শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইতালির লোভ দেখিয়ে কোটি টাকার মুক্তিপণের ফঁাদ

যাযাদি ডেস্ক
  ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
লিবিয়া ফেরত চার তরুণ

ভৈরবের শতাধিক যুবককে ইতালি পাঠানোর কথা বলে লিবিয়ায় আটকে রেখে কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করছে প্রতারক চক্র। পরিবারগুলো সহায় সম্বল বিক্রি করে তাদের সন্তানদের মুক্তিপণের টাকা দিয়ে প্রতারক দলের জিম্মি থেকে ফিরিয়ে আনছে। এখনও প্রায় অধর্শত যুবক লিবিয়ায় প্রতারকের হাতে জিম্মি আছে বলে একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বাড়ি থেকে মুক্তিপণের টাকা এনে দিতে লিবিয়ায় আটকদের ওপর চলছে অমানবিক নিযার্তন। অনেক পরিবারের সন্তানরা কোথায় আছে তারও খেঁাজ মিলছে না।

জানা গেছে, ভৈরবের আদম দালাল মিলন ও সোহাগ এসব অসহায় যুবককে লিবিয়া দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি পাঠাবে বলে লোভ দেখিয়ে প্রতারণার ফঁাদে ফেলে শতাধিক যুবকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করেছে বলে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছে।

উপজেলার রঘনাথপুর এলাকার মস্তো মিয়ার ছেলে ইমরান হোসেন (২০) ও শাহ আলমের ছেলে মো. আলী লোভে পড়ে দু’জনে ৮ লাখ টাকা দালাল মিলনকে দিয়ে লিবিয়া যান এবং পরে তাদের জিম্মি করে আরও ৪ লাখ টাকা দালালকে দেয়। কিন্ত ৮ মাস হয়ে গেছে এখনও দু’জনকে ইতালি পাঠাতে পারেনি।

গত ৪ মাস যাবত তাদের কোনো খেঁাজ মেলেনি। কান্নায় ভেঙে পড়েছে পরিবারগুলো। যেন দেখার কেউ নেই। ইমরানের মা ফিরুজা বেগম এই প্রতিনিধিকে জানান, বাড়িঘর বিক্রি করে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিলাম সুখের আশায়, ছেলে এখন নিখেঁাজ।

জানা গেছে, ইতালি যাওয়ার লোভে ভৈরবের সম্ভুপুর, রঘনাথপুর, জগনাথপুর, গোছামারা, মধ্যেরচর, পঞ্চবটিসহ কয়েকটি গ্রামের শতাধিক যুবক দালাল মিলন ও সোহাগের খপ্পরে পড়ে লিবিয়ায় যায়। এদের মধ্যে পিয়ার হোসেন, আকাশ, জুম্মন, শুভ হোসেন, বাদশা, শাওন, সালমান, মারুফ, সাঈদ, আসিফ ও তৌকির হোসেন দালাল চক্রের খপ্পরে লিবিয়ায় যাওয়ার পর মুক্তিপণের টাকা দিয়ে দেশে ফিরে এসেছে।

এরা প্রত্যেকেই ৩/৪ লাখ টাকা দিয়ে লিবিয়ায় যাওয়ার পর আবার ২/৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে দেশে ফিরে আসে বলে তাদের অভিযোগ। দেশে ফিরে আসা যুবক তৌকির জানান, ‘আমি প্রথমে ৪ লাখ টাকা দিয়ে লিবিয়ায় যাই। দালাল মিলন বলেছিল ইতালি পৌঁছানোর পর আরও ৪ লাখ টাকা তার বাবা দেবে। কিন্তু গত ৮ মাস আগে লিবিয়ায় পৌঁছানোর পরই আমাকে ভৈরবের দালাল সোহাগের কাছে বিক্রি করে দেয় মিলন। তারপর লিবিয়ার দালালচক্র আমাকে একটি গুদামে আটকে জিম্মি করে ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা দিতে অস্বীকার করলে তারা আমার ওপর শারীরিক নিযার্তন চালানো শুরু করে।’

তিনি জানান, ‘ইলেকট্রিক শক, লাঠি ও রড দিয়ে প্রতিদিন মারধর করত আমাকে। নিয়মিত খাবারও দিত না দালালরা। কয়েক মাস অধার্হারে অনাহারে দিন কাটিয়েছি। নিযার্তন সহ্য করতে না পেরে দেশে মা-বাবাকে ঘটনা জানাই। পরে আমার পরিবার ৪ লাখ টাকা লিবিয়ায় পাঠালে আমি জিম্মি থেকে উদ্ধার হয়ে দেশে ফিরে আসি।’

তিনি আরও জানান, লিবিয়ায় ভৈরবের আরও অধর্শত যুবককে দালালরা গুদামে জিম্মি করে আটকে রেখেছে। যারা মুক্তিপণের টাকা দিতে পারছে তারাই দেশে এসেছে এবং যারা টাকা না দিতে পারে তাদের দালালরা লিবিয়ায় আটক করে অমানুষিক নিযার্তন করছে বলে জানায় সে।

ভৈরবের রঘনাথপুর এলাকার শাহ আলম জানান, ‘আমার ছেলে মো. আলীকে ৩ লাখ টাকা দিয়ে লিবিয়ায় পাঠাই। পরে ছেলেকে জিম্মি করে আরও ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে দালাল চক্র। ছেলেকে নিযার্তন করায় আরও ২ লাখ টাকা দালালকে দিয়েছি কিন্তু তাকে ৮ মাসেও ইতালি পাঠায়নি। এখন আমার ছেলে কোথায় আছে তাও জানতে পারছি না।’

লিবিয়া থেকে ফেরত আসা শুভ হোসেনের মা পঞ্চবটি এলাকার ঝুমুর বেগম জানান, ‘আমি বিধবা নারী। চার সন্তান নিয়ে সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালাই। আমার স্বণার্লংকার বিক্রিসহ ধার-দেনা করে দালাল জুয়েলের কথায় ছেলেকে লিবিয়ায় পাঠিয়েছিলাম। সেখানে ছেলে পেঁৗছানোর পর দালাল শহীদ আরও দেড় লাখ টাকা দাবি করে। ছেলেকে জিম্মি করে নিযার্তন করার ভিডিও দেখালে আমি বাড়ি বিক্রি করে আরও দেড় লাখ টাকা দেয়ার পর ইতালিতে পাঠাতে সাগরের বোটে তোলে। পরে বোট ডুবে গেলে তাকে ইতালি না পাঠিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেয়।’

তিনি বলেন, ‘এখন আমি ভিটেহারা ও দিশেহারা হয়ে দালালকে খুঁজছি। ভৈরবে এমন আরও অসংখ্য পরিবার ও ভুক্তভোগী সুখের আশায় সন্তানদের অবৈধপথে ইতালি পাঠাতে গিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে পথে পথে ঘুরছে। ভুক্তভোগীরা দালালকে টাকা দেয়ার কোনো চুক্তি বা রশিদ নেয়নি। ফলে তারা কোনোরকম আইনি সহায়তাও নিতে পারছে না। অনেকেই বিচার পাওয়াসহ টাকা উদ্ধার করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার চেয়ারম্যান ও মেম্বারের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে কিন্তু কোনো ফল পাচ্ছে না।’

উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম জানান, ‘আমার এলাকার প্রায় অধর্শত যুবক ইতালি যেতে দালালের খপ্পরে পড়ে আজ নিঃস্ব হয়ে গেছে। অনেক পরিবার বাড়িঘর, স্বণার্লংকার বিক্রি ও ধার-দেনা করে এখন পথে পথে ঘুরছে ।’

শিমুলকান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জুবায়ের আলম দানিছ জানান, তার ইউনিয়নের গোছামারা গ্রামের ১৫/২০ জন একই ঘটনার শিকার হয়েছে। ভুক্তভোগীরা দালালদের টাকা দেয়ার কোনো রশিদ বা প্রমাণ না থাকায় বিচার করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

ভৈরবের দালাল মিলন মিয়া জানান, ‘আমি ঢাকা অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনেককে লিবিয়ায় পাঠিয়েছি। তাদের সঙ্গে কথা ছিল আমি লিবিয়া পাঠাব এবং পরে সোহাগ নামের দালাল তাদের সাগরপথে ইতালি পাঠাবে। সে যদি ইতালি না পাঠিয়ে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে তবে তার দোষ বলে জানান তিনি।’

ভৈরব উপজেলা নিবার্হী অফিসার ইসরাত সাদমীন জানান, ‘মানবপাচার বেআইনি। আমি বিষয়টি অবগত না, তবে কেউ অভিযোগ দিলে তা তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<33015 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1