বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আদিবাসীদের বইয়ে আগ্রহ বাড়ছে বাঙালিদের

এস এম মামুন হোসেন
  ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:১৩
অমর একুশে গ্রন্থমেলার একটি স্টলে পছন্দের বই দেখছেন কয়েকজন তরুণী -যাযাদি

দেশের আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের নিয়ে লেখা বইয়ের প্রতি বাঙালিদের আগ্রহ বাড়ছে। প্রতি বছরই বইমেলায় আদিবাসীদের নিয়ে লেখা বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সে তুলনায় আদিবাসী লেখক-সাহিত্যিক উঠে আসছে না বলেও জানা গেছে। সরকার এরই মধ্যে পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে সরবরাহের যে উদ্যোগ নিয়েছে তাকে স্বাগত জানিয়ে এসব সম্প্রদায়ের মানুষরা বলছেন, সাহিত্যজগতেও মূলধারায় উঠে আসতে রাষ্ট্রীয় সহায়তা প্রত্যাশা করেন তারা। একই সঙ্গে ফেব্রম্নয়ারির বইমেলায় নিজেদের সাহিত্য তুলে ধরতে বাংলা একাডেমির সুদৃষ্টিও চান বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায় থেকে উঠে আসা এসব সম্প্রদায়ের লেখক-প্রকাশকরা। বইমেলা ঘুরে দেখা গেছে, এবারের মেলায় প্রায় আট শতাধিক স্টল থাকলেও দেশের আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোক দ্বারা পরিচালিত মাত্র একটি প্রকাশনা ও একটি লিটলম্যাগ মেলায় এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ মানুষ এসব সম্প্রদায়ের। সে অর্থে তাদের কমপক্ষে আটটি স্টল থাকা উচিত ছিল মেলায়। কিন্তু সেখানে মাত্র একটি স্টল থাকাটাকে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা হিসেবে উলেস্নখ করছেন বিশিষ্টজনেরা। তাদের ভাষায়, সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সব সম্প্রদয়ের মানুষকে সমানভাবে জাতীয় পর্যায়ে তুলে আনার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায়। রাষ্ট্র এরই মধ্যে সে লক্ষ্যে পাঁচটি ভাষার বই স্ব-স্ব জাতির ভাষায় প্রকাশ করে তা পাঠ্যবইয়ে সংযোজন করেছে। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক। এখন সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতেও এসব সম্প্রদায়ের মানুষকে তুলে আনতে উদ্যোগী হতে হবে। মেলা ঘুরে দেখা গেছে, বাংলাদেশের আদিবাসী এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বিষয়ে পড়াশোনা করতে বাঙালিদের মধ্যে বিপুল আগ্রহ রয়েছে। তবে ভালো মানের লেখা বই কমই বাজারে আছে বলে অভিযোগ করেছেন বাঙালি পাঠকরা। তাদের অনেকের ভাষায়, বিদেশিদের বিষয়ে পড়াশোনা করলেও নিজেদের দেশের ভিন্ন জাতির মানুষের সম্পর্কে জানাশোনা কমই আছে এ দেশের মানুষের মধ্যে। ভালো মানের বই না থাকাকে এর কারণ হিসেবে উলেস্নখ করছেন তারা। এবারের মেলায় নৃগোষ্ঠীদের ওপর লেখা বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলছে আইয়ুব হোসেনের 'মুক্তিযুদ্ধে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী', মুস্তফা মজিদের 'আদিবাসী সংস্কৃতি', মাযহারুল ইসলাম তরুর 'আদিবাসী লোকজীবন'। এর বাইরে আদিবাসী লেখকদের জনপ্রিয় বইয়ের মধ্যে রয়েছে জেমস জর্নেশ চিরানের 'প্রান্তিক সমাজের কথা', মিঠুন রাকসামের 'মান্দি জাতির পানীয় ও খাদ্যবৈচিত্র্য', এল বীরমঙ্গল সিংহর 'মণিপুরি লোককাহিনি', রূপসী চাকমার 'নিঃশেষে আবেগ', এ কে শেরামের 'টোকাই কাহিনি ও অন্যান্য গল্প', নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরার 'দূরদেশে' ইত্যাদি। মেলায় আগত একজন পাঠক হালিমা আনসারী যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমি 'মুক্তিযুদ্ধে নৃতাত্ত্ব্বিক জনগোষ্ঠী' বইটি কিনেছি। এ বইটিকে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। কারণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশে বসবাসরত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ভূমিকা কী ছিল তা আমাদের জানা উচিত। আমরা বিদেশি সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কতইনা মাতামাতি করি। কিন্তু নিজেদের দেশেও যে ভিন্ন ভাষার মানুষ আছে, তাদের নিজস্ব কৃষ্টি কালচার আছে সে সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হই না। আমাদের জন্য বিদেশিদের জানার চেয়ে নিজেদের মানুষকে চেনাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমাদের মধ্যকার সৌহার্দ্যকে বৃদ্ধি করবে। তবে আমি লক্ষ করছি এসব ভাষার লেখকদের লেখা ভালো মানের বই কম। এজন্য আমি যেটি কিনেছি সেটি মূলত বাঙালির লেখা বই। এরপরও এটি থেকে তাদের সম্পর্কে জানতে পারব। এজন্যই কিনেছি।' এবারের বইমেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের লোক দ্বারা পরিচালিত একমাত্র প্রকাশনা তিউড়ি প্রকাশনার প্রকাশক ও লেখক মাইবর সাধন যায়যায়দিনকে বলেন, 'বর্তমান সরকার মোট পাঁচটি ভাষার নিজস্ব বর্ণমালায় বই প্রকাশ করে তা বিনামূল্যে সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। এটাকে আমরা খুবই ইতিবাচকভাবে নিয়েছি। আমরা সরকারের কাছে প্রত্যাশা করব সাহিত্য, সংস্কৃতির অন্যান্য শাখায়ও ভিন্ন ভাষার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে রাজধানীসহ সারা দেশে উঠে আসতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাব আমরা।