মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিড়ম্বনা সঙ্গী করেই ভার্চুয়াল ক্লাস

যাযাদি ডেস্ক
  ০৫ আগস্ট ২০২০, ০০:০০
অনলাইনে ক্লাস করছে এক শিক্ষার্থী

প্রথম স্কুলে ভর্তি হওয়া, ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যাওয়া, ক্লাসে নতুন বন্ধু তৈরি হওয়া- এসব ঘটনা স্মৃতি হয়ে থাকে সবার জীবনে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া অভূতপূর্ব এক মহামারির কারণে সাড়ে তিন বছরের সামারা ফাতিমা রায়হানের শিক্ষাজীবন শুরুই হয়েছে অনলাইনে।

ক্লাসরুমে নয়, ঢাকার মাস্টারমাইন্ড স্কুলের পেস্ন গ্রম্নপের এই শিক্ষার্থীর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় জুম অ্যাপে। সে চাঁদপুরে নানাবাড়ি থেকে ভার্চুয়াল ক্লাসে অংশ নেয়। কিন্তু ইন্টারনেটে বিঘ্নের কারণে প্রায়ই ক্লাসের মাঝে বিপত্তি ঘটে।

তার মা রোকসানা আজমীর সামিয়া বলেন, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ক্লাস শুরু হয়েছে ওর। তবে বেশ কিছু ক্লাস করা সম্ভব হয়নি ইন্টারনেটে সমস্যা থাকার কারণে।

তবে স্কুলের শিক্ষকরা আন্তরিকতার সঙ্গে নতুন এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন বলে জানান রোকসানা।

তিনি বলেন, 'কোনো ক্লাস মিস হলে টিচারদের ফোন দিলে তারা বুঝিয়ে দেন। মেসেঞ্জারে প্রয়োজনীয় নোট, লেকচারের ভিডিও, ছবি পাঠিয়ে দেন।'

করোনাভাইরাসের কারণে গত মার্চে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পর শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে টিভিতে ক্লাস সম্প্রচার ও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়াল ক্লাস চালুর সিদ্ধান্ত হয়।

অনেকের টিভি না থাকায়

এবং প্রয়োজনীয় ডিভাইস ও উপযুক্ত ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে সেই কার্যক্রম চলছে। মফস্বলে বা গ্রামে শিক্ষার্থীদের ভুগতে হচ্ছে বেশি।

চাঁদপুরের মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিরীন আক্তার বলেন, 'সরাসরি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের একটা টপিক বোঝাতে অনেক ইনফরমাল উদাহরণ দেওয়া যায়, অনলাইনে সেটা সম্ভব না, কারণ এটা সবাই দেখতে পায়।'

তিনি বলেন, অনলাইনে ক্লাস নেওয়া গেলেও পরীক্ষা নেওয়া যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে তার স্কুল কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থীই গ্রামের বাড়িতে রয়েছেন। অনেকের হাতে স্মার্টফোন থাকলেও গ্রামে ইন্টারনেটের গতি ধীর হওয়ায় সমস্যায় পড়ছেন তাদের অনেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাসিমুল হুদা বলেন, 'আমার কাছে যেসব ডিভাইস আছে, এর সবই থ্রিজি সাপোর্টেড। ফলে ফোরজির সুবিধা আমি নিতে পারছি না। আবার থ্রিজি নেটওয়ার্কও গ্রামে খুব স্থিতিশীল নয়। ফলে নির্ঝঞ্ঝাট ক্লাস করতে পারছি না।'

তিনি জানান, বাসায় নেটওয়ার্ক পেতে সমস্যা হয় বলে দুই কিলোমিটার দূরে উপজেলা সদরে গিয়ে তিনি ক্লাসে যুক্ত হন। তবে সেখানেও মাঝে মাঝে ক্লাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।

ডিভাইসের সমস্যা সমাধানে সরকারি বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় স্বল্প মেয়াদে ঋণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি টেলিকমিউনিকেশন অপারেটরদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দ্রম্নতগতির ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করার দাবি জানান তিনি।

গ্রামে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের এক ঘণ্টার একটি ক্লাস করতে মোটামুটি ৬০০-৭০০ মেগাবাইট ডেটা খরচ হয়। দাম নির্ভর করে কে কোন অপারেটরের কোন ইন্টারনেট প্যাকেজ ব্যবহার করছেন, এর ওপর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রবিউল আলম চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কালিয়াইশ ইউনিয়নে তার বাড়িতে আছেন।

তিনি বলেন, ''আমাদের অবস্থা 'দিন আনি দিন খাই'। মোবাইলের ব্যয়বহুল ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে অনলাইন ক্লাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আর নেট স্পিডও খুব কম।

একটা ক্লাস করতে কয়েক দফা ডিসকানেকটেড হয়ে যায়। আমার মোবাইলও খুব ভালো না। ঘরে ক্লাস করার মতো পরিবেশ নেই। বইপত্র কিছু সঙ্গে নেই, অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পড়তে সমস্যা হচ্ছে।''

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তারেক রহমান এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে আছেন। তিনি জানান, তার এলাকায় ইন্টারনেটের গতি খুবই ধীর হওয়ায় বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে নদীর পাড়ে গিয়ে তাকে ক্লাস ধরার চেষ্টা করতে হয়।

তিনি বলেন, 'ওখানেই একমাত্র ভিডিও কলিংয়ের মতো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। এরপরও দুটি ক্লাস করার পর আর ক্লাস করতে পারি না। যে ক্লাসগুলো মিস হয়েছে, সেগুলোর মেকআপ হিসেবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা, সেটা শিক্ষকরা স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।'

গত ৪ এপ্রিল থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। মোবাইল ইন্টারনেটের খরচ বেশি বলে এর বিরোধিতা করে আসছিলেন অনেক শিক্ষার্থী।

পরে গত ১৯ জুলাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আবেদনের ভিত্তিতে প্রতি মাসে ১৫ জিবি করে ইন্টারনেট প্যাকেজ দিচ্ছে। এতে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি এবং আগ্রহ আগের চেয়ে বেড়েছে বলে জানালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, 'আমরা ইয়াং টিচারদের ল্যাপটপ কিনতে ৫০ হাজার টাকা করে লোন দিচ্ছি। এ ছাড়া প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে শিক্ষকদের প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে। আর শিক্ষার্থীদের ডিভাইসের বিষয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা চলছে। শুরুতে কিছুটা কম হলেও এই মুহূর্তে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ৯০ শতাংশ। শিক্ষার্থীরা এখন বুঝতে পারছে, অনলাইন ক্লাসটা কেন প্রয়োজন এবং তারা আগ্রহের সঙ্গেই ক্লাস করছে।'

দেশের অনেক সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধের পর থেকেই ভার্চুয়াল ক্লাস চালু হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দেরিতে সেটা শুরু করে। প্রথম ক্লাস হয় জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন সাদেকা হালিম বলেন, 'আমরা জরিপ করে দেখেছি, নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ৩৫-৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না।'

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য এম মাকসুদ কামাল বলেন, শিক্ষার্থীদের সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ দিতে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সঙ্গে তাদের আলোচনা চলছে।

পর্যাপ্ত আয়োজন ও সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করে অনলাইন ক্লাস চালিয়ে গেলে শিক্ষাক্ষেত্রে 'বৈষম্য বাড়বে' বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

তিনি বলেন, 'যেহেতু অনলাইনে ক্লাস নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে ক্লাস নেওয়া দরকার।' বিডিনিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<107728 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1