিসি, ওজোপাডিকো ও নেসকো দাম বাড়ানোর আবেদন করে। যুক্তি হিসেবে পরিচালন ও জনবল বাবদ ব্যয় বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপন ও সরঞ্জামের মূল্য বৃদ্ধির কথা বলা হয় কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে।

তবে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) পক্ষ থেকে বলা হয়, পাইকারিতে দাম না বাড়লে তাদের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না।

নিয়ম অনুযায়ী গণশুনানির ৯০ দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত জানাতে হয় বিইআরসিকে। ৯০ দিন পূর্ণ হওয়ার এক সপ্তাহ আগেই দাম বৃদ্ধির ঘোষণা এলো।

পানির দাম বাড়ল

লোকসান কমানো, রাজস্ব ঘাটতি ও ঋণের পরিমাণ কমানোর অজুহাতে আবার পানির দাম বাড়িয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসা। ঢাকা ওয়াসা আবাসিকে প্রতি ইউনিটে (এক হাজার লিটার) ১১.৫৭ টাকা থেকে ২ টাকা ৮৯ পয়সা বাড়িয়ে ১৪.৪৬ টাকা এবং শিল্প ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ৩৭.০৪ টাকা থেকে ২ টাকা ৯৬ পয়সা বাড়িয়ে ৪০.০০ টাকা করা হয়েছে। ওয়াসার পানির দাম বছরে সাধারণত ৫ শতাংশ হারে বাড়ার নিয়ম থাকলেও এ দফায় আবাসিকে বাড়ানো হয়েছে ২৪.৯৭ শতাংশ। আর বাণিজ্যিকে বাড়ানো হয়েছে ৭.৯৯ শতাংশ। অন্যদিকে চট্টগ্রাম ওয়াসায় আবাসিকে ৯.৯২ টাকা থেকে ২ টাকা ৪৮ পয়সা বাড়িয়ে ১২.৪০টা এবং শিল্প ও বাণিজ্যিকে ২৭.৫৬ থেকে ২ টাকা ৭৪ পয়সা বাড়িয়ে ৩০.৩০ টাকা করা হয়েছে।

স্থানীয় সরকার সূত্রে জানা গেছে, দুই ওয়াসার দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন দেওয়ার পর আগামী এক মাস পর থেকে কার্যকরে উদ্যোগ নিতে দুই ওয়াসাকে চিঠি দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। উপসচিব সাঈদ উর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ওয়াসাকে পানির দাম বাড়ানোর চিঠি দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছে রাজশাহী ও খুলনা ওয়াসা। ফলে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের দায়িত্বে থাকার চারটি প্রতিষ্ঠানের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। ফলে বিদ্যুতের বাড়তি বিলের সঙ্গে পানির বর্ধিত দাম নতুন করে যোগ হবে।

এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ওয়াসা নিজস্ব অর্থায়নে চলে। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, ঋণ পরিশোধসহ ব্যয় সংকোচন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংস্থাটির। তারপরও ওয়াসার প্রস্তাবনা থেকে কয়েকগুণ কমিয়ে ন্যায়সঙ্গতভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে।

দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে দুই ওয়াসা বলছে, প্রকৃত উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে বিক্রয় মূল্যের সামঞ্জস্য রাখা এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ বর্তমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করতে পানির দাম বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়াও ওয়াসা উন্নয়নে বাস্তবায়ন ও বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন প্রকল্প শেষ করতে দাম বাড়ানোর যুক্তি দেখানো হয়েছে। বছরে একবার বাড়ানোর কথা বলা থাকলেও একই বছরে ওয়াসার একাধিকবার পানির দাম বাড়ানোর নজির আছে। ২০১৬ সালে জুলাই মাসে এক দফায় ৫ শতাংশ এবং নভেম্বরে আরেক দফায় একসঙ্গে ১৭ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। এ বিষয়ে ওয়াসার বক্তব্য হচ্ছে, ভর্তুকি কমাতেই ২০১৬ সালের জুলাই ও নভেম্বরে দুই দফায় পানির দাম বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের জুলাইতে পানির দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়েছিল ওয়াসা। সংস্থাটির সূত্র জানায়, ২০০৯-এ বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে প্রতি ইউনিট পানির দাম ছিল ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। সেটি বর্ধিত দাম কার্যকর হলে দাঁড়াবে ১৪ টাকা ৪৬ পয়সায়। একই অবস্থা চট্টগ্রাম ওয়াসার।

স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন ১৯৯৬ এর ২২ (১) ও ২২ (৩) ধারা অনুয়ায়ী, ৫ শতাংশের বেশি দাম বাড়ালে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতির প্রয়োজন হয়। সে লক্ষ্যে গত বছর থেকে পানির দাম বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসা। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো প্রস্তাবনায় ঢাকা ওয়াসা যুক্তি দেখিয়ে বলছে, প্রতি ইউনিটি পানির উৎপাদনে ঢাকা ওয়াসার খরচ ২০ টাকা এবং ওয়াসার দাপ্তরিক রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য ব্যয়সহ প্রতি ইউনিট পনির উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ২৫ টাকা। এ ছাড়াও বর্তমানে ওয়াসার বাস্তবায়িত ও বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প বাবদ ঋণ সহায়তা ৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ডিএসএল বাবদ পরিশোধযোগ্য অর্থের পরিমাণ প্রায় ৬৪৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসা এশিয়ার ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও দক্ষিণ কোরিয়ার উৎপাদন ব্যয় দেখানো হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, ঢাকা ওয়াসা প্রতি ইউনিট পানি উৎপাদনে ২৫ টাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসার খরচ প্রায় ১৫ টাকা ৬২ পয়সা। ভারতে এক ইউনিটি পানি উৎপাদন খরচ ২৬ দশমিক ৩৬ রুপি, যা বাংলাদেশি টাকার ৩১ টাকা। নেপালে ৩০ রুপি বা ২১ টাকা ৭৩ পয়সা, দক্ষিণ কোরিয়া ৫৫০ ইউন যা বাংলাদেশি টাকায় ৩৯ টাকা ৫২ পয়সা, ফিলিপাইনে ১১১ দশমিক ২৮ পিসো বাংলাদেশি টাকায় ১৮২ টাকা ৬৬ পয়সা এবং থাইল্যান্ডে খরচ ৯ বাথ বা ২৫ টাকা।

চট্টগ্রাম ওয়াসা পানির দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে প্রায় কাছাকাছি তথ্য তুলে ধরেছে। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রতি ইউনিট পানি উৎপাদন খরচ ১৬ টাকা, যা বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে অনেক তফাত। চট্টগ্রাম ওয়াসায় ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা প্রকল্প বাবদ ঋণ রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় আবাসিক প্রতি ইউনিটি পানির বর্তমান মূল্য ৯ টাকা ৯২ পয়সার স্থলে ১২ টাকা ৪০ পয়সা এবং বাণিজ্যিক প্রতি ইউনিটের ২৭ টাকা ৫৬ পয়সার স্থলে ৩০ টাকা ৩০ পয়সা পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব করা হলো। এর ফলে চট্টগ্রাম ওয়াসা আবাসিক খাতে পানি দাম ২৫ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক খাতে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ বাড়বে।

চট্টগ্রাম ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে মোট ৬৯ হাজার ৪৭টি বিলযোগ্য সংযোগ আছে। যার মধ্যে ৯২ শতাংশ আবাসিক বাকি ৮ শতাংশ বাণিজ্যিক। বিদ্যুৎ, জ্বালানি, তেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়াসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় বাড়ায় বর্তমানে প্রতি ইউনিট পানি উৎপাদনের চট্টগ্রাম ওয়াসার খরচ হয় প্রায় ১৬ টাকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে