বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
নিমতলী থেকে চকবাজার

৯ বছরে কী করেছে কর্তৃপক্ষ

ফয়সাল খান
  ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
চকবাজার চুড়িহাট্টার অগ্নিকান্ড -ফাইল ছবি

নিমতলী ট্র্যাজেডির ৯ বছর পূর্ণ হবে আর মাস তিনেক পর। তবে এখনো নিমতলীর নাম শুনলেই গাঁ শিউরে উঠে স্থানীয়দের। ৯ বছরেও সেই ট্র্যাজেডির কথা ভুলতে পারেনি পুরান ঢাকার মানুষ। ২০১০ সালের ৩ জুন কেমিক্যাল গোডানের বলি হয় ১২৪টি তাজা প্রাণ। সেই ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই বুধবার আবারও চুড়িহাট্টাতে অগ্নিকান্ডে নিভে গেছে ৭৮টি জীবন প্রদীপ। পুরান ঢাকার মর্মান্তিক এই ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে গেছে গোটা দেশ। নগরবাসীর প্রশ্ন নিমতলী ট্র্যাজেডির পর থেকে চুড়িহাট্টার ঘটনার এই ৯ বছরে কী করেছে কর্তৃপক্ষ?

জানা গেছে, ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর ৪৩/১, নবাব কাটরা ৫ তলা বাড়িতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ১২৪ জন মানুষ প্রাণ হারায়। আহত হয় কয়েকশ' মানুষ। পুড়ে যায় ২৩টি বসতবাড়ি, দোকানপাট, কারখানা। আপনজন হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় অনেক পরিবার। বাড়িটির থাকা নিচে কেমিক্যাল গোডাউন থেকে ওই আগুনের সূত্রপাত হয় বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। এই ঘটনার পর পুরান ঢাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এসব কেমিক্যাল ও রাসায়নিক গুদাম অপসারণের জোড়ালো দাবি উঠে প্রায় সব মহল থেকে। এসব দাবির প্রেক্ষিতে বেশকিছু উদ্যোগ নিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। যার ফলশ্রম্নতিতে বুধবার আবারও ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, পুরান ঢাকার মতো আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক পদার্থের গুদাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে নিমতলী ট্র্যাজেডির পর তা আবার অনুধাবন করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তখন যথাযথ ব্যবস্থা নিলে চকবাজার ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটত না। এখনো যদি কর্তৃপক্ষের ঘুম না ভাঙে, তবে আরও বড় মাশুল দিতে হবে বলে জানান তারা।

এ প্রসঙ্গে আলাপকালে নগর বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি ইকবাল হাবীব যায়যায়দিনকে বলেন, মানুষের আন্দোলনের মুখে নিমতলী ট্র্যাডেজির প্রথম বছরে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো রাসায়নিক কারখানা সরানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু সেটি আর বাস্তবায়ন হয়নি। ৯ বছর শুধু প্রতিশ্রম্নতির পুনঃব্যক্ত হয়েছে। বিশ্বের সব দেশে আগ্নিকান্ড হয়। সেটাকে স্বাভাবিক দুর্ঘটনা হিসাবে দেখলেও পুরান ঢাকার ঘটনা দুটি স্বাভাবিক নয়। এগুলো কর্তৃপক্ষের অকর্মণ্যতার ফসল। নিমতলী ও চুড়িহাট্টার ঘটনাকে হত্যাকান্ড উলেস্নখ করে তিনি আরও বলেন, 'এই ৭০ বা ১০০ জনের মৃতু্যও আমাদের নাড়া দিতে পারেনি। সম্ভবত আমরা অপেক্ষায় আছি কবে নিমতলীর সেই ১২৪ জনের রেকর্ড ভাঙবে। এই রেকর্ড ভেঙে ৭০০ হলেও জনগণ জাগবে কিনা আমার সন্দেহ হয়। কেননা এমন ঘটনার পর কর্তৃপক্ষও উদাসীন, জনগণও চুপ।' রাসায়নিক গুদাম সরাতে যদি আবারও ব্যর্থ উদ্যোগ নেয়া হয়, তবে ওই এলাকার মানুষকে গণআন্দোলন গড়ে তোলার পরামর্শ দেন তিনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ যায়যায়দিনকে বলেন, নিমতলীর ঘটনার পর অনেকবার এসব রাসায়নিক গুদাম সারানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু ফলাফল হয়েছে বিপরীত। ওই এলাকায় রাসায়নিক ব্যবসায়ের প্রসার ঘটেছে। নতুন নতুন কারখানা তৈরি হয়েছে উলেস্নখ করে তিনি আরও বলেন, প্রথমে নীতি নির্ধারণের জায়গাটি ঠিক করতে হবে। মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেয়া হবে নাকি ব্যবসাকে। জননিরাপত্তা হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে কোনো ব্যবসায় চলতে পারে না। কাল বিলম্ব না করে এসব কারখানা আবাসিক এলাকা থেকে সরাতে হবে।

