শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যার পদধ্বনি, সতর্ক প্রশাসন

দেশের ১৫টি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। এসব জেলার ওপর দিয়ে বহমান নদনদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলায় বসবাসকারী মানুষের ঘরবাড়িতে পানি উঠে গেছে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি ও মাছের ঘের
যাযাদি ডেস্ক
  ০৭ জুলাই ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ০৭ জুলাই ২০২০, ১০:১২
চারদিকে থইথই পানি। আর এ পানিতে কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে দুরন্তপনায় মেতেছে দুটি শিশু। ছবিটি সোমবার নওগাঁর আত্রাইয়ের কদমতলা এলাকা থেকে তোলা -পিবিএ

দেশে করোনা মহামারির পাশাপাশি ধেয়ে আসছে বন্যা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সতর্কাবস্থায় রয়েছে বন্যাকবলিত জেলা প্রশাসন। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সার্বিক পরিস্থিতি মনিটরিং করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় সাধারণ মানুষের জন্য ত্রাণ সহায়তা পাঠানো হচ্ছে। পাঠানো হয়েছে শুকনো খাবারসহ শিশুখাদ্য। ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে বিভিন্ন খামারে গড়ে ওঠা গবাদিপশুর যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকে নজর রাখাসহ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এদিকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই মুহূর্তে দেশের ১৫টি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। এসব জেলার ওপর দিয়ে বহমান নদনদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলায় বসবাসকারী মানুষের ঘরবাড়িতে পানি উঠে গেছে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি ও মাছের ঘের। জেলাগুলো হচ্ছে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর। এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণকেন্দ্র জানিয়েছে, দেশের ১১টি নদীর পানি ১৫টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে দেশের উত্তর-পূর্বাংশের কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা বন্যার পানিতে পস্নাবিত হয়েছে। পয়েন্টগুলো হচ্ছে ধরলা নদীর কুড়িগ্রাম পয়েন্ট, ঘাগট নদীর গাইবান্ধা পয়েন্ট, ব্রহ্মপুত্র নদের নুনখাওয়া ও চিলমারী পয়েন্ট, যমুনা নদীর ফুলছড়ি, বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি, কাজীপুর, সিরাজগঞ্জ পয়েন্ট, আত্রাই নদীর বাঘাবাড়ি পয়েন্ট, ধলেশ্বরীর এলাসিন, পদ্মার গোয়ালন্দ, সুরমার কানাইঘাট ও সুনামগঞ্জ পয়েন্ট এবং পুরনো সুরমার দিরাই এলাকা। বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিংয়ে রাখতে কন্ট্রোল রুম চালু করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। বন্যা পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণে কন্ট্রোল রুম চালুর বিষয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আসিফ আহমেদ জানান, বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহে কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে। কন্ট্রোল রুমের নম্বর হচ্ছে ০১৩১৮-২৩৪৫৬০। এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণকেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, এখন যে পরিস্থিতি আছে, তা আগামী ৪-৫ দিন প্রায় একই রকম থাকবে। এরপর আবার বৃষ্টি শুরু হলে পানি বাড়তে পারে। এতে দেশের উত্তর-পূর্ব ও মধ্যাংশের যেসব এলাকা এখন পস্নাবিত, সেখানে পানির উচ্চতা বাড়বে এবং নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। তিনি আরও বলেন, তবে আগামী সপ্তাহে নতুন এলাকা আবার পস্নাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। পূর্বাভাসে আরও বলা হয়, আগামী ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর আরিচা এবং ৪৮ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর ভাগ্যকুল পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এদিকে সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, বন্যাকবলিত জেলার জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। জেলা প্রশাসকরাও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। তিনি বলেন, একদিকে করোনার ছোবল, অন্যদিকে বন্যা। রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি। গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন নিম্নাঞ্চলের বন্যাদুর্গত মানুষরা। বন্যাকবলিত জেলাসমূহের অভিমুখে প্রধানমন্ত্রীর উপহার নিয়ে দ্রম্নতগতিতে ছুটছে ত্রাণবাহী ট্রাক। ডা. এনাম বলেন, বন্যার্তদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের বিষয়ে সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নির্দেশেই আমরা সবাই মাঠে আছি। বন্যার্তদের ভয়ের কিছু নেই। এদিকে প্রতিদিনই বন্যাকবলিত জেলাগুলোর জন্য সরকারের ত্রাণ সহায়তা বাবদ চাল, গম ছাড় করা হচ্ছে। ছাড় করা হচ্ছে নগদ টাকা, শুকনা খাবার ও শিশুখাদ্য। আমাদের টঙ্গিবাড়ী (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীতে পদ্মা নদীর পানি প্রবল স্রোতে রাস্তা ভেঙে গেছে। যার কারণে নিম্নাঞ্চল দ্রম্নত পানিতে তলিয়ে গেছেন। এ ছাড়াও ওই রাস্তায় চলাচলকারী হাজার হাজার মানুষ চরম বিপাকে পড়েছে। জানা যায়, উজান হতে নেমে আসা ঢলের পানিতে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার পদ্মা নদী দিয়ে প্রবল বেগে স্রোত বয়ে যাচ্ছে। প্রবল