বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চবি ছাত্রলীগের গ্রম্নপিং রাজনীতির নিয়ন্ত্রক একদল শিক্ষক

গ্রম্নপিং রাজনীতির শিকার হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১০ বছরে ৮ জন শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। এদের মধ্যে তিনজন ছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থী। সবচেয়ে বেশি ছাত্র হত্যার শিকার হয় ২০১০ সালে। ওই বছরের ১১ ফেব্রম্নয়ারি ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশনে মহিউদ্দিন মাসুম ও ২৮ মার্চ শাটল ট্রেনে ছুরিকাঘাতে খুন হন হারুনুর রশিদ। এছাড়া ছুরিকাঘাতে নিহত হন মো. আসাদুজ্জামান
যাযাদি ডেস্ক
  ১৪ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

শাটল ট্রেনের সিট দখল, হলের রুম দখল, পিঠে রহস্যজনক ব্যাগ ঝুলিয়ে শো-ডাউন, দোকানে ফাও খাওয়া, নিজেদের 'কথার বাইরে' গেলে নির্যাতন-সবকিছুই দীর্ঘদিন ধরে সহ্য করে আসছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

কাগজে-কলমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলেও ক্ষমতাসীনদের দাপট থাকে সবসময়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাদের নামে যেমন গ্রম্নপ আছে, তেমনি আছে বগিভিত্তিক গ্রম্নপও। তারা আধিপত্য দেখা বগি দখলের নামে নিয়োগও চলে বগি হিসাব করে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বিগত প্রশাসনে ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক হিসাব করেই ছাত্রলীগ নেতাদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। 'একাকার বগি' থেকে ছাত্রলীগ নেতা তানজিম ও আরমান হেলালি, 'সিএফসি বগি' থেকে ওসমান গণি, মোস্তাফিজুর রহমান সিতাপ এবং সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক শরীফুল ইসলামের ভাই সাইফুল ইসলাম, কনকর্ড গ্রম্নপের নেতা আব্দুল মালেকের ভাই আলিমুলস্নাহ, ওই গ্রম্নপের আরেক নেতা তৌহিদুল ইসলাম জিমেলকে চাকরি দেওয়া হয়।

এ ছাড়া ছাত্রলীগের এক নেতার সুপারিশে আরও একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে নিয়োগ দেয়া হয়। এ ছাড়া সিক্সটি নাইন গ্রম্নপ থেকে ছাত্রলীগের সহসভাপতি রাকিব ও শহীদ, বাংলার মুখ গ্রম্নপের নেতা সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ মামুনের ভাই মোহাম্মদ মাসুম, ভিএক্স গ্রম্নপের নেতা মোহাম্মদ রেজা ও মোহাম্মদ ইব্রাহিম, আর এস গ্রম্নপের নেতা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাখাওয়াত রায়হান, বিজয় গ্রম্নপের নেতা ছাত্রলীগের সহসভাপতি এস এম আলাউদ্দিন আলম, মনসুর আলী ও আসতারুল হককে চাকরি দেয় প্রশাসন।

হলের সিট বণ্টনের সময়ও বগিভিত্তিক গ্রম্নপ আলাদা আলাদা তালিকা দিয়ে থাকে। সেই তালিকা ধরেই সিট বণ্টন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক কিছু নেতা ও শিক্ষক এসব গ্রম্নপকে মদদ দিয়ে থাকেন। তারা টেন্ডার বাণিজ্য সামলাতে ব্যবহার করেন এসব গ্রম্নপকে। টেন্ডার না পাওয়ায় সম্প্রতি নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকা বগিভিত্তিক গ্রম্নপের কর্মীদের পাঠিয়ে প্রকৌশল অফিস ভাঙচুর করানোর অভিযোগও রয়েছে সাবেক এক নেতার বিরুদ্ধে। আবার শিক্ষক রাজনীতিতেও এসব গ্রম্নপের 'কদর' রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। কয়েকজন শিক্ষক এসব গ্রম্নপের অঘোষিত নিয়ন্ত্রক, যারা ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বগিভিত্তিক গ্রম্নপ থেকেই ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। সম্প্রতি গঠন হওয়া কমিটিতে সভাপতির পদ পেয়েছেন সিএফসি গ্রম্নপের নেতা রেজাউল হক রুবেল, সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন সিক্সটি নাইন গ্রম্নপের নেতা ইকবাল হোসেন টিপু। এর আগের কমিটিরও সভাপতি ছিলেন সিক্সটি নাইন গ্রম্নপের আলমগীর টিপু ও তৎকালীন বিজয় গ্রম্নপের নেতা ফজলে রাব্বী সুজন।