আকতার মাহমুদ বলেন, পুরান ঢাকায় রাসায়নিক ব্যবসায়ের কোনো বৈধতা নেই। তবে ব্যবসায়ীরা সবাই প্রভাবশালী। যত নির্দেশনাই দেয়া হোক, তারা নিজ থেকে চলে যাবে না। বল প্রয়োগ করে হলেও জননিরাপত্তার স্বার্থে এদেরকে সরিয়ে দিতে হবে বলে জানান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিমতলীর ঘটনার পর ২০ ধরনের কেমিক্যালের ৮০০ গুদামের তালিকা তৈরি করে তা স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু প্রভাবশলীদের ছত্রছায়া আর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় উদ্যোগটি হালে পানি পায়নি। ওই ঘটনার প্রথম তিন বছর রাসায়নিক গোডাউন সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও শিল্পমন্ত্রণালয়ের বেশ তোড়জোড় ছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এসব উদ্যোগ এক সময় ঝিমিয়ে পড়ে।

২০১৭ সালের শুরুতে পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক গুদাম চিহ্নিত করে ফের তালিকা তৈরি করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের ২৪ সদস্যের টিম ৪টি ইউনিটে বিভক্ত হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অনুসন্ধান করে তাদের তালিকাটি তৈরি করে। ওই বছরই ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক গুদামে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করার ঘোষণা দেয় ডিএসসিসি। তবে এতেও কোনো ফলে আসেনি। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ফের বাবুবাজার এলাকায় অভিযান চলায় সংস্থাটি। অভিযানে ২৯ ধরনের দাহ্য পদার্থ না থাকায় রিপন পারফিউমারি এন্ড কেমিক্যাল, উম্মে হানি পারফিউমারি এন্ড কেমিক্যাল, মডার্ন পারফিউমারি এন্ড কেমিক্যাল, আমীন পারফিউমারি এন্ড কেমিক্যাল এবং সজিব কেমিক্যাল এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন করে দেওয়া হয়।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, পুরান ঢাকাসহ নগরীরর বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য অনুমোদনহীন কেমিক্যাল গুদাম রয়েছে। একাধিকবার পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ গুদামগুলো চিহ্নিত করা হয়। ৯৮ শতাংশ রাসায়নিক কারখানাই অনুমোদনহীন। দু'বছর আগে পুরান ঢাকার আরমানিটোলা, বাবুবাজার, মিডফোর্ড, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, সূত্রাপুর, ইসলামপুর, বাবুবাজার, মিটফোর্ড ও কোতোয়ালি এলাকাসহ আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করে আবাসিক ভবনে গড়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ চার'শ ঝুঁকিপূর্ণ গুদাম সনাক্ত করেছিল সংস্থাটি। আবাসিক বাসা-বাড়ির নিচতলায় অবস্থিত এসব বেশির ভাগ গুদামের লাইসেন্স নেই।

এসব রাসায়নিক গুদামে মধ্যে, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রো্‌ইল, টলুইসহ ভয়ঙ্কর রাসায়ানিক দাহ্য পদার্থ। এসব রাসায়নিক সামান্য আগুনের স্পর্শ পেলেই ঘটতে পারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা।

২০১৭ সালে রাসায়নিক কারখানায় জরিপ পরিচালনাকারী ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানান, ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক কারখানার অধিকাংশরই বৈধ কাগজপত্র এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদন নেই। এ কারণে নূ্যনতম নিয়ম-কানুনও তারা মানে না এসব গুদাম মালিকরা। দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে এসব ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গুদাম সরানো না হলে যে কোন সময় আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

বৃহস্পতিবার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকান্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, রাজধানীর পুরান ঢাকায় কোনো ধরনের দাহ্য পদার্থ ও কেমিক্যালের গোডাউন থাকবে না, থাকবে না, থাকবে না। গোডাউন উচ্ছেদের জন্য কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্থা নেয়া হবে উলেস্নখ করে সাঈদ খোকন বলেন, 'ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদের জন্য গত সোমবার থেকেই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা শুরু হয়েছে। আগুন লাগার ঘটনার সাত-আট দিন আগে এফবিসিসিআই এর মাধ্যমে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একটি বৈঠকও করা হয়েছিল। তারপর থেকে আমরা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করি। আমাদের আগে থেকেই উচ্ছেদ অভিযান চলছিল। কিন্তু অনাকাঙ্খিতভাবে গতকাল এ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটল।'

সিটি করপোরেশন উচ্ছেদ অভিযান চালালে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<37961 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1