বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি

যাযাদি ডেস্ক
  ০৬ আগস্ট ২০২০, ০০:০০
তৃতীয় দফায় বন্যার পানি কমতে থাকলেও এখনো অধিকাংশ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ছবিটি বুধবার জামালপুরের মেলান্দহ থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা

সারাদেশে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া বন্যামুক্ত হয়েছে। বর্তমানে বন্যা আক্রান্ত জেলা ১৬টি। দুই নদীর পানিও গত ২৪ ঘণ্টায় বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। বর্তমানে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ১৫টি নদীর পানি। আর তিনটি স্টেশনের পানিও বিপৎসীমার নিচে নেমে গেছে। বর্তমানে ২৪টি স্টেশনের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে আগামী ২৪ ঘণ্টায় বন্যা-আক্রান্ত সবগুলো জেলারই উন্নতি হতে পারে। বন্যা-পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বুধবার জানিয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নওগাঁ, নাটোর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হতে পারে। এ ছাড়া ঢাকা সিটি করপোরেশন-সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হতে পারে। বুধবার পূর্বাভাসে আরও বলা হয়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি কমছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে। অপরদিকে পদ্মা নদীর পানি কমছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উজানে মেঘনা অববাহিকায় প্রধান নদীর পানি কমছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। রাজধানীর আশপাশের নদীগুলোর পানি স্থিতিশীল রয়েছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের পর্যবেক্ষণাধীন ১০১টি পানি স্টেশনের মধ্যে বাড়ছে ৩৫টিতে, কমছে ৬২টিতে এবং অপরিবর্তিত রয়েছে চারটিতে। আমাদের পাবনা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, পাবনায় কমতে শুরু করেছে যমুনা নদীর পানি, বাড়ছে পদ্মা নদীর পানি। দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোফাজ্জল হোসেন জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর পানি তিন সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৯৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বেড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হামিদ জানান, গত দুইদিন যমুনা নদীর পানি স্থিতিশীল থাকলে বুধবার সকালে নগরবাড়ির মথুরা পয়েন্টে ২৬ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাউবো-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। জরুরিভিত্তিতে ভাঙন প্রতিরোধে কাজ করা হচ্ছে। এদিকে জেলার বন্যাকবলিত উপজেলায় বেশ কয়েকটি স্কুলের সামনে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কাঁচা-পাকা রাস্তা ভেঙে ও নষ্ট হয়ে গেছে। বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন সামাজিক এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পাশে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আলী মর্তুজা বিশ্বাস সনি ও যুগ্ম আহ্বায়ক শিবলী সাদিকের উদ্যোগে বন্যাদুর্গতদের কোরবানির মাংসসহ খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। বন্যার পানিতে নদীভাঙনকবলিতদের খোঁজখবর নেয়া, সহায়তা প্রদান এবং সশরীরে গিয়ে দেখা-সাক্ষাৎ করছেন পাবনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবিরসহ বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিরা। চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, নদীভাঙনে বিলীন হয়েছে কুড়িগ্রাম চিলমারী উপজেলার চরাঞ্চলের ১৭ শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি। তছনছ হয়েছে উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন অষ্টমির চর, চিলমারী ও নয়ারহাটের বিভিন্ন গ্রাম। দুই-তিন সপ্তাহ আগে যেখানে ছিল গ্রাম, গাছ-গাছালি, মসজিদ, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এখন সেখানে ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তাল ঢেউ। দিশাহারা মানুষ বসতভিটা, জমিজমা হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছে উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ও অন্যের জায়গায়। জানা গেছে, অষ্টমির চর ইউনিয়নে মাঝবাড়ি, ভাসানপাড়া, খর্দবাঁশপাতার, খর্দবাঁশপাতার দক্ষিণপাড়া, খর্দবাঁশপাতার পূর্বপাড়া, নাওশালা খারুভাঁজ পশ্চিমপাড়ার প্রায় ৭২৬টি পরিবারের ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। এ ছাড়া আটটি মসজিদ, নটারকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নটারকান্দি বাজার নদীতে বিলীন হয়েছে। চিলমারী ইউনিয়নের পশ্চিম মনতলা, পশ্চিম গাজীরপাড়া, কড়াইবরিশালের ঘাট থেকে শাখাহাতির ঘাট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার চার শতাধিক ঘরবাড়িসহ একটি প্রাইমারি স্কুল ও একটি মসজিদ নদীতে বিলীন হয়েছে। নয়ারহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ খাউরিয়ার চর, উত্তর খাউরিয়ার চর, চর খেদাইমারী, দক্ষিণ ফেইচকা, ২০০ বিঘা ও খেরুয়ার চরের প্রায় ৬২০ পরিবারের বাড়িঘরসহ তিনটি ইউনিয়নের মোট ১৭ শতাধিক পরিবারের বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। নয়ারহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু হানিফা বলেন, কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে তার ইউনিয়নের ছয় শতাধিক পরিবার নদীতে সর্বস্ব হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। এসব পরিবারের লোকজন বর্তমানে আশ্রয়নকেন্দ্র, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়ে কোনো রকমে দিনাতিপাত করছে। অষ্টমির চর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু তালেব ফকির বলেন, মাত্র দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যেই নদীভাঙনে বিলীন হয়ে গেল সাত-আটটি গ্রামের সাত শতাধিক পরিবার। বর্তমানে নদীতে পানি কমতে থাকলেও ভাঙন অব্যাহত রয়েছে চর মুদাফৎ কালিকাপুর, মুদাফৎ কালিকাপুর ও নটারকান্দি গ্রাম। হুমকির মুখে রয়েছে নটারকান্দি দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়, খর্দ বাঁশপাতার হাফিজিয়া মাদ্রাসাসহ বেশ কিছু মসজিদ। মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ভারী বর্ষণে পদ্মা-যমুনা নদীর পানি বাড়ায় মানিকগঞ্জের নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। ফলে শিবালয়, দৌলতপুর, ঘিওর, হরিরামপুর, সাটুরিয়া ও জেলা সদর উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। এদিকে বন্যাকবলিত এলাকায় পানি কমলেও এখনো দুর্ভোগ কমেনি। বুধবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, আগস্ট মাসের শুরু থেকেই পদ্মা ও যমুনা নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। ফলে মানিকগঞ্জ জেলাবাসীর মনে স্বস্তি ফিরেছে। কিন্তু বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে এখনো দুর্ভোগ কমেনি। অধিকাংশ নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের মানুষের বসতবাড়ি এখনো পানির নিচে ডুবে আছে। ফলে তারা দূরের আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। কোথাও কোথাও রাস্তা-ঘাট ভেঙে গেছে। হরিরামপুরের বালস্না এলাকার বাসিন্দা মজনু মিয়া বলেন, আমার বাড়িতে কোমর পর্যন্ত পানি উঠেছিল। এখন পানি নামতে শুরু করেছে। পানি নামলেও রাস্তায় এখনো হাঁটু পানি রয়েছে। ফলে কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। এলাকাবাসীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে বন্যার পানি মাড়িয়ে বাজারের আসতে হচ্ছে। ফলে তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত ও ঠান্ডাজনিত রোগ। দৌলতপুরের চরকাটারির আলফাজ বলেন, এখনো বাড়ি থেকে পানি নামেনি। শুনেছি, যমুনার পানি কমতে শুরু করেছে। এখন তো আশ্রয়কেন্দ্রে আছি। এলাকায় বন্যার পানি কমলেই বাড়ি যাব। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫৫ লাখ মানুষ সাম্প্রতিক অতিবর্ষণজনিত কারণে সৃষ্ট বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৫ লাখ ৬৩ হাজার ৭৭৭ জন। বন্যায় দেশের ৩৩টি জেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে মানবিক সহায়তা হিসেবে বিতরণের জন্য এ পর্যন্ত ১৬ হাজার ৪১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ১০ হাজার ৪৮ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে বলে জানায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বন্যাকবলিত জেলা প্রশাসন থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নগদ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে চার কোটি ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং এ পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে দুই কোটি ৪২ লাখ ৭১ হাজার ২০০ টাকা। শিশুখাদ্য সহায়ক হিসাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা এবং এ পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে ৬৭ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। গো-খাদ্য ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দুই কোটি ৮৬ লাখ টাকা এবং বিতরণের পরিমাণ এক কোটি ৪৮ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। শুকনো ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এক লাখ ৬২ হাজার এবং এ পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে এক লাখ ১৯ হাজার ৭৫৬ প্যাকেট। এ ছাড়াও ঢেউটিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩০০ বান্ডিল এবং এ পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে ১০০ বান্ডিল, গৃহ মঞ্জুরি বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯ লাখ টাকা এবং বিতরণ করা হয়েছে তিন লাখ টাকা। বন্যাকবলিত উপজেলার সংখ্যা ১৬২টি এবং ইউনিয়নের সংখ্যা এক হাজার ৫৮টি। পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ৯ লাখ ৯৬ হাজার ৯৮০টি এবং ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৫ লাখ ৬৩ হাজার ৭৭৭ জন। বন্যায় এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৪১ জন। বন্যাকবলিত জেলাগুলোর আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এক হাজার ৫৬৭টি। আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত লোক সংখ্যা ৭৭ হাজার ৫২ জন। আশ্রয়কেন্দ্রে আনা গবাদিপশুর সংখ্যা ৭৪ হাজার। বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে ৯৮১টি এবং এখন চালু আছে ৪০৯টি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে