শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র

পাঁচ কর্মকর্তার নেতৃত্বে চলে পৈশাচিক নির্যাতন

যশোর প্রতিনিধি
  ১৬ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঁচ কর্মকর্তার নেতৃত্বে কিশোর বন্দিদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়। তাদের নির্যাতনে তিন কিশোর নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছে। পুলিশ ওই পাঁচ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে। এছাড়া নির্যাতনে অংশ নেয়া কর্মকর্তাদের অনুগত সাত-আট কিশোর বন্দি। 'চুল কাটা নিয়ে বিরোধের সূত্র ধরে' মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওই নির্যাতন করা হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার (১৩ আগস্ট) যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে হতাহতের ঘটনায় পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শনিবার (১৫ আগস্ট) দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান যশোরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন।

গ্রেপ্তাররা হলেন- যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারী পরিচালক আব্দুলস্নাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক প্রবেশন অফিসার মাসুম বিলস্নাহ, কারিগরি প্রশিক্ষক ওমর ফারুক, ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর একেএম শাহানুর আলম ও সাইকো সোশ্যাল কাউন্সিলর মুশফিকুর রহমান। শুক্রবার (১৪ আগস্ট) ওই কেন্দ্রের ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হেফাজতে নেয়ার পর মামলা হলে রাতে এই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন জানান, ঘটনার সূত্রপাত ৩ আগস্ট। এদিন কিশোর বন্দি হৃদয়কে (চুল কাটায় পারদর্শী) চুল কেটে দিতে বলেন কেন্দ্রের নিরাপত্তাপ্রধান (হেড গার্ড) নূর ইসলাম। ঈদের আগে প্রায় দুশ বন্দির চুল কাটায় হৃদয় তার হাত ব্যথা উলেস্নখ করে চুল কাটতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নূর ইসলাম কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুলস্নাহ আল মাসুদ ও সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিলস্নাহর কাছে অভিযোগ করেন, 'ওরা ট্যাবলেট খেয়ে নেশাগ্রস্ত

\হহয়ে রয়েছে।' এছাড়া তিনি হৃদয় ও তার বন্ধু পাভেলের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্কের ইঙ্গিত করেন। সেখানে উপস্থিত কিশোর নাঈম অভিযোগ শুনে বিষয়টি পাভেলকে জানিয়ে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাভেল তার কিছু অনুসারী কিশোরকে নিয়ে নূর ইসলামকে মারপিট করে। এতে তার হাত ভেঙে যায়। এ ঘটনার সূত্র ধরেই ১৩ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।

কী ঘটেছিল ১৩ আগস্ট?: জাতীয় শোক দিবস পালন উপলক্ষে ১৩ আগস্ট যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ১৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় 'নূর ইসলামের ওপর হামলাকারীদের শাস্তি প্রদানের' সিদ্ধাস্ত হয়। সভার সিদ্ধাস্ত অনুযায়ী শনাক্ত হামলাকারী ১৩ জনসহ আরও কয়েকজনকে বের করে আনা হয়। ওই পাঁচ কর্মকর্তার নেতৃত্বে কয়েকজন কর্মচারী এবং কর্মকর্তার আজ্ঞাবহ সাত-আটজন কিশোর বন্দি 'অভিযুক্তদের' মারপিট শুরু করেন। এ সময় তাদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়।

মুখে গামছা ঢুকিয়ে জানালা দিয়ে হাত বাইরে বের করে টেনে ধরে পেছন থেকে বেধড়ক মারপিট করা হয়। লোহার রড, ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে বেপরোয়া মারপিট করা হয়। অচেতন হলে মার বন্ধ করা হয়। ফের জ্ঞান ফিরলে মারপিট করা হয়। পালাক্রমে এভাবে মারপিটের পর গুরুতর জখম অবস্থায় এদের একটি ঘরে ফেলে রাখা হয়। একজন 'কম্পাউন্ডার' দিয়ে সামান্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও এদের হাসপাতালে না পাঠিয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টা ফেলে রাখা হয়।

সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মৃতপ্রায় অবস্থায় একজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতাল থেকে তার মৃতু্যর খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জনসহ কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে দেখতে পান নির্যাতনের শিকারদের দুপুরে খাবার ও চিকিৎসা না দিয়ে গরমের মধ্যে গাদাগাদি অবস্থায় ফেলা রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে আরও দুজনকে হাসপাতালে পাঠানো হলে তারাও মারা যায়। পরে অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের পিকআপে ১৪ জনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরদিন আরও একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এনিয়ে এই মর্মান্তিক ঘটনায় তিনজন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়।

নিহতরা হলো- বগুড়ার শিবগঞ্জের তালিবপুর পূর্বপাড়ার নান্নু প্রামাণিকের ছেলে নাঈম হোসেন (১৭), একই জেলার শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামের আলহাজ নুরুল ইসলাম নুরুর ছেলে রাসেল ওরফে সুজন (১৮) এবং খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮)। নিহত রাব্বির রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ১১৮৫৩। রাসেল ও নাঈমের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার যথাক্রমে ৭৫২৪ ও ১১৯০৭। নাঈম হোসেন ধর্ষণ এবং রাব্বি হত্যা মামলার আসামি ছিল।

পরবর্তী পদক্ষেপ: ঘটনার পর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা দু'পক্ষের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা বললেও পরবর্তীতে আহত কিশোর বন্দিদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রকৃত ঘটনা বের হয়ে আসতে শুরু করে। পুলিশ দ্রম্নত তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে কেন্দ্রের ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেয়।

১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় হত্যাকান্ডের ঘটনায় যশোর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন নিহত পারভেজ হাসান রাব্বির বাবা খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়া। মামলায় শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে বিবাদী করা হয়। মামলার পর পুলিশ হেফাজতে নেয়া ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।

এদিকে শুক্রবারই বন্দি তিন কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনায় কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুলস্নাহ আল মাসুদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পাশাপাশি গঠন করা হয় দুটি তদন্ত কমিটি।

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন জানান, তদন্ত কমিটির পাশাপাশি পুলিশও মামলার তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। মিটিংয়ে থাকা ১৯ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জড়িত হিসেবে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত হওয়ায় পাঁচ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড আবেদন করা হবে। এছাড়া জড়িত সাত-আট কিশোর বন্দিকে এই মামলায় আইনের আওতায় আনতে আদালতে আবেদন করা হবে।

পুলিশ সুপার উলেস্নখ করেন, তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঘটনার বিশ্লেষণ করে সতর্কতার সঙ্গে মামলার তদন্ত কাজ পরিচালনা করছেন। যাতে প্রকৃত চিত্র ও প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে আদালতে উপস্থাপন করতে পারেন।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. তৌহিদুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম রাব্বানী, যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি মনিরুজ্জামান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<108972 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1