শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নূ্যনতম মুনাফা নিশ্চিতই পুঁজিবাজারের মূল চ্যালেঞ্জ

নূ্যনতম লাভ দিতে না পারলে বাজার স্থিতিশীল অবস্থানে আসবে না ম গত নয় বছর ধরে বাজার পতনের দিকে ম এ ধরনের পতনের নজির নেই বিশ্বের কোনো পুঁজিবাজারে ম ৬০ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার দর ফেস ভেলুর নিচে
আহমেদ তোফায়েল
  ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০
ডিএসইর নতুন ভবন -ফাইল ছবি

শেয়ার বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা এখন শূন্যের কোঠায়। বিনিয়োগ করে বাজার থেকে কোনো মুনাফা তুলতে না পারেন তাহলে কেন তারা বাজারে আসবেন বা থাকবেন। তাদের নূ্যনতম লাভ দিতে না পারলে বাজার স্থিতিশীল অবস্থানে ফিরে আসবে না বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নত থেকে শুরু করে উদীয়মান সব পুঁজিবাজারেই উত্থান-পতন হয়। একবছর উত্থান হয় তো পরের বছর পতন। পতনের কিছুদিন পরই দেখা যায়, আবার মার্কেট উত্থান এবং সেটিও আগেরটিকে ছাড়িয়ে পৌঁছায় নতুন উচ্চতায়। আর আমাদের দেশে পুঁজিবাজার মানেই মন্দা। ২০১০ সালে বাজারে যে উত্থান হয়েছিল এরপর গত নয় বছরে এখন পর্যন্ত পতনের মধ্যেই আছে। এর বড় কারণ হলো- আমাদের দেশে পুঁজিবাজারের উত্থান কখনোই তার নিজস্ব শক্তিমত্তা দিয়ে হয়নি।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের প্রায় সব দেশের পুঁজিবাজারে নিয়মিত বিরতিতে উত্থান-পতন ঘটে। আর পতন হলেও বিনিয়োগকারীদের সাধারণত রাস্তায় নামতে দেখা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে কিছুদিন পরপর বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। কারণ পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কষ্টের পুঁজি হারিয়ে গেলে বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নামবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নামলে পুঁজিবাজারের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। অথচ প্রতিদিন বাজারের সূচক পড়ছে এবং নিম্নমানের কোম্পানি বাজারে আনা হচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিকভাবে বাজারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে না? আর বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নামলেই ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। বিষয়টি আসলেই হাস্যকর।

এদিকে প্রতিনিয়ত আস্থার সংকটে পড়ছে পুঁজিবাজার। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে না। গ্রামীণফোনের কাছে পাওনা আদায় নিয়ে টানাপড়েন চলছে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। আসলে পুঁজিবাজার এলোমেলোভাবে চলছে। যারা পুঁজিবাজারের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত অর্থাৎ যাদের দেখভাল করার কথা তারা সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। বাজারের এ দুরবস্থা এবং অব্যবস্থাপনার খবর প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত যাচ্ছে না। এটা বাজারের জন্য শঙ্কার বিষয়। কারণ যেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাজারের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ প্রণোদনা থাকবে। কিন্তু যথাযথ মহল বাজারের সঠিক তথ্য তাকে জানাচ্ছে না এবং বাজেটে তেমন কোনো প্রণোদনা পলিসিও আনতে পারেনি। আবার ইকুইটির বিপরীতে ভালো কোনো পণ্য নেই। শুধু ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যাংক ও আর্থিক খাতের কোম্পানির শেয়ার রয়েছে। এ দুটি খাত এখন নড়বড়ে অবস্থায়। যার প্রভাব বাজারে দেখা যাচ্ছে। এটা দেখার দায়িত্ব কার? মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো নিম্নমানের কোম্পানি আনছে। যারা এসব কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে সই করছে তারা দায় এড়াতে পারে না। আবার মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বাজারে তেমন সক্ষমতা দেখা যাচ্ছে না। একজন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর যে ভূমিকা পালন করার কথা সেটিও দেখা যাচ্ছে না। এ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এটাও কিন্তু বিনিয়োগকারীদের অনাস্থার একটি কারণ।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালে বাজার ধসের পর প্রায় ৮৫ থেকে ৯০টি কোম্পানি বাজারে এসেছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারদর ফেস ভেলুর নিচে রয়েছে। আসলে এসব কোম্পানি ভালোভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়নি। গত পাঁচ থেকে ছয় বছরে বাজার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে দেখা যায়নি। কথা হচ্ছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজে যদি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং ভালো কিছুর প্রতিফলন না পাওয়া যায়; সে ক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা থাকে না।