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি চাকরিতে মাত্র যোগদান করেছেন রাঙামাটি থেকে উঠে আসা চমক দেওয়ান। জাতিতে চাকমা এ তরুণ যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমি বাংলা ভাষাকে অনেক ভালোবাসি। পাশাপাশি নিজের ভাষার জন্যও কাজ করতে চাই। সরকার আমাদের ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করেছে। এটা সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। আমরা বিশ্বাস করি সরকারের সহায়তা পেলে আমাদের ভাষাতেও অনেক ভালো মানের সাহিত্য গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এজন্য আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি ব্যক্তিগত জায়গা থেকে আমরাও কাজ করতে চাই। আমরা নিজেরাও বাংলা সাহিত্য পড়ি। আবার যখন দেখি বাঙালিরা আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির বিষয়ে পড়াশোনা করে সেটা দেখে আমাদেরও ভালো লাগে। এটা বাঙালিদের সঙ্গে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকদের সুসম্পর্কের অংশ।' অমর একুশে গ্রন্থমেলায় নতুন বই অমর একুশে গ্রন্থমেলার গতকাল ছিল ১৮তম দিন। এদিন মেলায় নতুন বই এসেছে ১৩৯টি। এর মধ্যে গল্প ২৫টি, উপন্যাস ১৯টি, প্রবন্ধ ৫টি, কবিতা ৪৭টি, গবেষণা ২টি, ছড়া ১টি, শিশুসাহিত্য ৫টি, জীবনী ৩টি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ১টি, নাটক ১টি, বিজ্ঞান ৪টি, ভ্রমণ ১টি, ইতিহাস ৩টি, স্বাস্থ্য ১টি, রম্য ৩টি, ধর্মীয় ২টি, সায়েন্স ফিকশন ১টি এবং অন্যান্য ১৪টি। উলেস্নখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্য প্রকাশ থেকে মুনিয়া মাহমুদের গল্পগ্রন্থ 'বৈশাখী মেঘের কান্না', বাডস থেকে রাজিয়া মজিদের শিশুতোষ 'সিন্দাবাদের গল্প', আহমদ পাবলিশিং হাউজ থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোশাররফ হোসেনের আত্মজীবনী 'জীবনের খন্ড চিত্র', আগামী প্রকাশনী থেকে হাসনাত আবদুল হাইয়ের শিল্পকলা বিষয়ক গ্রন্থ 'শিল্পকলার নান্দনিকতা', রাবেয়া বুক হাউজ থেকে আলী ইমামের গল্পগ্রন্থ 'নির্বাচিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প' ও সেলিনা হোসেনের 'মেয়রের গাড়ি', কথাপ্রকাশ থেকে মুস্তাফিজ শফির কিশোর উপন্যাস 'ভূতকল্যাণ সমিতি', জোনাকী প্রকাশনী থেকে সৌমিত্র শেখরের 'একুশের সংকলন পরিচিতি ও গুরুত্ব'। মূলমঞ্চের অনুষ্ঠান মঙ্গলবার ছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৮তম দিন। এদিন মেলা শুরু হয় বেলা ৩টা থেকে এবং শেষ হয় রাত ৯টায়। বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় কবি বেলাল চৌধুরী : শ্রদ্ধাঞ্জলি শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি পিয়াস মজিদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কবি জাহিদুল হক, দিলারা হাফিজ এবং তারিক সুজাত। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কবি রবিউল হুসাইন। শিশু-কিশোর চিত্র প্রদর্শনী অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রতি বছর শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। এ বছর প্রথমবারের মতো ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শিশু-কিশোরদের পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবিগুলো নিয়ে বাংলা একাডেমির ড. মুহম্মদ এনামুল হক ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টায় প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুলস্নাহ সিরাজী। প্রদর্শনী চলবে ২৮ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত। লেখক বলছি কর্নার লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন প্রকাশিত গ্রন্থ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন মুস্তাফিজ শফি, শোয়াইব জিবরান, মুহাম্মদ শামসুল হক, মলয় বালা। কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন কবি দিলারা হাফিজ, রেজাউদ্দিন স্টালিন, ফরিদ আহমেদ দুলাল, রহিমা আখতার কল্পনা এবং মতিন রায়হান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ইকবাল খোরশেদ এবং সায়েরা হাবীব। পুঁথিপাঠ করেন জালাল খান ইউসুফী। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল সাইমন জাকারিয়ার পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন 'ভাবনগর ফাউন্ডেশন'-এর পরিবেশনা। এছাড়া সায়িক সিদ্দিকীর পরিচালনায় পরিবেশিত হয় পালাগান 'নোলকজানের পালা'। আজকের অনুষ্ঠানসূচি মেলা চলবে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সুজন বড়ুয়া। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন আলম তালুকদার, আসলাম সানী, লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম এবং আনজীর লিটন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, কবিতা-আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে