শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা উত্তরের নতুন ওয়ার্ড

সবার আগে দরকার সড়ক, নর্দমা সংস্কার

নতুনধারা
  ২২ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
বামনাটেকে ভাগাড়ে পরিণত জলাশয়

যাযাদি ডেস্ক

ঢাকার গুলশান, বারিধারা উত্তরার কোলঘেঁষা আটটি ইউনিয়নের বাসিন্দারা যখন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সঙ্গে যুক্ত হন, তখন নূ্যনতম নাগরিক সুবিধা তাদের ছিল না। সেই চিত্র পাল্টায়নি তিন বছরেও। 'নতুন' এই ১৮ ওয়ার্ডের বাসিন্দারা এখনও বেশিরভাগ নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বারিধারা ও উত্তরা লাগোয়া ৩৭ থেকে ৫০ নম্বর ওয়ার্ড এবং বিমানবন্দর ঘেঁষে ও উত্তরার পশ্চিমাংশ জুড়ে ৫১ থেকে ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড উত্তর সিটি করপোরেশনে যুক্ত হয় তিন বছর আগে।

সরেজমিন দেখা যায়, এসব এলাকার বেশিরভাগ রাস্তাঘাট ভাঙা; নিষ্কাশন সুবিধা না থাকায় বিভিন্ন এলাকা জলাবদ্ধ; কিছু সড়কে শুকনো মৌসুমেও পানি জমে থাকে; সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে যেখানে-সেখানে। ফলে ভোগান্তির মধ্যেই চলতে হয় এলাকাবাসীকে।

নতুন এসব ওয়ার্ডের বেশিরভাগ এলাকায় বসানো হয়নি সড়ক বাতি; নেই খেলার মাঠ ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের মধ্যে অনেক আলোচনার পরও মশক নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়নি কার্যকর উদ্যোগ।

ভোটের ডামাডোলের মধ্যে কাউন্সিলর প্রার্থীদের সামনে এ বিষয়গুলো ঘুরেফিরে আসছে। প্রাথমিকভাবে রাস্তা ও নর্দমা নির্মাণসহ কিছু কাজ জরুরিভিত্তিতে করার জন্য প্রার্থীদের কাছে আগাম দাবি জানিয়ে রাখছেন ভোটাররা।

বেহাল সড়ক: ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের ডুমনি থেকে পাতিরা হয়ে তলনা পর্যন্ত, ডুমনি থেকে বরুয়া, বরুয়া বাজার থেকে দক্ষিণখান হয়ে আশকোনা, দক্ষিণখান থেকে দোবাদিয়া-কাঁচকুড়া-ভাড়ারদী হয়ে ভাতুরিয়া, কাঁচকুড়া থেকে মৈনারটেক হয়ে আবদুলস্নাহপুর, ৫৩ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের রানাভোলা, কামারটেকের প্রধান সড়কের অবস্থা খারাপ।

প্রধান সড়কগুলো মোটামুটি চলার উপযোগী থাকলেও পাড়া-মহলস্নার ভেতরের রাস্তাগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। সিটি করপোরেশনে যুক্ত হওয়ার পরও এলাকার চিত্র পরিবর্তিত হয়নি বলে ওয়ার্ডের বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন।

বরুয়া এলাকার বাসিন্দা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, 'হাজিক্যাম্প থেকে বরুয়া পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন জায়গায় ভাঙা। হাজিক্যাম্প পর্যন্ত যাইতে কোমর ভাইঙা যায়।'

এই ওয়ার্ডের প্রধান সড়কটি বালু নদীর তীরঘেঁষে পাতিরা থেকে মস্তুল হয়ে তলনা পর্যন্ত গেছে। সড়কটি সারা বছরই ভাঙা থাকে, চলাচলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় বলে জানান তলনা এলাকার বাসিন্দারা।

এই এলাকার বাসিন্দা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৃজন বলেন, 'এই রাস্তা চলাচলের পুরো অযোগ্য। বর্ষাকালে হাঁটুসমান কাদা থাকে, শীতকালে ধুলা উড়ে। বিভিন্ন জায়গায় কংক্রিটের ছোট বড় টুকরা ফেলে রাখা হয়েছে। এ কারণে সহজে যাতায়াত করা যায় না।'

