শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তাব

নতুনধারা
  ২৯ মার্চ ২০২০, ০০:০০
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বাংলাদেশ উচ্চ স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়েছে। তিন মাস ধরে ধীরে ধীরে এই ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে। উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যেও সব পক্ষ নিজেদের করণীয় নির্ধারণে সচেষ্ট ছিল। এটি এখন বৈশ্বিক মহামারি। ফলে অন্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সীমিত হচ্ছে, রপ্তানির বাজার সংকুচিত হচ্ছে, সরকারি ঘোষণায় জন ও যান চলাচল সীমিত করা হচ্ছে, ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসা বন্ধ, আর দিনমজুর ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের রুটি-রুজি যখন বন্ধ, তখন আমাদের অসহায়ত্বের চূড়ান্ত রূপ প্রকাশিত হয়েছে।

স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সরকারের সহযোগিতার রূপরেখা পাওয়া গেল। এর আগের এক সপ্তাহে আমরা সরকারের ভাবনার প্রতিফলন দেখে এসেছি। অনেকেই অনেক দাবি করেছেন। সরকারের সীমিত সামর্থ্য সত্ত্বেও ঘোষিত এই সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে কিছু প্রস্তাব দিতে চাই।

সরকারের ঘোষিত সহযোগিতার মূল সুরটি হলো এ রকম: এই দুর্যোগকালে শ্রমজীবী মানুষের নূ্যনতম চাহিদা মেটানো। মূলত তিনটি আলাদা ক্ষেত্রে সহযোগিতা ঘোষিত হয়েছে ক) সব ধরনের ব্যবসা উদ্যোগের জন্য, খ) রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য এবং গ) অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের জন্য। এসব উদ্যোগের কিছু বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

ক. সব ধরনের ব্যবসা উদ্যোগ :বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত ঋণের কিস্তি প্রদানের মেয়াদ ৬ মাসের জন্য বাড়িয়েছে। আমদানিপত্রের ক্ষেত্রে বিল অব এন্ট্রির মেয়াদ ৬ মাস থেকে ১ বছরে নিয়ে যাওয়া উদ্যোগ হিসেবে ইতিবাচক। তবে ৬ মাস ঋণের কিস্তি ফেরতের মেয়াদ বাড়লেও সুদ গণনা চক্রবৃদ্ধির নিয়মে হবে বলে ব্যবসায়ীরা অনুযোগ করছেন। এ ক্ষেত্রে ঋণের সুদের হিসাব সাধারণ নিয়মে অথবা স্থগিতের সুযোগ রাখা যায় কি না, তা বাংলাদেশ ব্যাংক ভেবে দেখতে পারে। অন্যদিকে বিদু্যৎ-গ্যাস ও পানির বিল বিলম্ব ফি ছাড়া পরিশোধের সময় মে-জুন পর্যন্ত বাড়ানোর ফলে ব্যবসায়ীরা ক্যাশ ফ্লোতে কিছুটা স্বস্তি পাবেন, যা দিয়ে দৈনন্দিন ব্যয় মেটানো যেতে পারে। তবে এ ধরনের উদ্যোগে ক্ষদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা এতে খুব একটা সুবিধা পাবেন বলে মনে হয় না। তাদের জন্য আলাদা সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করা যেতে পারে। রপ্তানি খাতের মতো দেশীয় বাজারভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পূর্ণ অর্থায়ন তহবিল থেকে সহায়তা দিলে উপকার হবে।

খ. রপ্তানিমুখী শিল্প উদ্যোগ :দেশীয় ব্যবসা হিসেবে তারা ঋণ দেরিতে পরিশোধ করতে পারবেন। এ ছাড়া তাদের আমদানির বিল মেটানোর সময় বৃদ্ধি ও সরকারি পরিষেবার বিল বিলম্ব ফি ছাড়া প্রদানের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানির অর্থ জমা দেওয়ার সময় বাড়িয়ে চার মাস থেকে ছয় মাস করেছে, যা তাদের উপকারে আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো রেট কমিয়ে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং সিআরআর ৫ শতাংশ কমিয়ে অর্থ সরবরাহ প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বাড়িয়েছে। এতে ক্যাশ ফ্লো বাড়বে। রপ্তানিকারকেরা এ সুবিধা পাবেন। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকা বিশেষ প্রয়োজন। ভারতনির্ভর আমদানি পণ্য অন্যান্য উৎস থেকে আনার প্রয়োজন হতে পারে। এদিকে নজর রাখা জরুরি

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগটি ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী ৫০০০ কোটি টাকার রপ্তানি শিল্প প্যাকেজ, যা শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ খরচ করা হবে, প্রাথমিক উদ্যোগ। আগামী দিনে দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীরা সঙ্গে যুক্ত হলে এই পরিসর আরও বড় হবে। আশা করি, রপ্তানিমুখী কারখানায় আগামী ছয় মাসের বেতন-ভাতা হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল হবে। এককালীন অনুদান যেন না হয় এটি। নূ্যনতম সুদে এই ঋণ উদ্যোক্তারা তিন থেকে নয় মাস সময়ে ফেরত দেবেন। কারখানা ও শ্রমিক বাছাইয়ের কাজটি যেন স্বচ্ছতার সঙ্গে করা হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে যেসব কারখানায়। যেমন ক্ষদ্র ও মাঝারি আকারের এবং সাব-কন্ট্রাকটিং কারখানা সেগুলো যেন প্রাধান্য পায়। এসব কারখানায় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার নূ্যনতম প্রস্তুতি থাকে না, ফলে এ রকম ঝুঁকির সময়ে এগুলোর বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অবশ্যই চলমান কারখানা, বিশেষত মার্চ, ২০২০ সালে চলমান কারখানাগুলো যেন বিবেচনায় নেওয়া হয়। আগে বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা যেন এ তহবিলের বাইরে থাকে। শ্রমিক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই কারখানাগুলোকে শ্রমিকদের ফেব্রম্নয়ারি মাসের বেতনের তথ্যাদি জমা দিতে হবে। কারখানার ইউডি ও মজুরি-সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য অ্যাসোসিয়েশনের স্বাক্ষরে শ্রম মন্ত্রণালয়ের যথাযথ বিবেচনায় ব্যাংক থেকে ঋণের জন্য দেওয়া যেতে পারে। যেহেতু অর্থ সীমিত, সেহেতু শ্রম মজুরির একটা সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে।

গ. অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমজীবী :এদের জন্য ওএমএসের মাধ্যমে ১০ টাকা দরে চাল এবং ন্যায্যমূল্যে অন্যান্য জরুরি খাদ্যদ্রব্য বিক্রয় করা হবে। এ ছাড়া ভিজিডি, ভিজিএফ কার্যক্রমের আওতায় সহায়তা করা হবে। উপযুক্ত তথ্য-উপাত্তের অভাবে এই গোষ্ঠীর বৃহদাংশের এসব সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ ক্ষেত্রে শ্রম অধু্যষিত অঞ্চলগুলোতে ওএমএস কার্যক্রম চালানো বিশেষভাবে জরুরি। পাশাপাশি সরকার ছয় মাসের খাদ্য সরবরাহ করবে, যা এই নির্দিষ্ট উপকারভোগীদের কাজে আসবে। পাশাপাশি জেলা পর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তার উপকারভোগীদের যে তথ্য আছে, তার ভিত্তিতেও এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করা যায়। মনে রাখা দরকার, উপযুক্ত সহযোগিতার অভাবে এদের বড় অংশ আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে।

বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকা বিশেষ প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সরবরাহ চ্যানেল স্বাভাবিক রাখা গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা দরকার, ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশে এই মুহূর্তে ২১ দিনের লকডাউন চলছে। এই অবস্থায় ভারতনির্ভর আমদানি পণ্য অন্যান্য উৎস থেকে আনার প্রয়োজন হতে পারে। এদিকে নজর রাখা জরুরি।

সবশেষে একটি অনুরোধ, ম্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অন্য সবার মতোই গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। করোনার কারণে শ্রমিক অধু্যষিত অঞ্চলে এর বিস্তারের আশঙ্কা আছে। সার্বিক বিবেচনায়, শিল্প-কারখানা অনতিবিলম্বে সাময়িক কালের জন্য ছুটি ঘোষণা প্রয়োজন।

লেখক: খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা

পরিচালক, সিপিডি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<94493 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1