বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

উপসর্গে মৃতদের নমুনা পরীক্ষার ফল প্রকাশে অনীহা স্বজনদের

তানভীর হাসান
  ০৬ জুন ২০২০, ০০:০০

করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃতদের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে অনীহা দেখা দিচ্ছে স্বজনদের মধ্যে। সামাজিকভাবে হেনস্তার ভয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ কারণে মৃতু্যর পর দ্রম্নত দাফন ও সৎকার করতে পারলেই যেন 'দায় থেকে মুক্তি' এমন ধারণা তৈরি হচ্ছে বলে মৃতের স্বজনরা দাবি করেছেন। এতে করোনায় আক্রান্ত মৃতের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিরাও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন। যদিও ফলাফল পজিটিভ পাওয়া মাত্রই রোগতত্ত্ব্ব বিভাগ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তারপরও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিট সূত্রমতে, গত পহেলা মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ৩৬০ জন। এর মধ্যে বুধবার মারা যান ১৬ জন। এর আগের দিন মারা যান ২০ জন। এদের মধ্যে গত দুই দিনে ৭ জনের করোনা পজিটিভ রয়েছে। তবে তার আগ পর্যন্ত মৃতদের করোনা পজিটিভের বিষয়ে তথ্য দিতে নারাজ হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ। তবে হাসপাতালের একটি সূত্র দাবি করেছে, নিহতদের অনেকের নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। আবার নমুনা নেওয়ার পর যাদের ফলাফল পজিটিভ

পাওয়া গেছে, ততক্ষণে দাফনের ৩ থেকে ৪ দিন পার হয়ে গেছে। একই চিত্র দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন জেলাতেও। মৃতদেহ দাফনের পরও করোনা পজিটিভের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষ ছাড়া স্বজনদের কাছ থেকে করোনার বিষয়ে তথ্য প্রকাশ পায়নি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদ যায়যায়দিনকে বলেন, অনেক সময় উপসর্গ নিয়ে ইমার্জেন্সি রোগী ভর্তি হওয়ার পরপরই অথবা এক-দুই দিন পর মারা যান। এক্ষেত্রে রোগীর নমুনা নেওয়ার পর পরীক্ষার রেজাল্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তার আগেই রোগীর স্বজনরা তাড়াহুড়ো করে মরদেহ দাফনের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মৃতদের স্বজনদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে দ্রম্নত দাফন করতে পারলেই তারা বেঁচে যান। এক্ষেত্রে তাদের দাফনের পর রেজাল্ট না পাওয়া পর্যন্ত কোয়ারেন্টিনে থাকার পরামর্শ দিলেও অনেক সময় তারা মানে না।

জানা গেছে, গত সোমবার থেকে মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে নারী শিশুসহ ২০ জনের মৃতু্য হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজনের শরীরে করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। বাকি সবাই করোনা সন্দেহ ও উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। এর মধ্যে করোনা পজিটিভ নিয়ে মারা গেছেন ডাক্তার নিত্য নন্দন দাস, আবদুল কুদ্দুস, জামিল হোসেন ও মো. পরেশ আলী। এছাড়া উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ইসহাক বেপারী, আউয়াল, হুমায়ুন, শফিউদ্দিন, মোজাম্মেল, সাবের, খসরু পারভেজ, মনোয়ারা বেগম, শওকত, আবদুলস্নাহ, আবদুল লতিফ, মো. নাজিম, রেনোয়ারা বেগম, মর্জিনা, নূর নাহার ও সালাউদ্দিন। তাদের সবাইকে করোনার নিয়ম অনুযায়ী দাফন করা হয়েছে। তবে করোনায় মৃত আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে মেহেদী হাসান অভিযোগ করেন, তার বাবা মারা যাওয়ার পর অনেকেই করোনার বিষয়টি চেপে যাওয়ার অনুরোধ করেন। উপসর্গ ছিল বলে প্রচার করতে বলেন। কিন্তু তিনি কারো কথা আমলে না নিয়ে বিষয়টি প্রকাশ করে মৃতদেহের সংস্পর্শে আসা সবাইকে তিনি কোয়ারেন্টিনে যাওয়ার পরামর্শ দেন এবং পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। করোনায় মো. পরেশ আলী উপসর্গ নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন গত ৩১ মে। এরপর মারা যান পরের দিন দুপুরে। দাফনের পর তার পরিবারের সদস্যরা করোনা আক্রান্তের বিষয়টি জানতে পারেন। তবে তারা বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও ধামরাই উপজেলা কর্তৃপক্ষ তাদের কোয়ারেন্টিন ও পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা আব্দুল লতিফ পহেলা জুন ভর্তি হওয়ার পরের দিন উপসর্গ নিয়ে মারা যান। তার পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায় বুধবার। কিন্তু সত্তরোর্ধ্ব লতিফের পরিবারও বিষয়টি এড়িয়ে যান। এদিকে গত এক মাসে খুলনায় উপসর্গ নিয়ে মারা যান ২৯ জন। এদের মধ্যে অন্তত ১০ জনের পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ আসে। বিষয়টি পরিবারের সদস্যরা গোপন রাখলেও রোগতত্ত্ব বিভাগ থেকে পরে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং সংস্পর্শে আগতদের কোয়ারেন্টিন ও পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। তবে রোগীর স্বজনরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দাবি করেন, সামাজিকভাবে হেনস্তার ভয়ে তারা বিষয়টি প্রকাশ করতে চান না। এ কারণে দ্রম্নত দাফন করে ফেলাটাই শ্রেয় বলে মনে করছেন।

করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃতদের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে অনীহার বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের অধ্যাপক পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, ফলাফল প্রকাশ না করার বিষয়টি ইতোমধ্যে আমাদের নজরে এসেছে। বিষয়টি রোগতত্ত্ব বিভাগকে জানানো হয়েছে। তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে। সামাজিকভাবে হেনস্তার ভয়েই এমনটি হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আবার অনেকে ভয় পেয়েও এমন করছেন।

তিনি বলেন, পজিটিভ রেজাল্ট আসলে অবশ্যই রোগীর স্বজনদের তা প্রকাশ করে সংস্পর্শে আগতদের কোয়ারেন্টিনে চলে যাওয়া উচিত। এমনকি পরীক্ষার ফলাফল না পাওয়া পর্যন্ত এসব ব্যক্তির কারও কাছে যাওয়াই উচিত না। কারণ এসে সামাজিক সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। তবে রোগতত্ত্ব বিভাগ এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছে।

সূত্রমতে, উপসর্গ নিয়ে এ পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃতের সংখ্যা বেশি। পাশাপাশি উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যাও বেশি। কারণ কোনো ধরনের সমস্যা দেখা দিলেই সাধারণ মানুষ ছুটছেন সেখানে। কর্তৃপক্ষের ধারণা, রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতালে সেবাবঞ্চিত হওয়া রোগীদের জরুরি ভিত্তিতে এখানে ভর্তি করা হচ্ছে বলে মৃতের হার বেশি। এমন পরিস্থিতিতে উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালটি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদ যায়যায়দিনকে বলেন, কুয়েত মৈত্রী, কুর্মিটোলা, মুগদাসহ বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা পজিটিভ রোগী ছাড়া ভর্তি নেওয়া হয় না। আমরা সেই রোগী ভর্তি নিচ্ছি। বিশেষ করে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে হার্ট, লিভার, কিডনি, অ্যাজমার রোগীরা সেবা পাচ্ছে না বা ভর্তি হতে পারছে না। তাই তারা অনেক হাসপাতাল ঘুরে শেষ মুহূর্তে এখানে আসছে। কিন্তু এখানে আসার পরপরই তারা মারা যাচ্ছে। চিকিৎসকদেরও কিছু করার থাকছে না। এজন্য মৃতের সংখ্যাটা বেড়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, একজন চিকিৎসক ও নার্স টানা ৭ দিন দায়িত্ব পালনের পর ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে চলে যাচ্ছেন। সেখান থেকে অনেকে আবার অসুস্থ হয়েও পড়ছেন। এ কারণে জনবল সংকট দেখা দিচ্ছে। পাশাপাশি রোগীর চাপও দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। এছাড়া আমাদের আগে থেকেই জনবল সমস্যা রয়েছে। বার্ন ইউনিট ভবনে চতুর্থ শ্রেণির কোনো কর্মচারী রাজস্ব খাতের না। আগে স্পেশাল বয়রা ডিউটি করত যাদের আমরা কোনো টাকা দিতাম না। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হওয়াতে তাদের করোনা ইউনিটে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। কারণ আমরা তাদের বেতন দেই না। তাই তাদের কেউ আক্রান্ত বা মরে গেলে দায়িত্ব নেবে কে? তাই আমরা দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে প্রায় আড়াইশ জনবল নিয়োগ দিয়েছিলাম, তাদের দিয়ে কাজ চালাচ্ছি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<101461 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1