অন্যদিকে ২০১০ সালে বাজারে যে উত্থান হয়েছিল সেটি হয়েছিল হঠাৎ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে ঝাঁপিয়ে পড়ায়। সে বছর ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানও তাদের মূল ব্যবসায়িক কার্যক্রমে মনোযোগ কমিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে। ফলে সূচক কোনো কারণ ছাড়াই ধাই-ধাই করে বেড়ে যায়।

আবার, পুঁজিবাদের নিয়ম হচ্ছে যেখানে মুনাফা সেখানেই পুঁজি। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে মন্দা থাকুক আর উত্থান হোক গুটি কয়েক মানুষ এখানে প্রতিনিয়তই মুনাফা করছে। এরা এসব শেয়ারের দাম বাড়ানোর জন্য নানাভাবে কারসাজি করে। যেখানে সাধারণ মানুষ মুনাফা করতে পারে না, সেখানে মুনাফা করে এসব কারসাজিকারীরা। এসব শেয়ারেই মূলত সাধারণ বিনিয়োগকারীরা টাকা হারান। মুনাফা থাকলেও তা গুটিকয়েকের জন্য।

তবে বিশ্বের সবদেশেই পুঁজিবাজারে অল্প-স্বল্প কারসাজি হয়। উদীয়মান মার্কেটগুলোতে তা একটু বেশি হয়। হলেও তার জরিমানা হয় কিংবা অন্যভাবে শাস্তির আওতায় আনা হয় কারসাজিকারীদের। যেমন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রভাবশালী ধনকুবের এবং রিলায়েন্সের কর্ণধার অনিল আম্বানিকে শেয়ার লেনদেনে আইন অমান্য করার দায়ে ২০১১ সালে সেদেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা (সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া) জরিমানা হিসেবে ৫০ কোটি রুপি আদায় করে। পাশাপাশি তাকে এক বছরের জন্য পুঁজিবাজারের যে কোনো লেনদেন থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। এ ঘটনায় ভারতের অন্য কারসাজিকারীরাও সচেতন হয়। পাশাপাশি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থাও বৃদ্ধি পায়।

অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রতিদিনই কোনো না কোনো শেয়ারে কারসাজির প্রক্রিয়া চলতে থাকে। কয়েকজন মিলে শেয়ার কিনতে থাকে। এরপর তাদের কেনা হয়ে গেলে ছড়ানো হয় গুজব। কখনো কখনো কোম্পানিকে সঙ্গে নিয়েও নানাভাবে বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করা হয়। ব্যস, সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও এসব গুজবে কান দিয়ে শেয়ার কিনতে শুরু করেন, এরপর শুরু হয় কারসাজিকারীদের শেয়ার বিক্রির পালা। প্রতিনিয়তই চলছে এ প্রক্রিয়া। কিন্তু এ ব্যাপারে বিএসইসির তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই, তেমন কারো বিচারও হয় না। দুই-একটি যাও হয়, তাও তা সংখ্যায় এতোটাই কম যে কারসাজিকারীরা তাতে থোরাই কেয়ার করে।

প্রকৃতপক্ষে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিএসইসি আসল জায়গাতেই হাত দেয়নি। সেটি হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর জন্য কারসাজিকারীদের শাস্তি দেয়া- যেন কারসাজি উলেস্নখযোগ্য মাত্রায় কমে আসে। পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার জন্য কার্যকর উদ্যোগও নেয়া হয়নি। বিএসইসি যদি সত্যিকার অর্থেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে কারসাজি বন্ধ করে এবং কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানিকে বাজারে তালিকাভুক্ত করে তখন অনেক বিনিয়োগকারী এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন।

এদিকে সবার প্রত্যাশা ছিল পুঁজিবাজার নিয়ে বাজারের অংশীজনদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কমালের বৈঠকের পর বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু তা না হয়ে উল্টো দরপতন হচ্ছে বাজারে। কোনো কিছুতেই বাজারে আস্থা ফিরছে না। পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে সোমবার বাজারের সকল অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী। বৈঠকে বাজারে কোনো ধরনের গড়বড় হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বিএসইসির অধীনে একটি বিশেষ কমিটি কাজ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।

'ইন্টারনাল অডিট কমিটি' নামের এই কমিটি কোম্পানিগুলো যাতে শেয়ারের ন্যায্যমূল্য পায়, কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম যেন অতিমূল্যায়িত না হয় সেদিক নজর রাখবে এই কমিটি। ২০১০ সালে বড় ধসের পর ২০১৭ সাল থেকে পুঁজিবাজারে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে; ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৬ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু তার পরের বছর আবার কমতে শুরু করে সূচক।

২০১৯ সালে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে সবাই প্রত্যাশা করলেও তেমনটি হয়নি। দিন যতো যাচ্ছে বাজারের অবস্থা ততোই খারাপ হচ্ছে। ডিএসইএক্স ৫০০০ পয়েন্টের নিচে নেমে এসেছে। লেনদেন নেমে এসেছে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার ঘরে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<67783 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1