বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্থানীয় ‘কাসাভার’ চাহিদা বাড়ছে শিল্পকারখানায়

ইমদাদ হোসাইন
  ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
কাসাভা অনেকের কাছে অপরিচিত হলেও ‘শিমুল আলু’ নামে বেশ পরিচিত। দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে বহু বছর ধরে অনেকটা অবহেলায় চাষ হওয়া এ জাতীয় উদ্ভিদটি এখন বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় অথর্করী ফসল

দেশের শিল্পখাতে স্থায়ীয় ‘কাসাভার’ ব্যবহার ও চাহিদা বাড়ছে। ফলে এর উৎপাদনেও এগিয়ে এসেছে শিল্পখাত সংশ্লিষ্টরা। গত বছরে দেশে এই সবজির উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বতর্মানে দেশে এই পণ্যের চাহিদার মাত্র ২ শতাংশ উৎপাদিত হয়। আর বাকিটুকু থাইল্যান্ড, ভারত ও ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করতে হয়।

কাসাভা অনেকের কাছে অপরিচিত হলেও ‘শিমুল আলু’ নামে বেশ পরিচিত। দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে বহু বছর ধরে অনেকটা অবহেলায় চাষ হওয়া এ জাতীয় উদ্ভিদটি এখন বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় অথর্করী ফসল। দেশের বাজারে এর প্রচুর চাহিদা ও সম্ভাবনা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু সরকারি ও বেসরকারি পযাের্য় যথাযথ উদ্যোগ।

প্রাণ-আরএফএল গ্রæপ জানিয়েছে, ২০১৮ সালে ৬ হাজার একর জমির মধ্যে ৩০ হাজার টন কাসাভা উৎপাদন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৭০০ একর জমিতে ১৪ হাজার টন উৎপাদন করেছিল।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে সাড়ে তিন লাখ টন স্টাচর্ আমদানি হয়। দেশে উৎপাদিত হয় ছয় হাজার টনের মতো। বাকিটা ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হয়। দেশে ২০১৪ সাল থেকে প্রাণ চুক্তিভিত্তিক কাসাভার চাষ শুরু করেছে প্রাণের তত্ত¡াবধানেই বছরে এখন প্রায় ছয় হাজার একর জমিতে কাসাভা আবাদ হচ্ছে। বিশেষ করে পাহাড়ি ও টিলায় এটি ভালো হয়। তবে উন্নত জাতের পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সম্পৃক্ততা চান কৃষকরা।

জানা গেছে, কাসাভার রস থেকে পাউডার তৈরি হয়। এ পাউডার তরল করে স্টাচর্ হিসেবে ব্যবহার করা হয় দেশের বস্ত্র ও ওষুধ শিল্পে। বস্ত্র শিল্পে সুতা ও কাপড়ের স্থায়িত্ব বাড়াতে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে স্টাচর্ আমদানি করা হয়। সাধারণ মানুষ যেমন সুতি শাড়িতে ভাতের মাড় ব্যবহার করে, তেমনি বস্ত্র খাতে সুতা ও কাপড়ে স্টাচর্ ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া কাসাভা থেকে গøুকোজ, বালির্, সুজি, রুটি, নুডলস, ক্র্যাকাসর্, কেক, পাউরুটি, বিস্কুট, পঁাপর, চিপসসহ নানাবিধ খাদ্য তৈরি করা যায়।

বাংলাদেশে ৮-১০ বছর আগে এ কাসাভা চাষ শুরু হলেও এটি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে খুব দ্রæত। বতর্মানে দেশে প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে কাসাভা আবাদ হয়। পাহাড়ি এলাকায় কাসাভা আবাদ বেশি হচ্ছে। ফসলটির চাষ তুলনামূলকভাবে সহজ ও লাভজনক। সীমিত পরিচযার্ ও খরচে সমতল, পাহাড়ি, অনাবাদি ও অপেক্ষাকৃত কম উবর্র জমিতে এটি চাষ করা যায়। সাধারণত গাছ লাগানোর এক বছর পর এর ফলন পাওয়া যায়। কাসাভার চারা রোপণ এবং ফসল তোলার উপযুক্ত সময় নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর। এতে তেমন কোনো সার প্রয়োগ করতে হয় না। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য হেক্টরপ্রতি ১৮০-২০০ কেজি নাইট্রোজেন, ১৫-২২ কেজি ফসফরাস ও ১৪০-১৬০ কেজি পটাশিয়াম প্রয়োগ করলে সবাির্ধক ফলন পাওয়া যায়। কাসাভা চাষে সাধারণত সেচের প্রয়োজন হয় না। দীঘির্দন খরা অবস্থা বিরাজ করলে হালকা সেচের ব্যবস্থা করা হলে ফলন বৃদ্ধি পায়। চারা গজানোর পর তিন মাস অন্তর গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করে গোড়ায় মাটি তুলে দিলে ফলন বৃদ্ধি পায়। গাছের উচ্চতা ৫ থেকে ৯ ফুট পযর্ন্ত হয়। প্রতি একর জমি থেকে ছয়-সাত টন কাসাভা পাওয়া যায়। এর পাতা ও অবশিষ্ট অংশ জমিতে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

