বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
উৎসে করারোপের কড়াকড়ির প্রভাব হ এক বছরে কমেছে ৩৪.৫১ শতাংশ

সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস

চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার না কমিয়ে সরকার উল্টো উৎসে কর বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে দেয়। অর্থাৎ ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ করা হয়। এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়। সঞ্চয়পত্রের সব লেনদেন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে করতে হচ্ছে ক্রেতাদের
ইমদাদ হোসাইন
  ২২ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস নেমেছে। চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রথম তিন মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি (জুলাই-সেপ্টেম্বর) উলেস্নখযোগ্য হারে কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৬৯৮ কোটি ৭ লাখ টাকা। অথচ গত বছরের একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ১৩ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বিক্রি কমেছে ৮ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে কমেছে ৩৪ দশমকি ৫১ শতাংশ।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ার পেছনে উৎসে করারোপের কড়াকড়িকেই প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার না কমিয়ে সরকার উল্টো উৎসে কর বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে দেয়। অর্থাৎ ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ করা হয়। এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়। সঞ্চয়পত্রের সব লেনদেন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে করতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয়েছে ৯৮৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা। গত আগস্টে সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৪৯৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতি মাসেই কমছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। জুলাই মাসে সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয় ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। আগস্টে বিক্রি হয় ১ হাজার ৪৯৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বিক্রি হয় তিন হাজার ২০৮ কোটি টাকা।

জানা গেছে, দুর্নীতি কিংবা অপ্রদর্শিত আয়ে সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধ করতে ক্রেতার তথ্যের একটি ডাটাবেসে সংরক্ষণের লক্ষে অভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিক্রি কার্যক্রম শুরু করে। এছাড়া সঞ্চয়পত্রে বড় বিনিয়োগে কঠোর হয়েছে সরকার। চাইলেই ভবিষ্যৎ তহবিল বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থে সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ নেই। এছাড়া এখন প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে কর কমিশনারের প্রত্যয়নপত্র লাগে। পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক ফার্মের নামে সঞ্চয়পত্র কিনতে লাগছে উপকর কমিশনারের প্রত্যয়ন। এসব কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ১১৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মূল ও সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ১২৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয় ২ হাজার ৬৭৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয় ৯৮৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

এর আগে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মূল ও সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয় ২ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয় ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। আগস্টে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ২১৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মূল ও সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭১৫ কোটি ৩০ হাজার টাকা। এর মধ্যে সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয় ২ হাজার ২০৫ কোটি ৪০ হাজার টাকা। আগস্টে সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয় ১ হাজার ৪৯৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, তিন মাসে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১৭ হাজার ৪২১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মূল ও সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ৭২৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে সুদ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৫৬৬ কোটি ৯ লাখ টাকা। সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৬৯৮ কোটি ৭ লাখ টাকা।

এদিকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ অর্থ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছিল, তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ঋণ নেয়।

অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্য ছিল সরকারের। বিক্রি বাড়তে থাকায় সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঠিক করা হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে সঞ্চয়পত্রে সরকারের ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা।

সরকারের এ খাতের ঋণ আগের অর্থবছরের চেয়ে তিন হাজার ৪০৯ কোটি টাকা বেশি। এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৪ হাজার কোটি টাকা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিক্রি হয় ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছর সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার পেয়েছিল ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। এরকম পরিস্থিতির মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার।

এর আগে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে সর্বশেষ ২০১৫ সালের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহার গড়ে ২ শতাংশ করে কমানো হয়েছিল। বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। পাঁচ বছরমেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০১৫ সালের ২৩ মের পর থেকে এই হার কার্যকর। এর আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় সঞ্চয় স্কিমগুলোতে বিনিয়োগকৃত অর্থের ওপর একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর মুনাফা প্রদান করে সরকার। মেয়াদপূর্তির পরে বিনিয়োগকৃত অর্থও ফেরত প্রদান করা হয়। প্রতি মাসে বিক্রি হওয়া সঞ্চয় স্কিমগুলো থেকে প্রাপ্ত বিনিয়োগের হিসাব থেকে আগে বিক্রি হওয়া স্কিমগুলোর মূল ও মুনাফা বাদ দিয়ে নিট ঋণ হিসাব করা হয়। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেটে নির্ধারিত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগকে সরকারের 'ঋণ' বা 'ধার' হিসেবে গণ্য করা হয়।

সঞ্চয়পত্রের উচ্চ মুনাফা বা সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ পড়ছে। ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে সরকারকে সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি।

অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘ কয়েক বছর থেকেই বলে আসছেন, সঞ্চয়পত্র যাদের জন্য চালু করা হয়েছিল, তারা তা কিনতে পারছেন না, বরং একশ্রেণির কালো টাকার মালিক, আমলা, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে সরকারের দেওয়া উচ্চ সুদের ভাগ নিচ্ছেন।

পাঁচ বছরমেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন বছরমেয়াদি তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র এবং পাঁচ বছরমেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রে ৫ লাখ টাকা পুঞ্জিভূত বিনিয়োগের মুনাফার ক্ষেত্রে উৎসে কর ৫ শতাংশ। এর বেশি বিনিয়োগ হলেই সুদের ওপর উৎসে কর ১০ শতাংশ। আর পাঁচ বছরমেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ৫ লাখ টাকা পুঞ্জিভূত বিনিয়োগের সুদের ক্ষেত্রে কোনো উৎসে কর নেই। তবে এ সঞ্চয়পত্রে এর বেশি বিনিয়োগের মুনাফার ক্ষেত্রে উৎসে কর ১০ শতাংশ।

বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। এ ছাড়া পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের সুদ ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদ ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্রের সুদ ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। সঞ্চয় অধিদপ্তরের আর্থিক পণ্য হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। এটি বিক্রি হয় দেশের ৭৫টি সঞ্চয় বু্যরো, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এর শাখা অফিস এবং ডাকঘরের মাধ্যমে। সঞ্চয় বু্যরোগুলো অবশ্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে কোনো একটি ব্যাংকের মাধ্যমে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<76567 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1