এমনকি ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিও বগিভিত্তিক নাম অনুযায়ী ভাগ করেই করা হয়েছে। এ গ্রম্নপগুলোর মধ্যে সিএফসি ও বিজয় গ্রম্নপ এবং সিক্সটি নাইন, আরএস, ভিএক্স, কনকর্ড, বাংলার মুখ গ্রম্নপ চট্টগ্রামের দুই নেতার অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার করে।

গ্রম্নপিং রাজনীতির শিকার হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১০ বছরে ৮ জন শিক্ষার্থী খুন হয়েছে। এদের মধ্যে তিনজন ছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থী। সবচেয়ে বেশি ছাত্র হত্যার শিকার হয় ২০১০ সালে। ওই বছরের ১১ ফেব্রম্নয়ারি ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশনে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের মহিউদ্দিন মাসুম ও ২৮ মার্চ শাটল ট্রেনে ছুরিকাঘাতে খুন হন হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হারুনুর রশিদ। এছাড়া ছুরিকাঘাতে নিহত হন হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মো. আসাদুজ্জামান।

ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে ২০১২ সালের ৮ ফেব্রম্নয়ারি ২ জন ও ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি একজন ছাত্রশিবির নেতা নিহত হন। ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর নিজ বাসায় খুন হন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের দুই নেতা যাদের নাম প্রস্তাব করেন তাদেরই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিতে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না।

২০১৪ সালে তৃতীয়বার

নিষিদ্ধ হয় ছাত্ররাজনীতি

২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের দুই গ্রম্নপের সংঘর্ষে তাপস সরকার নিহত হওয়ার পর তৃতীয় বার ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্ররাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিল কি না সেটি দাপ্তরিকভাবে জানানো হয়নি।

এর আগে ২০০৮ সালের ১০ নভেম্বর প্রথম রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ওই দিন সিন্ডিকেটের ৪৫৮ তম জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

২০১২ সালের ৮ ফেব্রম্নয়ারি ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষে দুই ছাত্র নিহত হয়। এরপর আবারও সিন্ডিকেটের ৪৮০তম জরুরি সভায় রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কিন্তু কাগজে কলমে থেকে যায় সেই সিদ্ধান্ত।

২০১৪ সালে প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করা সিরাজ উদ দৌলস্নাহ বলেন, ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে ওই সময়ে সভা, সমাবেশ ও মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। তবে সেটা ছিল সাময়িক।

কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও স্বয়ং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই তা ভেঙেছে। ছাত্রশিবিরকে ২০১৩ সালের ২৬ আগস্ট সমাবেশ করার অনুমতি দিয়ে সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০১৪ সালে ছাত্র রাজনীতি তৃতীয় বার নিষিদ্ধ করার পর থেকে বছরের পর বছর ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল, সমাবেশ, বিক্ষোভ করেছে ছাত্রলীগসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠন।

তারা বলেন, মূলত ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার করছে গুটিকয়েক শিক্ষক। যারা টেন্ডারবাজি ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। এসব শিক্ষকদের আধিপত্য রয়েছে সব ক্ষেত্রেই। ছাত্রলীগের গ্রম্নপিং রাজনীতি তারাই সৃষ্টি করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ইকবাল হোসেন টিপু বলেন, 'আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর বগিভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছি। তবুও যারা বগির নাম দিয়ে মারামারি করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কয়েকটি ঘটনার তদন্তও চলছে। ফাও খাওয়া, হল দখল ও শাটল ট্রেনে মারামারির বিষয়ে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসবে, সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নেব।'

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি গৌরচাঁদ ঠাকুর বলেন, 'বেশির ভাগ অন্যায় কর্মকান্ডের সঙ্গে ছাত্রলীগ জড়িত। আবাসিক হল দখল করে রাজনীতিও তারা করছে। এসব বিষয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলেছি। এ ছাড়া খাবারের দাম কমানোসহ নানা বিষয়ে আন্দোলন করছে ছাত্র ইউনিয়ন।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কেএম নূর আহমেদ বলেন, 'বর্তমান প্রশাসন নানান অনিয়মের বিষয়ে সজাগ। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আগে কি হয়েছে, সেটি আগের বিষয়। এখন থেকে কোনো অনিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়ে হবে না। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, তাদের বিরুদ্ধেই প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<71078 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1