প্রাণ অ্যাগ্রো বিজনেসের সূত্রে জানা গেছে, দেশের শিল্পখাতে কাসাভার চাহিদা সাড়ে ৩ লাখ টন। বিপরীতে দেশের চাষিরা মাত্র ৬ থেকে ৭ হাজার টন উৎপাদন করতে সক্ষম। তারপরও আশার কথা, দেশের শিল্পখাতের চাহিদার বিপরীতে প্রতি বছর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ উৎপাদন বাড়ছে। এর উৎপাদন বাড়াতে হলে চাষী ও এই খাতের সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে। বিশাল এলাকাজুড়ে এর উৎপাদন করা প্রয়োজন। কাসাভার মূল শত্রæ হলো জলাবদ্ধতা। বন্যা ও অনবরত বৃষ্টির কারণে ২০১৭ সালে এর উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। অথচ ২০১৬ সালে মাত্র ৭০০ একর জমিতে প্রত্যাশার চেয়েও ১ হাজার টন বেশি উৎপাদিত হয়েছিলো।

কৃষিতে স্নাতক করা রাজিব কুমার রায়। তিনিও জানান, মাত্র ২ থেকে ৩ দিনের জলাবদ্ধতার কারণে পুরো ফলনই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ জন্য এই সবজি চাষের জন্য পাহাড়ি কিংবা উঁচু জমিতে চাষাবাদের জন্য জায়গা পছন্দ করা দরকার। অন্যান্য ফসলের মতো এই সবজি চাষের জন্য কোনো ধরনের সারের প্রয়োজন হয় না। এটি চাষে লাগে না কোনো প্রশিক্ষণ। খুব কম খরচে ও সহজে কাসাভা চাষ করা যায়।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কৃষক লিটন দত্ত এ বছর ২০০ একর জমিতে কাসাভা চাষ করছেন। তিনি প্রত্যাশা করছেন, ১ হাজার ৪০০ টন কাসাভা উৎপাদিত হলে ২০ লাখ টাকা লাভ করতে পারবেন। তিনি জানান, প্রতি একর জমিতে ৬ টন কাসাভা পেতে হলে ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। এটি চাষাবাদের সময়ই বছরে দুইবার অন্যান্য ফসল চাষ করেও ১৪ থেকে ১৫ টন পাওয়া যায়।

মাসুক মিয়া একজন মুদি দোকানি। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর ও সিলেটের কানাইঘাটে প্রাণ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে সাড়ে ৩০০ একর জমিতে কাসাভা চাষ করছেন।

প্রাণ কতৃর্পক্ষ বলছে, তারা প্রতি একরের জন্য কৃষককে ১৭ হাজার টাকা ঋণ দিচ্ছেন। এর বিনিময়ে তারা কৃষকের কাছ থেকে সাড়ে ৭ টাকা কেজি দরে কিনে আনেন। প্রতি একর সব খরচ বাদ দিয়েও কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব।

অবশ্য মাসুক মিয়ার অভিযোগ, স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে কাসাভা বিষয়ে তথ্য জানতে গিয়ে তিনি কখনও কোনও সহযোগিতা পাননি। এটিকে কিভাবে চাষ করতে হয়, কিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়- তারা কিছুই জানাতে পারেনি।

বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিসাসর্ ইনস্টিটিউটের (বারি) প্রধান বৈজ্ঞানিক কমর্কতার্ বিমল চন্দ্র কুÐ জানান, কাসাভার ব্যাপক চাষাবাদের লক্ষ্যে মূলত বড় ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা নেই। ফিলিপাইন ও ভারত এ বিষয়ে যেভাবে গবেষণা করেছে বারি সেভাবে গবেষণা করতে ব্যথর্ হয়েছে বলেও জানান তিনি।

সীমদ্ধতার কথা জানিয়ে তিনি জানান, কোনো দেশ থেকে এর বীজ সংগ্রহ করতে হলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিড উইং থেকে অনুমোদন ও সংশ্লিষ্ট দেশের সাটিির্ফকেট নিতে হয়।

তিনি বলেন, বারি ইতোমধ্যে ভারতের তামিলনাড়– থেকে বীজ সংগ্রহ করে এর উচ্চ ফলনের জন্য গবেষণা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অথৈর্নতির উন্নতির স্বাথের্ই আমাদের গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। শিল্পখাতে এই সবজির বহুজাতিক ব্যবহারের জন্য আরও উন্নত পদক্ষেপ নেয়া হবে।

এদিকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কাসাভা নিয়ে কাজ শুরু পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই)। প্রথমে আলু থেকে স্টাচর্ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়ে তা থেকে সরে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। কাসাভা চাষের উপযোগী ভ‚মি ও কৃষকদের আগ্রহের বিষয়টি মাথায় রেখে ভবিষ্যতে একটি প্রকল্প হাতে নেয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে বিএআরআইয়ের।

বিএআরআইয়ের সূত্রে জানা গেছে, ওষুধ শিল্প, টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন শিল্প খাতে স্টাচের্র চাহিদা অনেক। আমাদের দেশে প্রায় সবই আমদানি করতে হয়। তারা আলু থেকে এ স্টাচর্ উৎপাদনের একটি পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। তবে আলুর দামের চেয়ে স্টাচের্র দাম বেশি না হওয়ায় তা বাস্তবায়নযোগ্য হয়নি। স্টাচর্ কাসাভা থেকে উৎপাদন করলেই যথোপযুক্ত হবে। কাসাভা চাষ বাংলাদেশে নতুন হওয়ায় তারা তা নিয়ে খুব বেশি কাজ করার সুযোগ পায়নি। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে একটি জাত দেখে এসেছি। কাসাভা নিয়ে তাদের একটি গবেষণার পরিকল্পনা রয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত কাসাভা দেশের কোথায় হচ্ছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<35008 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1