শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বৃষ্টিতে সার্থক নগরীর দুই বর্ষা উৎসব

উৎসবের সঙ্গে মিশে যেতে আকাশি-নীল রঙের শাড়ি আর খোঁপায় কদম ফুল গুঁজে সেজেছে মেয়েরা। ছেলেদের পোশাকেও ছিল ভরা বর্ষার সৌন্দর্য-নীল পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা
যাযাদি রিপোর্ট
  ১৬ জুন ২০১৯, ০০:০০
শনিবার বাংলা একাডেমিতে উদীচী আয়োজিত বর্ষা উৎসব অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করছেন শিল্পীরা -ফোকাস বাংলা

শুক্রবার ছিল কটকটে রোদ। তাই অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল, শনিবার বর্ষার দেখা মিলবে তো? শেষ পর্যন্ত পঞ্জিকাই শাসন করেছে প্রকৃতিকে। গতকাল বাংলা ১৪২৬ সালে আষাঢ়ের প্রথম দিন সকালেই বর্ষা হাজির। নিয়ম করে ইট-কাঠ-পাথরের এই নগরে নামে বর্ষা। আর এমনই বষর্ণমুখর সকালে ছাতা মাথায় নিয়ে হয় বর্ষা নিয়ে কথা বলা, গান শোনা, নাচ দেখা। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হলো অনুষ্ঠানস্থল। সার্থক হলো বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও চারুকলা অনুষদে আয়োজিত বর্ষা উৎসব।

শনিবার সকালে যখন পূর্বনির্ধারিত সময়ে 'বর্ষা উৎসব' শুরু হবে, ঠিক তখনই শুরু হয় বৃষ্টির ধারাপাত। মানুষ আসবে তো? এমন আশঙ্কা আয়োজকদের মনেও ছিল। কিন্তু মানুষ এসেছে। সংখ্যায় তুলনামূলক কম হলেও দলবলে এসেছে অনেকে। উৎসবের সঙ্গে মিশে যেতে আকাশি-নীল রঙের শাড়ি আর খোঁপায় কদম ফুল গুঁজে সেজেছে মেয়েরা। ছেলেদের পোশাকেও ছিল ভরা বর্ষার সৌন্দর্য-নীল পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। বর্ষার কবিতার পঙ্‌?ক্তি আর ছবিসংবলিত টি-শার্ট পরেও দিনটিকে পার করেন কেউ কেউ। বর্ষাকে বরণ করতে দিনটির প্রথম প্রহরে উৎসবে মাতে বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চ। বর্ষাবরণের এ উৎসবের আয়োজন করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বসেছিল সত্যেন সেন শিল্পী সংস্থার 'বর্ষাবরণ উৎসব'। লোকজন বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। ঝুম বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে একাকার হয়ে যায় সবুজ প্রাঙ্গণ। একটু বাতাসে গাছের পাতায় জমে থাকা পানি ভিজিয়ে দেয় মঞ্চের শিল্পী এবং সামনে থাকা দর্শকদের।

বাংলার প্রকৃতিতে বর্ষার যেমন রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব, তেমনি বর্ষার সুর ও ছন্দের মাঝে রয়েছে মানুষের মন-প্রাণ আনন্দিত করে তোলার দারুণ ক্ষমতা। পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলনও ক্রমান্বয়ে দানা বাঁধছে। তাই গতকাল নগরীর দুটি বর্ষা উৎসবে এই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানান আয়োজকেরা।

মেঘমলস্নার রাগ দিয়ে শুরু উদীচীর বর্ষা উৎসব

বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে 'বর্ষা উৎসব' আয়োজন করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ঢাকা মহানগর সংসদ। সকাল ৭টায় বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে শিল্পী ইবাদুল হক সৈকতের সেতারে মেঘমলস্নার রাগ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বর্ষা উৎসব। উৎসব চলার সময়ে এক পশলা বৃষ্টি অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে আসে বর্ষার প্রকৃত আমেজ।

এরপর একে একে পরিবেশিত হয় দলীয় নৃত্য, দলীয় ও একক সংগীত আর আবৃত্তি। দলীয় সংগীত পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করে উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদ, বহ্নিশিখা, স্বভূমি, ভাওয়াইয়া সংগীত সংগঠন এবং উদীচী বাড্ডা, কাফরুল, মিরপুর, গেন্ডারিয়া, সাভার শাখা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ। যন্ত্রসংগীত পরিবেশন করেন উদীচী পরিচালিত শিল্পকলা বিদ্যালয় বিশ্ববীণার বেহালা শিল্পীরা। একক সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী সেঁজুতি বড়ুয়া, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, নাহিয়ান দুরদানা সূচি, মায়েশা সুলতানা উর্বী, মুনমুন খান, রবিউল হাসান, মারুফ ইসলাম, অনিকেত আচার্য। নৃত্য পরিবেশন করেন অনিক বোসের পরিচালনায় স্পন্দন, স্বপ্নবীনা শিল্পকলা বিদ্যালয় ও উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদ।

অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি পর্যায়ে বর্ষা কথন পাঠ করেন উদীচী ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক ইকবালুল হক খান। বর্ষাকে নিবেদন করে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন উদীচীর কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম সিদ্দিক, উদীচী ঢাকা মহানগরের সভাপতি নিবাস দে। উপস্থিত ছিলেন বর্ষা উৎসব আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক তমিজউদ্দিন ও সদস্যসচিব কংকন নাগ। কৃষক হেলাল উদ্দিন বক্তৃতায় আক্ষেপ করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যৌথ পরিবার, মা, মাটি, মানুষ সবই হরিয়ে যাচ্ছে! অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের নানান গাছের চারা দেয়া হয়।

শিশুদের গানে সত্যেন

শিল্পীগোষ্ঠীর উৎসব শুরু

চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর বর্ষা উৎসব শুরু হয় সমবেত গানের মধ্য দিয়ে। সুরবিহারের শিল্পীরা শোনান রবীন্দ্রনাথের 'বাদল-বাউল বাজায় রে একতারা' গানটি। এরপর অণিমা রায় শোনান 'পুব হাওয়াতে দেয় দোলা' গান।

একে একে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী শোনায় 'মন মোর মেঘের সঙ্গী', সুরতীর্থের শিল্পীরা 'ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে', স্বভূমি লেখক শিল্পী কেন্দ্র শিল্পীরা 'কলকল ছলছল নদী করে টলমল' ও বহ্নিশিখার শিল্পীরা 'মেঘের ডমরু ঘন বাজে' গানগুলো। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যজন, বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টস, নৃত্যা আর স্পন্দনের শিল্পীরা। উৎসবে শামা রহমান 'মেঘের পরে মেঘ জমেছে আঁধার ঘিরে আসে', সঞ্জয় কবিরাজ 'রিমঝিম রিমঝিম ঘনদেয়া বরসে', প্রিয়াঙ্কা গোপ 'শাওন আসিল ফিরে' গানগুলো শোনান। এ ছাড়া আরও একক গান শোনান মীরা মন্ডল, উত্তম কুমার রায় ও নবনীতা জাইদ চৌধুরী। এ ছাড়া নায়লা তারাননুম চৌধুরী জয় গোস্বামীর 'মেঘ বালিকা' এবং মাসকুর-এ-সাত্তার নির্মলেন্দু গুণ 'সদর ঘাটে পৌঁছেতেই' কবিতা দুটি আবৃত্তি করেন। 'বর্ষা কথন' পর্বে অধ্যাপক নিগার চৌধুরী সভাপতিত্বে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট।

উপাচার্য আখতারুজ্জামান বলেন, 'প্রকৃতি আমাদের নানা সম্পদ দিয়েছে। সেই প্রকৃতির যত্ন করতে হবে, সদ্ব্যবহার করতে হবে প্রকৃতির নানা উপাদানের। আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা এক অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে যাব।' তিনি আষাঢ়ের প্রথম লগ্নেই নগরজুড়ে বনায়ন শুরুর অনুরোধ জানিয়ে বলেন, 'আমরা ছোটবেলায় বাবা-চাচাকে দেখতাম, আষাঢ় এলে বৃক্ষরোপণ করতে। এখনো বলছি, চলুন একটি গাছ লাগাই সবাই। পরিবেশকে সুন্দর রাখতে বৃক্ষরোপণ এখন বাধ্যতামূলক।'

উপাচার্য মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান উদয়ন স্কুলের কিছু শিক্ষার্থীর মধ্যে ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা বিতরণ করেন।

বর্ষা কথনে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সহসভাপতি নিগার চৌধুরীও যেখানে সুযোগ পান সেখানে একটি করে গাছ লাগানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, 'আজ একটা গাছ লাগাবেন, আগামী বছর সেই গাছ থেকে একটা ফুল পাবেন অথবা ফল পাবেন। যদি তাও না পান, তাহলে অক্সিজেন পাবেন।'

আয়োজক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী বলেন, 'প্রকৃতিবান্ধব হওয়ার জন্য আমাদের ঋতুর কাছে ফিরে যেতে হয়। প্রতিটি ঋতুর আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। আমরা চাই, ঋতুর বৈশিষ্ট্য তার মতো করে থাকুক। প্রতিটি ঋতুর নিজস্ব রূপ, রং আছে। আমরা চাই, নতুন প্রজন্ম সে রংগুলো জানুক। প্রকৃতি আমাদের সতর্ক করছে, আমাকে গ্রহণ করো শুদ্ধভাবে। প্রকৃতি বাঁচলে আমরা বাঁচব। নতুন প্রজন্মকে আমরা এই বার্তা পৌঁছে দিতে চাই। এবার উৎসবে তাই বলছি, প্রকৃতি বাঁচাতে গাছ লাগাও।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<53805 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1