গাজীপুরে রেশম চাষ: গ্রামীণ নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প

প্রকাশ | ১২ নভেম্বর ২০২০, ২১:১৭

আবুল হোসেন, গাজীপুর প্রতিনিধি

 

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার নিভৃতপল্লীতে দুইটি গ্রাম বরহর ও দিঘিরকান্দা”। এ গ্রাম দুইটির অধিকাংশ লোকজনই কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এমতাবস্থায় সেখানকার কৃষকদের জীবনমান উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক দুর্দশা লাগবে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ রেশম বোর্ড।

 

সেখানকার গাঁয়ের কৃষানীদের স্বাবলম্বী করতে তারা এলাকার নারীদের রেশম চাষে উদ্বুদ্ধ করেন। আর সরকারের এমন উদ্যোগে কয়েকবছরেই রেশম চাষ বদলে দিয়েছে ওই গ্রামের নারীদের জীবনধারা। এখন যেন এই রেশমজালেই জড়িয়ে গেছে তাদের স্বপ্ন। ঠিকমত খাওয়া নেই, তাদের সব ভাবনা যেন এখন রেশম চাষ নিয়ে। 

 

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার করিহাতা ইউনিয়নের “দিঘিরকান্দা” ও রায়েদ ইউনিয়নের “বরহর” গ্রাম ঘুরে নারীদের সাবলম্বী হওয়ার এক চিত্র দেখা গেছে। দুটি গ্রামের বাড়ীতে বাড়ীতে এখন তৈরী হয়েছে রেশম চাষের পলু ঘর। রেশম চাষের মাধ্যমে দুই গাঁয়ের নারীদের ঘুরে দাঁড়ানোর চিত্র দেখে আরো অনেককেই আগ্রহী করে তুলছে রেশম চাষে।

 

বরহর গ্রামের জাহেদা আক্তার বলেন, তার স্বামী মাঠে কাজ করেন। সংসারের রান্না-বান্নার কাজ শেষে তাকে বাড়ীতে অলস সময় কাটাতো হতো। স্বামীর স্বল্প আয়ে তথা সামান্য রোজগারে তাদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়াসহ সংসারের নানা খরচ যোগানে সমস্যা হতো। গত ৫বছর আগে তিনি রেশম চাষ শুরু করেন। অবসর সময়টুকুতে রেশম চাষের মাধ্যমে এখন প্রতিবছর তিনি নিজে ১৫/২০হাজার টাকা সংসারের যোগান দেন। এতে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া খরচ চলানোসহ সংসারের খরচ চালিয়ে স্বচ্ছলতার মুখ দেখছেন।

 

এই গাঁয়েরই বধু শিল্পী রানী বলেন, তাদের হিন্দুু পল্লীতেও এখন রেশম চাষে ঝুঁকছে নারীরা। সংসারের অলস সময়ে ঘরে বসে একজন নারী হিসেবে বাড়তি আয় করতে পারছেন তিনি। আগে নিজের বিভিন্ন খরচের জন্য স্বামীর হাতের দিতে তাকে চেয়ে থাকতে হতো।এখন ঘরে বসেই তিনি আয় করতে পারেন। নিজের ও সন্তানদের খরচ মিটিয়ে স্বামীর হাতেও টাকা তুলে দিতে পারেন তিনি। এভাবে নিজের স্বাবলম্বী হওয়াটা তাকে অন্যরকম আনন্দ দেয়।

 

দিঘিরকান্দা গ্রামের কামাল হোসেন বলেন, কিছুদিন আগেও অভাবের সংসার ছিল তার। অভাব মোচনে তার স্ত্রী রেশম চাষ শুরু করেন। তিনি মাঠে কাজ করেন আর তার স্ত্রী বাড়ীতে রেশম ও গবাদি পশু পালন করেন। এতে কয়েকবছরেই তার সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।

 

আঞ্চলিক রেশম সম্প্রসারন কেন্দ্র গাজীপুরের অধিন গাজীপুরের কাপাসিয়া, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় রেশম চাষ হচ্ছে। এ কেন্দ্রের দেয়া তথ্য মতে, গাজীপুরের কাপাসিয়ায় হতদরিদ্র পরিবারের নারীদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে এ চাষ শুরু করা হয় বেশ কয়েকবছর আগে।

 

সমন্বিত প্রকল্পের অধীণে রেশম চাষে নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তাদের এই চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে দুটি গ্রামের ৩০জন নারীর বাড়ীতে পলুু ঘর নির্মাণসহ যাবতীয় আনুসাঙ্গিক বিতরণ করা হয়েছে। রেশম পোকার খাবারের জন্য স্থানীয় বরদার খালের উভয় পাশে ৫ কিলোমিটার এলাকায় তুত গাছ রোপন করা হয়েছে। লাভজনক এই রেশম চাষে এলাকার বহু নারী স্বাবলম্বী হওয়ায় অনেকেই এ চাষে ঝুকছেন। এই এলাকায় দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে রেশম চাষ। সরকারী এ কর্মসূচীর বাহিরেও গ্রামের আরো শতাধিক পরিবারের নারীরা রেশম চাষে নিজেদের পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন।

 

তাদের সহায়তায় রেশম বোর্ড থেকে চলতি বছরে বাড়ী বাড়ী রোপনের জন্য তুত গাছের দেড়হাজার চারা বিতরণ করা হয়েছে। প্রতিটি বাড়ীতে রেশম পোকা বিতরন থেকে গুটি তৈরী পর্যন্ত সবকিছু তদারকি করেন রেশম বোর্ড। পরে উৎপাদিত গুটি কৃষকদের কাছ থেকে কেজি দরে কিনে নিয়ে সুতা উৎপাদন করা হয়। বছরে চারবার রেশম গুটি উৎপাদন করা যায়। প্রতি বছরে ভাদ্র, অগ্রহায়ন, চৈত্র ও জৈষ্ঠ মাসে রেশম গুটি সংগ্রহ করা হয়। কৃষকদের রেশম পোকার ডিম প্রদানের পর কয়েকদিনেই পোকা তৈরী হয়। পরে তুত গাছের পাতা কেটে কুচি কুচি করে পোকার খাবার সরবরাহ করা হয়। এভাবে দেড় মাসের মধ্যেই তৈরী হয়ে যায় গুটি। যেখান থেকে তৈরী হয় রেশম সুতা। বর্তমানে এক কেজি সুতা বিক্রি হয় ৩৫০০টাকায়। প্রতি ৭ কেজি গুটি থেকে ১ কেজি সুতা উৎপাদন করা যায়। 

 

গাজীপুরের আঞ্চলিক কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, গাঁয়ের নারীদের স্বাবলম্বী করতেই রেশম চাষ সম্প্রসারনে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কয়েকবছরেই এ চাষের মাধ্যমে গাজীপুরের কাপাসিয়ার কয়েকশত নারী স্বাবলম্বী হয়েছেন। নিজ বাড়ীতে সংসারের কাজের সাথেই এ চাষে সামান্য সময় দিয়ে অনায়াশেই ১৫/২০হাজার টাকা বাড়তি আয় করতে পারেন। রেশম চাষের মাধ্যমে বিনা খরচে গাঁয়ের কৃষাণীদের কয়েক মাস পর পর ভালো টাকা আয় রোজগার করতে পারাটাই সরকারের স্বার্থকতা। তিনি আরো জানান, রেশম চাষের প্রধান রশদই হচ্ছে পোকার খাবার তুত গাছের পাতা। রেশম পোকার খাবারের সরবরাহের জন্য সরকারী বিভিন্ন খাল ও নদীর ধারে তুত গাছ রোপন করা হচ্ছে। এতে কোন জমিরও অপচয় হচ্ছে না।