শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মেলায় চকবাজারের প্রভাব

এস এম মামুন হোসেন
  ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
বৃহস্পতিবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয় -যাযাদি

আজ থেকে ৬৭ বছর আগে বসন্তের একটি দিন। ফাগুনের মাতাল হাওয়ায় আমের মুকুল আর কচি সবুজ পাতার মাঝে কোকিলের গান হৃদয়ে এঁকেছিল ভালোবাসার আল্পনা। কিন্তু হঠাৎ থেমে যায় কোকিলের গান। কোচি পাতা আর আমের মুকুলের সুভাষ ঢেকে যায় বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধে। মুহূর্তের মধ্যে পিচঢালা রাস্তা রক্তে লাল হয়ে যায়। দিনটি ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'-এ স্স্নোগানে ছাত্র-জনতা এক হয়েছিল তৎকালীন ঢাকা মেডিকেলের আমতলায়। আর সেখানেই পাকিস্তানি পুলিশের বুলেটের আঘাতে শহীদ হন বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। জাতির সে শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মান জানাতে তাই বৃহস্পতিবার দেশজুড়ে পালিত হয়েছে হাজারো কর্মসূচি। তারই অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ভাষা শহীদদের স্মরণে লাখো জনতা এসেছিলেন বই মেলাতে।

গতকাল বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দীর এ বই মেলাতে বিপুল লোক সমাগম হলেও বুধবার রাতে রাজধানীর পুরান ঢাকায় বহুতল ভবনে আগুন লেগে যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে তার প্রভাব ছিল। মানুষের মধ্যে উদ্দাম ছিল কম। অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহীদদের স্মরণে মেলায় আসলেও চকবাজারের ঘটনা তাদেরকে ব্যথিত করেছে। আর এ কারণে বেশি ঘোরাঘুরিও করেননি অনেকে। প্রকাশক ও বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে লোক সমাগমও এবারের মেলায় অন্যবারের তুলনায় বেশ কম হয়েছে। আর এর কারণ হিসেবে তারা পুরান ঢাকার ট্র্যাজেডির কথাই উলেস্নখ করেছেন।

বুধবার মধ্যরাত থেকেই শহীদ মিনাওে শহীদদের সম্মান জানাতে নামে মানুষের ঢল। সকালে এ ঢল আছড়ে পড়ে বইমেলা প্রাঙ্গণে। আর ভাষা শহীদদের স্মরণে বিশ্বব্যাপী পালিত এ দিনটি। এ দিনে বইপ্রেমীদের জন্য প্রাণের মেলার দ্বার খোলে সকাল ৮টায়। এরপর মুহূর্তেই পদচারণা মুখরিত হয়ে ওঠে চেতনাঋদ্ধ বইমেলা। দুপুর গড়িয়ে বিকাল পেরিয়ে চলে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। এ দিন সকাল থেকে বইপ্রেমী মানুষের স্রোত শহীদ মিনার হয়ে বই মেলাতে এসেই খান্ত হচ্ছিল। এখান থেকে ঢু মেরেই পওে বের হচ্ছিল সবাই। তাদের এই আগমন-প্রস্থানে মাঝখানের সময়টুকুই চিরচেনা জোয়ারে রূপ নেয় ভাষার চেতনায় উজ্জীবিত প্রাণের মেলা। প্রমাণ করে- ভাষা ও ভাষা শহীদদের প্রতি মানুষের আবেদন আজও এতটুকু কমেনি।

সকাল সাড়ে ১০টায় মেলাপ্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, প্রাণের মেলায় আগত মানুষের ভিড় শুধু ভেতরেই নয়, শত শত মানুষের এ স্রোত টিএসসি, দোয়েল চত্বরসহ পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়েছে। একদিকে টিএসসি মোড় থেকে পাশাপাশি দুটি লাইন এসে থেমেছে মেলার সোহরাওয়ার্দী ও বাংলা একাডেমির প্রবেশমুখে। একইভাবে শহীদ মিনার এলাকা থেকে সর্পিল আকৃতির লাইন এসেছে দক্ষিণের প্রবেশমুখে।

\হদোয়েল চত্বর হয়ে হাইকোর্টেও মোড় বিরাম ছিল না কোথাও।

মেলায় আগতদের মধ্যে একুশের সাজও ছিল চোখে পড়ার মতো। 'অ' 'আ' কিংবা 'ক' 'খ' সম্বলিত বর্ণমালা লেখা বাহারি শাড়ি পরা তরুণীরা যেমন মেলায় ঢু মারতে এসেছিলেন, তেমনি তাদের হাত ধরে তরুণরাও এসেছিলেন বর্ণ খচিত পাঞ্জাবি-ফতুয়া পরে। গালে-কপালে জাতীয় পতাকা ও শহীদ মিনার একে কচি-কাচাদের উপস্থিতিও ছিল লক্ষণীয় হারে। সবমিলিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের জনস্রোতের ঢেউ লেগেছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার পর বইপ্রেমী এসব পাঠকদের ভিড় আরও বাড়ে। সন্ধার পর তিলধারণের ঠাঁই পাওয়া দায় হয়ে পড়ে মেলাপ্রাঙ্গণ ও আশপাশের সড়কগুলোতে।

কথা হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অদিতি অরণ্যের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভাষা শহীদরা নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে বাঙালি জাতিকে বিশ্বের বুকে মাথা তুলতে সাহায্য করেছে। আজকের বাংলা একাডেমির মেলা তো তারই বহির্প্রকাশ। তাদের সম্মানে মেলায় আসা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তবে গতকাল রাতে চকবাজারে যেভাবে মানুষ পুড়ে মরেছে তাতে মনটা খুবই খারাপ। তার পরও শহীদদেও সম্মানে এসেছি।

এদিকে ভিড়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আশানুরূপ বিক্রিও হয়েছে বৃহস্পতিবারের বইমেলায়। একাধিক প্রকাশক, লেখকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক বিক্রি হয়েছে। তবে চকবাজারের ঘটনায় মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল বলেও জানিয়েছেন তারা।

এবারের বই মেলায় ভাষা আন্দোলনের উপর নতুন বই:

এবারের বইমেলা ঘুরে ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের উপর নতুন যেসব বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে তার মধ্যে রিয়া প্রকাশনী এনেছে মামুন তরফদারের 'বাংলার লোকসংস্কৃতিতে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ', এশিয়া পাবলিকেশন্স এনেছে ড. গুলশান আরা 'ভাষা আন্দোলনের কথা', জোনাকী প্রকাশনী এনেছে সৌমিত্র শেখরের 'একুশের সংকলন পরিচিতি ও গুরুত্ব', আগামী প্রকাশনী এনেছে সৈয়দ জাহিদ হাসানের 'সিরাজগঞ্জে ভাষা আন্দোলন ও পাবনায় ভাষা আন্দোলন, ইত্যাদি এনেছে সুফিয়া বেগমের 'ভাষা সংগ্রামী নারীরা, প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিকের 'ভাষা আন্দোলন: টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া' অধ্যয়ন থেকে রাদিন চৌধুরীর 'ভাষা আন্দোলনের সহজ পাঠ', নালন্দা এনেছে সোহেল মলিস্নক সম্পাদিত 'ভাষা আন্দোলনের নির্বাচিত ৫০ কিশোর গল্প', বটেশ্বর বর্ণন এনেছে সুমাইয়া খানমের 'ভাষা-আন্দোলন ও বাংলাদেশের কথাসাহিত্য, এশিয়া পাবলিকেশন্স এনেছে ইসমাইল হোসেন বকুলের রক্তের কারাগারে বন্দি ৮ই ফাল্গুন, ভাষা আন্দোলন ও রক্তঝরা একুশ' ও ড.গুলশান আরার 'ভাষা আন্দোলনের কথা, জাগৃতি প্রকাশনী থেকে সাইফুল হক সিরাজী'র 'ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য'।

নতুন বই:

বই মেলার ২১তম দিন তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মোট বই এসেছে ৩৯৬টি। প্রতিবছরই বই মেলার এ দিনে বিপুল সংখ্যক কবই আসে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গতকালের ৩৯৬টি সহ এবারের মেলায় সবমিলে নতুন বই এসেছে, ৩ হাজার ৩৬৩টি। যার মধ্যে কবিতার বই রয়েছে ১ হাজার ৭৫টি। উপন্যাস ৫১৩, গল্পগ্রন্থ ৫৪৭টি সহ সবমিলে ৩ হাজার ৩৬৩টি বই এসেছে।

লেখক বলছি:

লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন প্রকাশিত গ্রন্থ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন খালেদ হোসাইন, শাহাদুজ্জামান, ফারুক ওয়াসিফ, রাহেল রাজিব এবং তপন পালিত।

কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন কবি নির্মলেন্দু গুণ, হাসান হাফিজ, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, জাফর আহমদ রাশেদ, আলফ্রেড খোকন এবং সোহেল হাসান গালিব। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ইকবাল বাহার চৌধুরী, আহ্‌কাম উলস্নাহ এবং তামান্না সারোয়ার। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল ফকির সিরাজের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন 'ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী'র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফকির আলমগীর, প্রমীলা চক্রবর্তী, মহাদেব ঘোষ, লাইসা আহমদ লিসা, বুলবুল ইসলাম, জান্নাত-ই-ফেরদৌসী এবং নীলোৎপল সাধ্য। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন এনামুল হক ওমর (তবলা), মো. ফারুক (প্যাড), রবিনস চৌধুরী (কী-বোর্ড) এবং আবু কামাল (বেহালা)।

আজকের অনুষ্ঠানসূচি

আজ মেলা চলবে সকাল ১১:০০টা থেকে রাত ৯:০০টা পর্যন্ত।

শিশুপ্রহর : আজ সকাল ১১:০০টা থেকে বেলা ১:০০টা পর্যন্ত মেলায় শিশুপ্রহর ঘোষণা করা হয়েছে।

সকাল ১০:৩০টায় অমর একুশের উদ্‌যাপনের অংশ হিসেবে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, সংগীত প্রতিযোগিতা, সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিশু-কিশোরদের পুরস্কার প্রদান করা হবে। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ।

আলোচনা অনুষ্ঠান : বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার শতবর্ষ : ফিরে দেখা

বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার শতবর্ষ : ফিরে দেখা শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ড. মাহবুবুল হক। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন সাইফুদ্দীন চৌধুরী, আলী হোসেন চৌধুরী এবং এম আবদুল আলীম। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, কবিতা-আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<37791 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1