রানাভোলা, কামারটেক এলাকার প্রায় সব সড়কই উঁচুনিচু, ভাঙা; যানবাহন চলে ধীরে। রিকশায় চলাচল করতে গেলেও প্রচুর ঝাঁকুনি খেতে হয়। এসব এলাকায় গত ৩০ বছর সড়কে কোনো উন্নয়ন কাজ হয়নি বলে এলাকাবাসী জানান।

বামনারটেক এলাকার বাসিন্দা সেলিম মাহবুব বলেন, 'এসব সড়ক হাঁটারও উপযোগী না। চলতে ফিরতে খুব কষ্ট হয়। এজন্য আমাদের এলাকাকে আধুনিক শহর করতে হলে প্রধান সড়কগুলো ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ আধুনিকায়ন করতে হবে। আমাদের দুর্ভোগ অনেকটা কমে যাবে।'

জলাবদ্ধতায় ভোগান্তি

নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় নিচু জমি, বদ্ধ জলাশয়ে সারাবছরই পানি জমে থাকে; গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত পানি চলে আসে সড়কে। ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের হলান এলাকায় বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দেখা গেছে, সড়কে পানি জমে আছে।

আনোয়ার হোসেন নামে এই ওয়ার্ডের এক বাসিন্দা বলেন, 'জলাশয়গুলো ভরাট করে বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছে। ফলে পানি যেতে পারে না। এ কারণে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে থাকে।

আগে তো ডোবা-নালা ছিল, পানি চইলস্না যাইত। এখন তো পানি আইটকা আছে। ড্রেনের তো দরকার। এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলে এই সড়কে কোমরসমান পানি জমে থাকে। বৃষ্টি কমলে পরে আস্তে আস্তে পানি কমে।'

একই অবস্থা দেখা গেছে, ৫৩, ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেও। নতুন ওয়ার্ড হওয়ার পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও কাউন্সিলররা এলাকার উন্নয়নে নজর দেননি। নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে এসব সমস্যার সমাধান চান এলাকাবাসী।

৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম কালিয়ারটেকের বাসিন্দা নাসির উদ্দিন বলেন, 'আমাদের এলাকায় পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। এছাড়া সড়কেরও সমস্যা আছে। এই দুটি জিনিসের কারণে আমরা বেশি ভোগান্তিতে আছি।'

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই

আছে মশার উপদ্রব

নতুন ওয়ার্ডগুলোর বেশিরভাগ এলাকায় এখনও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম শুরু করেনি সিটি করপোরেশন। কিছু ওয়ার্ডে সীমিত আকারে গৃহস্থালির বর্জ্য অপসারণ করা হয়। বাকি বর্জ্য ফেলা হয় ডোবানালা ও খালি জায়গায়। ফলে আবর্জনায় ভরা নিচু জমি ও বদ্ধ জলাশয়ে জন্মে মশা। ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের বামনারটেক সড়কের পাশেই ডোবায় ময়লা ফেলে ভরাট করা হয়েছে।

এখানকার বাসিন্দা কাজী আলাউদ্দিন বলেন, 'ফেলার জায়গায় নেই বলে এলাকার মানুষ রাস্তাঘাটে বা ডোবানালায় ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখে। সিটি করপোরেশনের লোকজন তো আসেই না। আসলে তো ময়লা আবর্জনা এভাবে ছড়াইয়া-ছিটাইয়া থাকত না।'

৪২ নম্বর ওয়ার্ডের বাড্ডার আবদুলস্নাহবাগ এলাকার বাসিন্দা শাকিলা আফরোজ বলেন, নোংরা পরিবেশ, মশা নিধনে কোনো কার্যক্রম না থাকায় সারাবছরই মশার উৎপাত থাকে। শীতে মশার উপদ্রব আরও বেড়েছে। ডিএনসিসিতে যুক্ত হওয়ার পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু ফলাফল শূন্য।'

একই অভিযোগ করেন, দোবাদিয়া এলাকার বাসিন্দা আহমেদ নূর। তিনি বলেন, তার এলাকায়ও মশা নিধনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

চাই পরিকল্পিত শহর

বাড্ডা থেকে উত্তরখান পর্যন্ত ওয়ার্ডগুলোর পূর্বাংশে বিস্তৃত কৃষিজমি, খাল, নিচু জলাশয় রয়েছে। নিচু জমিগুলো বছরের প্রায় ছয় মাস পানির নিচে থাকে। শুকনো মৌসুমে এসব উর্বর জমিতে কৃষিকাজ হয়; ধানসহ নানা ফসল ফলান মানুষ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এসব জলাশয় ভরাট করে গড়ে উঠছে আবাসন প্রতিষ্ঠান; ব্যক্তি পর্যায়েও অনেক নিচু জমি ভরাট করা হচ্ছে।

৪২ নম্বর ওয়ার্ডের বেরাইদ এলাকার বাসিন্দা এমদাদুল হক তিনি বলেন, জলাভূমিগুলো এখন বিলীন হওয়ার পথে। বাকিগুলো রক্ষায় নগর কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে।

নতুন ওয়ার্ডগুলোর সমন্বিত উন্নয়নের জন্য নগর কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান বাড্ডার আবদুলস্নাহবাগ এলাকার বাসিন্দা মিলস্নাত হোসেন। তিনি বলেন, নগরায়ন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। তবে উন্নয়ন যেন সমন্বিত হয়।

'শহর উন্নয়নের পাশাপাশি কৃষি জমি, জলাধারও রক্ষা করতে হবে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন আবাসন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করার কাজটি নগর কর্তৃপক্ষকেই করতে হবে।'

চাওয়া আছে আরও

৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় এখনও সড়ক বাতি বসেনি। ফলে রাতে অন্ধকারে পথ চলতে হয় বলে জানান ঢেলনা এলাকার বাসিন্দা আরিফ হোসেন।

'বেশিরভাগ মানুষ রাতে ভয়ে চলে। এসব এলাকায় সড়ক বাতি দিলে ভালো হতো। অন্ধকার হয়ে থাকে বলে এলাকায় চুরি-ডাকাতি হয় প্রায়ই।'

সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে খেলার মাঠ, কমিউনিটি সেন্টার, পার্কের সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দাবি জানান ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের নোয়াখোলা এলাকার বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন।

তিনি বলেন, 'এসব কাজের জন্য মেয়র-কমিশনারের সদিচ্ছা থাকলেই হবে। কমিউনিটি সেন্টার, মাঠ, পার্ক যুব সমাজের জন্য একটা খেলার মাঠ খুবই দরকার।'

সিটি করপোরেশনের গিয়েও কোনো লাভ হয়নি মন্তব্য করে বরুয়ার বাসিন্দা কিতাব আলী বলেন, 'ডোবা-নালা ভরাট কইরা ঘরবাড়ি হইছে। বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। পানি নাই, গ্যাস নাই, সড়ক বাতি নাই, জলাবদ্ধতা দূর করার উদ্যোগ নাই।

সিটি করপোরেশনের যে সুযোগ-সুবিধা, হেই জিনিস নাই আমাগো এলাকায়। এই কারণে পুরাই লস আমাগো। ইউনিয়ন পরিষদ থাকলেই ভালো আছিল, ট্যাক্স দেওয়া লাগত না।'

২০১৬ সালের ৯ মে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সভায় ঢাকার আশপাশের ১৬টি ইউনিয়নকে সিটি করপোরেশনে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। সে বছর ২৮ জুন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে নতুন ১৬টি ইউনিয়ন যুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করে সরকার।

ইউনিয়নগুলো যুক্ত হওয়ায় ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার আয়তন ১২৯ বর্গকিলোমিটার থেকে বেড়ে ২৭০ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়ায়। নতুন এসব এলাকাকে নিয়ে দুই সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড সংখ্যা ৩৬টি বাড়ে।

ডিএনসিসিতে যুক্ত বাড্ডা, ভাটারা, সাঁতারকুল, বেরাইদ, ডুমনি, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও হরিরামপুর ইউনিয়ন নিয়ে গঠন করা হয়েছে ৩৭ থেকে ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড। বিডি নিউজ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<85463 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1