শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মেলায় মানবতার জয়গান

এস এম মামুন হোসেন
  ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:১৩
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পছন্দের বই দেখছেন কয়েকজন পাঠক। ছবিটি সোহরাওয়াদীর্ উদ্যান থেকে তোলা Ñযাযাদি

‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে, আসে নাই কেহ অবনী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’ কবি কামিনী রায়ের মানবতার এ ডাক যেন প্রাণের গ্রন্থমেলাতে বাস্তব রূপ পেয়েছে। পয়লা ফেব্রæয়ারি থেকে শুরু হওয়া মেলায় এ ডাকে শামিল হয়েছে আত্মমানবতার সেবায় নিজেদের সপে দেয়া কিছু মহৎ হৃদয়ের মানুষ। কেউ চলতে অক্ষম মানুষদের হুইল চেয়ারে করে ঘুরে দেখাচ্ছেন পুরো মেলা, আবার কেউ স্বেচ্ছায় মানুষকে রক্ত দিতে উৎসাহিত করছেন অন্যদের। যে রক্ত দিয়ে বঁাচানো হবে দেশের অসহায় গরিব মানুষের জীবন। কিছু প্রতিষ্ঠান আবার কাজ করছে অন্ধদের আলোর পথ দেখাতে বা নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতের জন্য। মানবতার সংগ্রামে নিয়োজিত এসব মানুষের নেই কোনো পারিশ্রমিক। বরং নিজেদের পকেটের পয়সা খরচ করে অন্যের জীবন বঁাচাতে পারাই যেন একমাত্র তৃপ্তি। টিএসসির মোড় দিয়ে মেলায় ঢুকতেই প্রতিদিনই চোখে পড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ পড়–য়া কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে। যারা হুইল চেয়ার নিয়ে দঁাড়িয়ে আছেন। কোনো প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ বা হঁাটতে অক্ষম ব্যক্তি মেলায় এলেই তাদের দিকে ছুটে যান এসব তরুণ-তরুণী। পুরো মেলা ঘুরে দেখান কোনো ধরনের আথির্ক বা অন্য কোনো ধরনের সহায়তা বা বিনিময় ছাড়াই। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু মানুষের সেবা করার মানসিকতা থেকে তারা স্বেচ্ছায় এ কাজে এসেছেন। আর এ কাজে তাদের সহায়তা করছে বাংলা একাডেমি কতৃর্পক্ষ এবং সিএসএফ নামের একটি সংগঠন। সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠন সারা বছরই এ কাজ করে থাকে। তবে বইমেলা উপলক্ষে এ কাজে বাংলা একাডেমির সহায়তা আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। এবার বইমেলা উপলক্ষে ১৫টি হুইল চেয়ার কাজ করছে। প্রতিদিনই প্রায় ১০ থেকে ১৫ জন হুইল চেয়ার সেবা নিয়ে মেলায় ঘুরছেন। এবারের মেলায় হুইল চেয়ার সেবা প্রদানের কাজে প্রধান সমন্বয়কের কাজ করছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চতুথর্ বষের্র শিক্ষাথীর্ মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, ‘এখানে আমরা যারা কাজ করছি তারা সকলেই স্বেচ্ছায় এসেছি। অসহায় মানুষের জন্য কাজ করতে ভালো লাগা থেকেই আসা। আমরা মনে করি চলতে অক্ষম মানুষদেরও অধিকার আছে সবর্ত্র যাওয়ার। আর এ কাজে আমরা যারা সুস্থ একটু সহায়তা তাদের জীবনটাকেও সুন্দর করে তুলতে পারে।’ বইমেলার টিএসসিসংলগ্ন সোহরাওয়াদীর্ উদ্যান দিয়ে মেলায় প্রবেশের একটি গেট রয়েছে। এ গেট দিয়ে প্রবেশ করেই চোখে পড়ে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের কিছু কাযর্ক্রম। এখানে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির উদ্যোগে স্বেচ্ছায় রক্তদানের কমর্সূচি। এ ছাড়া মেলা থেকে বের হওয়ার গেটে রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ বøাড ব্যাংকের একটি কমর্সূচি। এসব বøাড ব্যাংকের সবমিলে এখন পযর্ন্ত দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়েছে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক শেখ মো. ফয়সাল তাদের কাযর্ক্রম সম্পকের্ যায়যায়দিনকে বলেন, ‘এটি একটি স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ। যারা রক্ত দেন তারা সম্পূণর্ স্বেচ্ছায় মানবতার সেবায় দিয়ে থাকেন। তবে আমাদের দেশের অনেক লোকের মধ্যে রক্ত দেয়ার বিষয়ে যথাযথ সচেতনতা নেই। এ জন্য আমরা কাজ করার চেষ্টা করছি।’ রক্তদানের পাশাপাশি রক্তের গ্রæপ পরীক্ষাও করছে এসব প্রতিষ্ঠান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের স্টলে সবচেয়ে বেশি মানুষ স্বেচ্ছায় রক্তের গ্রæপ পরীক্ষা করেছে। এখানকার দায়িত্বরত একজন ডাক্তার নাদিয়া শারমিন বলেন, ‘এটা একটি স্বেচ্ছা কাযর্ক্রম। আমাদের এখানে যারা আসে আমরা তাদের রক্তের গ্রæপ পরীক্ষার পাশাপাশি রক্ত দানের উপকারিতা সম্পকের্ও সচেতন করি।’ মেলা থেকে বের হওয়ার পথে পুলিশের বøাড ব্যাংকে গিয়ে জানা যায়, শুধু এখানেই এ পযর্ন্ত ছয়শ’র বেশি মানুষ স্বেচ্ছায় রক্ত প্রদান করেছেন। পুলিশ বøাড ব্যাংকের ইনচাজর্ এসআই একে এম সিদ্দিকুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, ‘মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। অনেকেই এখন স্বেচ্ছায় রক্ত দিচ্ছেন। আগে এতটা সচেতন ছিল না। ভবিষ্যতে এ সচেতনতা আরো বাড়বে বলে আশা করা যায়। আমাদের বøাডের পুরোটাই সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়।’ মেলার বাংলা একাডেমি থেকে বের হতেই চোখে পড়ে অন্ধদের জন্য কাজ করা প্রতিষ্ঠান স্পশর্ ব্রেইল প্রকাশনার একটি স্টল। এখানে অন্ধদের জন্যও যে বই আছে এবং তারাও যে সাধারণ মানুষের মতো পড়তে পারে সে বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করছেন কিছু মানুষ। এদেরই একজন সাজেদা সুলতানা মিম। তিনি তার পাশে বসা একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসের দ্বিতীয় বষের্র শিক্ষাথীর্ তৃষ্ণাকে দেখিয়ে বলেন, ‘এমন অনেকেই আমাদের সমাজে আছে। যারা উপযুক্ত সহায়তা পেলে দেশের সবোর্চ্চ বিদ্যাপিঠে উঠে আসার যোগ্যতা রাখে। আমাদের সকলেরই উচিত তাদের সহায়তায় কাজ করা।’ মেলার সোহরাওয়াদীর্ উদ্যান অংশে ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বাধীন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনে একটি স্টল রয়েছে। যারা মূলত কোনো বই বিক্রি করে না। বরং মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করছে তারা। নিসচার দপ্তর সম্পাদক ফিরোজ আলম মিলন যায়যায়দিনকে বলেন, ‘আমরা বই বিক্রি করতে আসিনি। আমাদের উদ্দেশ্য মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা। মেলায় যেহেতু মানুষের ব্যাপক সমাগম ঘটে। সেহেতু আমরা এখানে এসেছি সাধারণ মানুষের নিরাপদ সড়কের প্রয়োজনীয়তা এবং এ লক্ষ্যে করণীয় সম্পকের্ সচেতন করতে।’ নতুন বই : অমর একুশে গ্রন্থমেলার গতকাল ছিল একাদশতম দিন। এ দিন মেলায় নতুন বই এসেছে ১২৮টি। এর মধ্যে মধ্যে গল্প ২১টি, উপন্যাস ১৬টি, প্রব›দ্ধ ১০টি, কবিতা ৪৯টি, ছড়া ২টি, শিশুসাহিত্য ১টি, জীবনী ৪টি, রচনাবলি ১টি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ২টি, নাটক ১টি, বিজ্ঞানবিষয়ক ৪টি, ভ্রমণ ৩টি, ইতিহাসবিষয়ক ৫টি, রাজনীতি ১টি, স্বাস্থ্য ১টি, সায়েন্স ফিকশন ২টি এবং অন্যান্য ৫টি। উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে বিশ^সাহিত্য ভবন থেকে জি এম ফরিদের ছোট গল্প কুহকের দিনরাত্রি, সময় প্রকাশন থেকে পিয়াস মজিদের স্মৃতিকথা নিজর্ন নোটবুক, চিলড্রেন বুক কালেকশন থেকে আনিসুল হকের গুড্ডু বুড়ার নতুন বোকামি তারপর, সময় প্রকাশনী থেকে সৈয়দ শামসুল হকের নাটক ফজল শেখের শেষ ম্যাজিক ও অন্যান্য, কথাপ্রকাশ থেকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধ গণতন্ত্রের অভিমুখে। লেখক বলছি কনার্র : প্রথমবারের মতো এ বছর ভালো মানের পঁাচজন লেখককে ২০ মিনিট করে নিজের বই নিয়ে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে মেলা আয়োজক কতৃর্পক্ষ। সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানের লেকপাড়ে ‘লেখক বলছি’ কনাের্রর এ আয়োজনে গতকাল সোমবার নিজেদের সাহিত্যকমর্ বিষয়ে আলাপনে অংশ নেন হোসেন উদ্দীন হোসেন, হাবিব আনিসুর রহমান, ড. তাশরিক-ই-হাবিব, মশিউল আলম এবং শিহাব শাহরিয়ার। মোড়ক উন্মোচন : গত বছরের মতো এবারও মেলায় রয়েছে মোড়ক উন্মোচন কনার্র। প্রতিদিনই অনেক বই এলেও মোড়ক উন্মোচন করান গুটিকয়েক লেখক। তবে যারা এ কনাের্র এসে মোড়ক উন্মোচন করাচ্ছেন তাদের বক্তব্য শুনে অনেক পাঠক আগ্রহী হচ্ছেন সে সব বই কিনতে। আর এ কারণে মোড়ক উন্মোচনের আলাদা একটা গুরুত্ব রয়েছে। গতকাল সোমবার ৯টিসহ এখন পযর্ন্ত মোট ১৬০টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। মূল মঞ্চের আয়োজন : গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘নৃত্যাচাযর্ বুলবুল চৌধুরী : জন্মশতবষর্ শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শীষর্ক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অনুপম হায়াৎ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আমানুল হক, লুভা নাহিদ চৌধুরী এবং শিবলী মহম্মদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কামাল লোহানী। কামাল লোহানী বলেন, বুলবুল চৌধুরী নৃত্যের পাশাপাশি প্রাচী নামের উপন্যাস লিখে বাংলা সাহিত্যে যোগ করেছেন নতুন মাত্রা। তার নৃত্য কেবল প্রায়োগিক শিল্পকলা নয়, একই সঙ্গে সমস্ত অসুন্দর এবং কলুষতার বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদের নাম। এছাড়া কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন গোলাম কিবরিয়া পিনু এবং চঞ্চল আশরাফ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন গোলাম সারোয়ার এবং মু. আহসান উল্লাহ ইমাম খান তমাল। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী চন্দনা মজুমদার, শফিমÐল, সেলিম চৌধুরী, পাগলা বাবুল, রুশিয়া খানম এবং কোহিনুর আকতার গোলাপী। আজকের আয়োজন : অমর একুশে গ্রন্থমেলার আজ ১২তম দিন। মেলা শুরু হবে বেলা ৩টায় এবং শেষ হবে রাত ৯টায়। বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে কবি-অনুবাদক মনিরউদ্দীন ইউসুফ : জন্মশতবষর্ শ্রদ্ধাঞ্জলি শীষর্ক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন হাসান হাফিজ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন শফিউল আলম, রেজাউদ্দিন স্টালিন এবং মোহাম্মদ আবদুল হাই। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, কবিতা আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে