শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনজিওর পকেটে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোটি টাকা

১১টি খাতে আরও কোটি টাকা লোপাট
নূর মোহাম্মদ
  ২২ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৩০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করে তা মসজিদ মিশন নামে একটি এনজিওর পকেটে ঢোকানো হয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের ১১টি খাত থেকে আরও প্রায় কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। রাজশাহীতে মসজিদ মিশনের নামে প্রতিষ্ঠিত তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে। প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মসজিদ মিশন নামে একটি এনজিও সারাদেশে মসজিদ উন্নয়ন কার্যক্রম করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন দেশ থেকে ফান্ড সংগ্রহ করে এ সংস্থাটি পরিচালিত হয়। এ সংস্থাটির তত্ত্বাবধানে রাজশাহী শহরে মসজিদ মিশন একাডেমি (স্কুল অ্যান্ড কলেজ), বড়কুঠি সাহেববাজার মসজিদ মিশন একাডেমি, শিরোইল (মহিলা) শাখা এবং মসজিদ মিশন একাডেমি, বিনোদপুর শাখা পরিচালিত হয়। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাসিক ৩০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করে মসজিদ মিশনের ফান্ডে জমা দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মকান্ড ছাড়া অন্য কোনো সংস্থার নামে অর্থ আদায়ের বিধিবিধান না থাকলেও এক দশকের বেশি সময় ধরে মসজিদ মিশনকে এ টাকা তুলে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ক্যাশ বইয়ে আপটুডেট না রাখা, শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কম্পিউটার ও বিজ্ঞানাগারের নামে ফি আদায়, প্রচুর আয় থাকার পরও ব্যাংক ঋণ নিয়ে তহবিল তছরুপ, ভবন নির্মাণসহ বড় অংকের অর্থ ব্যয়ে আর্থিক বিধি অনুসরণ না করা, কোটেশন-টেন্ডার না করা, ভ্যাট না কাটা, বিভিন্ন বিল ক্রসড চেকের মাধ্যমে না দিয়ে নগদ পরিশোধ, আয় ও ব্যয়ের হিসাবে অসঙ্গতি, ৩ মাস অন্তর অন্তর নিরীক্ষা না করা এবং বিধি বর্হিভূতভাবে প্রতিষ্ঠানের টাকা নগদ রেখে খরচ করার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, মসজিদ মিশনের নামে প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি রাজনৈতিক দলের আদর্শ শেখানোর পাশাপাশি আর্থিক অনুদানের টাকা আত্মসাৎ করা হয় এমন অভিযোগ আসার পর তা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় নির্দেশ দেয়। এরপরই তদন্তে নামে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। সংস্থাটির যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার, উপপরিচালক রাশেদুজ্জামানসহ পাঁচজন কর্মকর্তা প্রায় এক বছর তদন্ত করে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ মসজিদ মিশন রাজশাহী শাখার সরাসরি তত্ত্বাবধানে এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। ১৯৮২ সালে নিম্ন মাধ্যমিক, ১৯৮৯ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৯৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের অনুমতি পায়। বর্তমানে তিনটি শাখা চালু রয়েছে। শিক্ষা বোর্ডের অনুমতি ছাড়াই এসব শাখাগুলো চালানো হচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানটির বেশিরভাগ শিক্ষক জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বলে প্রমাণ পেয়েছে তদন্তকারী দল। তদন্ত চলাকালীন ছয়জন শিক্ষক ওই দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা পরিষদের নানা অসঙ্গতি পেয়েছে কমিটি। সাত সদস্যের একটি বিশেষ গভর্নিং বডি থাকলেও তার সভাপতি মসজিদ মিশনের সভাপতি কর্তৃক মনোনীত। শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদিত গভর্নিং বডির মেয়াদ ২০১৭ সালের মে মাসে শেষ হলেও আর মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। বিশেষ কমিটি দ্বারা কোনো প্রতিষ্ঠান আদৌ পরিচালিত হতে পারে না বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে কমিটি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের গণিতের প্রভাষক আবুল কাশেম, পদার্থবিদ্যার প্রভাষক তৌহিদুল ইসলাম, ভূগোলের প্রভাষক এস এম মুখলেছুর রহমান, ইংরেজির প্রভাষক সুজাউদ্দৌলা সেলিম, হিসাব বিজ্ঞানের প্রভাষক আহমাদুল হক, মনোবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক এনামুল হক, ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক কামরুজ্জামান, মার্কেটিংয়ের প্রভাষক হোসেন তৌফিক ইমাম, পরিসংখ্যানের প্রভাষক নাজমা জিয়াসমিন- এই নয়জন শিক্ষকের নিয়োগ যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়নি। এই শিক্ষকরা বেতনভাতা হিসেবে মোট ১ কোটি ৮২ লাখ ৪৯ হাজার ১১৮ টাকা নিয়েছেন যা ফেরতযোগ্য। এ টাকা আদায় করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মসজিদ মিশন প্রতি মাসে ৩০ টাকা হারে যে টাকা আদায় করেছে যার মধ্যে ২০১১ সালে ১ লাখ ১ হাজার, ২০১২ সালে ৯৯ হাজার ৩০০, ২০১৩ সালে ৯২ হাজার ৭৩০ টাকা, ২০১৪ সালে ৮৯ হাজার ৭০০ টাকা, ২০১৫ সালে ৮৫ হাজার ৬৮০ টাকা এবং ২০১৬ সালে ৮২ হাজার ৯৫০ টাকা। মোট ৫ লাখ ৫১ হাজার ৫৮০ টাকা আদায় করা হয়েছে বিধিবিধান না মেনেই। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মকান্ড ছাড়া অন্য কোনো সংস্থার নামে অর্থ আদায়ের কোনো বিধিবিধান নেই। এছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকা কী কাজে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা জানা যায়নি। মসজিদ মিশনকে দেওয়া টাকা বিধি সম্মত হয়নি। মসজিদ মিশন হতে এ টাকা আদায় করে প্রতিষ্ঠানের তহবিলে জমা দেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এর আগে ও পরে মসজিদ মিশনের নামে আদায় করা টাকার হিসাব করে প্রতিষ্ঠানের তহবিলে জমা দিয়ে প্রমাণসহ মন্ত্রণালয়কে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

এছাড়া বছরভিত্তিক আয়-ব্যয়ের নানা অসংঙ্গতি পেয়েছে পরিদর্শন টিম। তার মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে সরকারি বেতন-বোনাস বাবদ ১ কোটি ১৩ লাখ ১৪ হাজার ৯৪৩ টাকা আয় ও ব্যয় দেখানো হয়। অন্যদিকে সরকারি বেতন-বোনাস বাবদ ১ কোটি ৫৫ লাখ ৩১ হাজার ৬৭১ টাকা আয় দেখানো হয়। অর্থাৎ মোট ৪২ লাখ ১৬ হাজার ৭২৮ টাকা হিসাবে গড়মিল।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিভিন্ন বছর প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ টাকা হাতে নগদ রেখে খরচ করা হয়েছে যা আত্মসাতের শামিল। আইন অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তহবিলের সকল আয় ব্যাংকে জমা করতে হবে এবং ক্রসড চেকের মাধ্যমে তা ব্যয় করতে হবে।

অডিট প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ এ ১০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটিতে মোট আয় হয়েছে ১১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। তার মধ্যে ব্যাংকে জমা হয়েছে ১১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। আয়ের চেয়ে ব্যাংকে বেশি জমা দেখানো হয়েছে ১০ লাখ ৩ হাজার ১২০ টাকা। শুধু ২০১৫-১৬ অর্থ বছরেই আয়ের চেয়ে ১০ লাখ ৫৩ হাজার টাকা বেশি ব্যাংকে জমা দেখানো হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির আয় ও ব্যয়ের হিসাব সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি।

তদন্তে ব্যয়ের হালনাগাদ তথ্য পায়নি পরিদর্শন টিম। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের পর ব্যয়ের কোনো হিসাব দেখাতে পারেনি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ। ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে ২০১৫-১৬ দশ অর্থবছরে মোট ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি ৬০ লাখ টাকা বেশি। এ টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংক চেকের মাধ্যমে টাকা পরিশোধের তথ্য পায়নি তারা। টেন্ডার কোটেশন এবং ভ্যাট কর্তন না করেই ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে হতে ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে মোট ব্যয় ১০ কোটি টাকা বেশি। চেকের মাধ্যমে পাওনা পরিশোধের তথ্য নেই। প্রাপক টাকা বুঝিয়া পেয়েছেন সেই প্রত্যয়নও নেই। এ টাকা ব্যয়ে ভ্যাট কর্তনের কোনো প্রমাণ নেই। এ টাকা ব্যয়ে গড়ে নূ্যনতম ৫ দশমিক ৫০ টাকা হারে মোট ৫৮ লাখ টাকার বেশি ভ্যাট কর্তন করার কথা থাকলেও ভ্যাট কর্তন হয়নি। প্রতিষ্ঠানে প্রচুর আয় থাকা পরও ২০০৬-০৭ অর্থ বছর হতে ২০১০-১১ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ৩৪৩ টাকা ঋণ নেয়। তার বিপরীতে ৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫৮০ টাকা ঋণ পরিশোধ দেখানো হয়। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধের নামে প্রতিষ্ঠানের ১৬ লাখ ১৪ হাজার ২৩৭ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ভবন নির্মাণের জন্য ব্যয় হওয়া ৪০ লাখের মধ্যে মাত্র ৭ লাখ টাকার বেশি ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে। নগদ দেওয়া টাকায় দুর্নীতি হয়েছে। অন্যদিকে এ টাকায় ব্যয়েও ৪ শতাংশ আয়কর, ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর বাবদ মোট ৩ লাখ ৪৭ হাজার কর্তন করা হয়নি। অবৈধ পন্থায় নির্মাণ কাজ করার জন্য এ টাকা সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করা হয়েছে। এ টাকা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি। এছাড়া ৭ লাখ ২২ হাজারের বেশি টাকা অবৈধভাবে নগদ ব্যয় করার জন্য সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে কমিটি।

এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির প্রধান ও ডিআইএ যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার যায়যায়দিনকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে অডিট না হওয়ায় দুর্নীতির বাসা বেঁধেছিল। যত ধরনের অনিয়ম পেয়েছি সেগুলো তদন্তে কমিটিতে উলেস্নখ করেছি।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<76569 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1