স্রোতের কারণে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার হাসাইল কামারখাড়া সংযোগ সড়কটির ভাঙ্গনীয়া কবরস্থানের সামনের একটি অংশ ভেঙে গেছে। এতে ওই অঞ্চলের কামারখাড়া, বাগবাড়ী, ভাঙ্গনীয়া, আদাবাড়ী, বাইনখাড়া, মালিগাও, হাসইল, খোলাগাঁও, চৌসার, পয়সাগাঁওসহ প্রায় ১৪টি গ্রামের মানুষ এবং আশপাশের মানুষের যাতায়াত ওই রাস্তায় বন্ধ হয়ে গেছে। সোমবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পানি নিষ্কাশনের জন্য ভেঙে যাওয়া স্থানটিতে ড্রেনেজব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। ওই স্থানটিতেই ভাঙন দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে টঙ্গিবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাসিনা আক্তার জানান, আপাতত বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে। দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে আমরা রাস্তাটি সংস্কার করে দেব। হাতিয়া (নোয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, পূর্ণিমার জোয়ারে নোয়াখালী দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার তিনটি ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। গত তিনদিন পর্যন্ত প্রতিদিন জোয়ারে এসব এলাকা পস্নাবিত হচ্ছে। এতে উপজেলার সূখচর, নলচিরা ও চরঈশ্বর, হরনী ও চানন্দী ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ পূর্ণিমা সোমবার; তাই আগামী আরও কয়েকদিন একই অবস্থা বিরাজ করবে। জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ মেরামত না করায় এসব এলাকা অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে সহজে পস্নাবিত হয়। এতে সূখচর ইউনিয়নের চরআমান উল্যা, বৌবাজার ও চেয়ারম্যান বাজার। নলচিরা ইউনিয়নের তুপানিয়া ও নলচিরা ঘাট এলাকা। চরঈশ্বর ইউনিয়নের তালুদার গ্রাম মাইজচা মার্কেট এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। এসব এলাকার প্রায় ১০ সহশ্রাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম জানান, বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করে কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এখন ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে মেরামতের ব্যবস্থা করা হবে। মনপুরা (ভোলা) প্রতিনিধি জানান, অতিবৃষ্টি ও পূর্ণিমার প্রভাবে মেঘনার জোয়ার বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে ভোলার দ্বীপ উপজেলা মনপুরার নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে তিন হাজার মানুষ। উপজেলা সদরের হাজিরহাট ইউনিয়নের দাসের হাট ও সোনার চর এলাকা ২-৩ ফুট জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছে। এ ছাড়াও উপজেলার মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন বেড়িবাঁধহীন কলাতলীর চর ও চর নিজামেও ৩-৪ ফুট জোয়ারের পানিতে পস্নাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এতে করে পূর্ণিমার প্রভাবে জোয়ারে তৃতীয় দিনে পস্নাবিত এলাকার নিম্নাঞ্চলে বসবাসরত আনুমানিক তিন হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। এদিকে অতি বর্ষণ ও পূর্ণিমার প্রভাবে মেঘনার পানি বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা (পাউবো)। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডিভিশন-২ এর উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবদুর রহমান জানান, অতিবৃষ্টি ও পূর্ণিমার প্রভাবে জোয়ারে মেঘনার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তবে পূর্ণিমার প্রভাব কেটে গেলে মেঘনায় জোয়ারের পানির স্তর নেমে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। রানীনগর (নওগাঁ) প্রতিনিধি জানান, অবিরাম বর্ষণে ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানির তোড়ে আত্রাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আত্রাইয়ের কাশিয়াবাড়ি ব্রিজ দিয়ে পানি প্রবেশ করে রানীনগর উপজেলার বড়গাছা ইউপির বেশ কয়েকটি এলাকা পস্নাবিত ও পুকুর ডুবে যাওয়ায় বন্যার পানিতে পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এ ছাড়াও ওই এলাকার আমনচাষি কৃষকদের বীজতলা ডুবে গেছে। এতে জনমনে চরম আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। যেকোনো সময় উপজেলার প্রায় চারটি ইউনিয়ন পস্নাবিত হতে পারে। জানা গেছে, চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানির তোড়ে আত্রাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আত্রাইয়ের কাশিয়াবাড়ি সুইচগেট দিয়ে পানি প্রবেশ করে আত্রাইয়ের প্রায় আটটি পুকুর ডুবে গেছে, এতে মাছচাষিরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এ ছাড়াও ওই এলাকার আমনচাষিদের বীজতলা ডুবে গেছে। এতে জনমনে চরম আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে রানীনগর ও আত্রাই উপজেলার সিমান্তবর্তী বেড়িবাঁধ দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় ছোট যমুনার পানি বাড়তি হলেই রানীনগর উপজেলার প্রায় চারটি ইউনিয়ন পস্নাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ বিষয়ে রানীনগর উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ শহিদুল ইসলাম জানান, আত্রাইয়ের কাশিয়াবাড়ি এবং নান্দাইবাড়ি দিয়ে পানি প্রবেশ করে কৃষকের যে ক্ষতি হয়েছে, তাদের তালিকা করে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বরাবর প্রেরণ করা হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে