বাংলাদেশ ক্রিকেটে দুটি প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। সেরা অলরাউন্ডার ও সেরা অধিনায়ক কে? এই দুই প্রশ্নে ভোটাভুটি হলে নিশ্চিত সাকিব আল হাসান ও মাশরাফি বিন মর্তুজা যে ভোট পাবেন, রাজনীতিতে তাকে বলে ভূমিধস বিজয়! তাদের এই জয় যে শুধু আবেগের ছড়াছড়িতে তা কিন্তু নয়, ক্রিকেটীয় রেকর্ডই তাদের হয়ে কথা বলছে। তারা নিজেকে তৈরিই করেছেন অনেকের চেয়ে একটু ভিন্নতায়।
ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির মেয়াদটা সবচেয়ে বেশি দীর্ঘ। অধিনায়ক হিসেবে শুরু করেছিলেন সেই ২০১০ সালে। মাঝে কিছুদিন ইনজুরির কারণে দলের বাইরে থাকায় সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম সেই দায়িত্বটা সামাল দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের আগেভাগ থেকে দ্বিতীয় মেয়াদে অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর থেকে এখনো মাশরাফি সেই সিংহাসনে। এই সময়কালে টি২০ দলের অধিনায়কও মাশরাফিই ছিলেন। কিন্তু ২০১৭ সালে শ্রীলংকা সফরের সময় হঠাৎ টি২০ দল থেকে সরে দাঁড়ান। আন্তর্জাতিক টি২০কে বিদায় জানান। ক্রিকেট বোর্ড অনেক সাধাসাধি করেও তার সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেনি। তবে এবার বিশ্বকাপে যাবার আগে স্পষ্ট করেই মাশরাফি জানিয়ে দিয়েছেন- 'এটাই আমার শেষ বিশ্বকাপ।'
খেলাটাও এখানেই ছেড়ে দিচ্ছেন কি না সেটা এখনো চূড়ান্ত করেননি। খুব বেশি দূরের চিন্তা করার চেয়ে কাছের পরিকল্পনা সফল করতেই বেশি আনন্দ তার।
২০০১ সালের ৮ ডিসেম্বর ওয়ানডে দলে যখন মাশরাফির অভিষেক হয় তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ নিয়মিত হারত। এমনকি জিম্বাবুয়েও তখন চোখ রাঙাত! খেলোয়াড়ি জীবনে ক্যারিয়ারের প্রথম ১২ ওয়ানডেতে টানা হার দেখেছেন মাশরাফি। ১৩ নম্বর ম্যাচে এসে প্রথম জয়ের দেখা পান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেটা ছিল তার খেলা ম্যাচে প্রথম জয়। তারিখটা ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর। প্রতিপক্ষ ভারত। ভেনু্য বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম।
নিজের প্রথম জয়ের সেই ম্যাচে মাশরাফিই ব্যাটে-বলে সেরা পারফরমার। ম্যাচসেরা। অপরাজিত ৩১ রানের সঙ্গে ২ উইকেট। ভারতের বিপক্ষে ১৫ রানের জয়ে তার পারফরমেন্সটাই সেরা। ১৩ নম্বর সংখ্যাকে সাধারণত অনেকেই 'আনলাকি' ভাবেন। কিন্তু নিজের সেই ১৩ নম্বর ম্যাচেই মাশরাফি বদলে দিলেন নিজের এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভাগ্যকে।
বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ৭৭টি আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন মাশরাফি। জিতেছেনও বাংলাদেশের অধিনায়কদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৪টি ম্যাচ। জয়ের শতকরা রেকর্ড বাংলাদেশের অধিনায়কদের মধ্যে তারই সর্বোচ্চ ৫৮.৬৬!
পেছনের চার বছরে দেশ ও দেশের বাইরে মিলিয়ে ৯টি ওয়ানডে সিরিজ জয়। অধিনায়ক হিসেবে ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শক্তিশালী দলকে ওয়ানডে সিরিজে প্রথমবারের মতো হারানো। টানা দুই বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দেয়া। পুরো দলকে বন্ধুর স্নেহে বাঁধেন, আবার অভিভাবকের মতো পাশে দাঁড়ান। দুই পায়ে সবমিলিয়ে ছয়টা অস্ত্রোপচার হয়েছে। তারপরও শুরুতে, নয়তো মাঝে অথবা ডেথ ওভারে-দলের যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে নিংড়ে দিতে চলে আসেন। এখনো যে কায়দায় ফিল্ডিং দেন, ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটির ইঞ্চিখানেক ওপর থেকে একহাতে ক্যাচ ধরেন, পুরোটা সময় জুড়ে যে এনার্জি খরচ করেন, সেই দুরন্তপনায় পুরোদস্ুত্মর গ্রামের কিশোরের চঞ্চল বিচরণ যেন!
অধিনায়ক মাশরাফির মানেই তার কথায়, উপস্থিতিতে এবং পারফরমেন্সে পুরো দলের চনমনে চাঙা হয়ে ওঠা। ঝিমিয়ে পড়া দলকে কীভাবে তাতিয়ে তুলতে হয়, দলের প্রত্যেকের ভেতর থেকে সেরা খেলাটা বের করে আনার তাগিদ জাগিয়ে তুলতে হয়- সেটা অধিনায়ক মাশরাফির চেয়ে বেশি আর কারো জানা নেই সম্ভবত। ক্রিকেট মাঠে টিম ম্যানেজমেন্ট বলে একটা কথা আছে। সেই ম্যানেজমেন্টে মাশরাফি ওস্তাদ ক্রিকেটার।
বাংলাদেশের সাফল্য মানেই তাতে মাশরাফির কিছু না কিছু ভূমিকা অবশ্য থাকবে। এখন পর্যন্ত ওয়ানডে ক্রিকেটে মাশরাফি যেসব ম্যাচে তিন বা তার চেয়ে বেশি উইকেট পেয়েছেন, এমন ৩৩টি ম্যাচের ২২টিই বাংলাদেশ জিতেছে।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে দেড় যুগের পথচলা। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অনেক রং দেখা হয়ে গেছে মাশরাফি বিন মর্তুজার। সাফল্যের আলোয় সিক্ত হয়েছেন, হতাশার আঁধারে হয়েছেন ম্স্নান। ভালো সময়ের দোলা, খারাপ সময়ের ঝাপটা, সবই লেগেছে গায়ে। তবে ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলার আনন্দ, প্রতিপক্ষের কাছ থেকে সত্যিকারের সমীহ মিলিয়ে এই সময়ই সবচেয়ে উপভোগ্য লাগছে মাশরাফির কাছে।
এই অনুপ্রেরণা নিয়ে আরও সামনে এগিয়ে যেতে চান বাংলাদেশ অধিনায়ক। দেশের ক্রিকেটকে দেখতে চান আরও উচ্চতায়, 'আশা করি, আমরা আরও ওপরে যাব। একটা পর্যায় থেকে আমরা পরের পর্যায়ে আসতে পেরেছি। এই ধরনের টুর্নামেন্টে ভালো কিছু করলে আরও ওপরের ধাপে যাব। তবে বাংলাদেশ দলকে ওরা সবাই দারুণ সমীহ করছে, এটা ভালো লাগার ব্যাপার।'