বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপত্তা সঞ্চিতিকে ১৩ ব্যাংকের থোড়াই কেয়ার

১৩ ব্যাংকের ঘাটতি ১৩ হাজার কোটি টাকা
ইমদাদ হোসাইন
  ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সরকারের কাছ থেকে সব সুবিধা আদায় করলেও ব্যাংক মালিকরা প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ী ব্যাংক খাতের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে আনছেন না। কোন ঋণে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট হবে সে বিষয় নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। মূলত, শিল্পঋণ বাদে অন্যান্য ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামেনি। ফলে সুদের হার বেশি হওয়ায় প্রতিনিয়ত খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আর খেলাপি ঋণ বাড়ার ফলে বাড়ছে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) ঘাটতিও। খেলাপি ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে ব্যর্থ হওয়া ব্যাংকের সংখ্যাও বাড়ছে। আর প্রভিশন ঘাটতি হওয়ার মানে ব্যাংকের ভিত্তিও দুর্বল হয়ে পড়া।

ব্যাংক গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত নিয়ে তা আবার গ্রাহককেই ঋণ হিসেবে বিতরণ করে। আর এ আমানতের সুরক্ষার জন্য ব্যাংকগুলোকে বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে বিভিন্ন হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জুন শেষে ১৩টি ব্যাংক তাদের প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি। এর মধ্যে ৮টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংকগুলো আর্থিকভাবে দুর্বল হয়। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি বাড়ার কারণেই প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে। যেসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে তাদের মূলধন ঘাটতি হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। তাই সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে জনগণের আমানত ফিরিয়ে আনতে কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় বেশিরভাগ ব্যাংকের হাতে আর বিনিয়োগ করার মতো তহবিল থাকবে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত জুন শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৭৩ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে বেসিক ব্যাংক। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৯৮২ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ৮৫২ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে গত তিন মাসে ৬০০ কোটি টাকা বেড়ে ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১২৮ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি বেড়ে ৭২৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা হয়েছে। গত মার্চে ব্যাংকটির ঘাটতি ছিল ৬৮৮ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ১৯১ কোটি টাকা। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৩ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৫১১ কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১২৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১০৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ও ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ১৮৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, গত জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হার ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের স্থিতি ৯ লাখ ৬২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। এর বাইরে খেলাপি হওয়া ঋণ রাইট অফ বা অবলোপন হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ হিসেবে দেশের ব্যাংক খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে এক লাখ ৬২ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। খেলাপির হার দাঁড়াবে ১৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

ঋণ শ্রেণিকরণের তিনটি পর্যায় রয়েছে। তা হলো- নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দ বা ক্ষতি। এই তিনটি পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণ নিম্নমান হলে তার বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ২০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।

পরপর ছয় মাস ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সে ঋণকে সন্দেহজনক ঋণ বলা হয়। এ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ৫০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর ৯ মাস অতিবাহিত হলে ওই ঋণকে মন্দ ঋণ বলা হয়। এ মন্দ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে টাকা এনে। যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি ওই ব্যাংকের আয় খাত থেকে বেশি পরিমাণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। বেশি প্রভিশন সংরক্ষণ করলে ওই ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়।

প্রভিশন ঘাটতির কারণ সম্পর্কে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসা মন্দা, ব্যাংকিং খাতে ঋণ কেলেঙ্কারি ও চলমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমেছে। বেড়েছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। সব মিলিয়ে এবার ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমে গেছে। অতিরিক্ত প্রভিশন রাখতে গিয়ে অনেক ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা না হয়ে বরং লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে।

আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে ঋণের শ্রেণিমান বিবেচনায় প্রতি ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত হারে প্রভিশন রাখতে হয়। সাধারণ ঋণের বিপরীতে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে শুরু করে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখার নিয়ম রয়েছে। আর যথাসময়ে আদায় না হওয়া নিম্নমান, সন্দেহজনক এবং মন্দ বা ক্ষতি মানে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে যথাক্রমে ২০, ৫০ ও ১০০ ভাগ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। ব্যাংকগুলোর অর্জিত মুনাফা থেকে এ অর্থ রাখার নিয়ম রয়েছে। সাধারণ নিয়মে প্রভিশন ঘাটতি রেখে লভ্যাংশ দেয়ার নিয়ম না থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ব্যাংক ধাপে ধাপে প্রভিশন রাখার সুযোগ নিয়ে লভ্যাংশ দিচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন সংরক্ষণের পরিমাণও বাড়ছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে দেশের ব্যাংকগুলোতে ১৯ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<65835 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1