করোনার ভয়কে জয় করে ফসল চাষে সফল যুবক

প্রকাশ | ২৯ এপ্রিল ২০২১, ২১:৫১

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি

 

 

টাঙ্গাইলে করোনার ভয়কে নিজের বুদ্ধিমত্তায় জয় করে এক জমিতে একাধিক ফসল চাষ করে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তির পাশাপাশি সফলতা পেয়েছেন শাকিল আহমেদ নামে এক যুবক। তিনি এখন স্থানীয় যুব সমাজের আইকন। তার সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আশপাশের কৃষক পরিবারের যুবকরাও চাষাবাদে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। শাকিল আহমেদ জেলার দেলদুয়ার উপজেলার আতিয়া ইউনিয়নের গোমজানি গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনি এক জমিতে শসা, বিদেশি জাতে ব্ল্যাকবেরি তরমুজ ও বাঙ্গি চাষ করে সফল হয়েছেন। তার এক জমিতে তিন ফসলের ফলন ভালো হওয়ায় এলাকায় সাড়া ফেলেছে।

 

শাকিল আহমেদ জানান, বাড়ির পাশের ছিলিমপুর এমএ করিম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১২ সালে এসএসসি পাস করেন। ২০১৪ সালে টাঙ্গাইল শহরের মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি শেষ করেন। ২০২০ সালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) কৃষি বিভাগ থেকে বিএসসি শেষ করেন।

 

তিনি জানান, গত বছরের মার্চে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ায় প্রথম লকডাউনের কারণে পরিবারের সঞ্চয় করা অর্থ প্রায় শেষের দিকে। পরিবারে অর্থনৈতিক মন্দা, টানাপোড়েন। ভাবলেন বসে না থেকে কিছু একটা করা উচিত। লকডাউন শিথিলের পর বেসরকারি চাকরির জন্য আবেদন করা শুরু করেন। লকডাউন শিথিল হলেও করোনা দুর্যোগে তখন বেসরকারি সেক্টরগুলো সংকটে। আবেদনের পর কয়েকটি মার্কেটিং কোম্পানি এবং প্রাইভেট হসপিটালের অ্যাডমিন শাখা থেকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাক পান তিনি। মৌখিক পরীক্ষা শেষে বেতন, কাজের চাপ এবং সময় সম্পর্কে জানার পর তিনি ভাবলেন বিএসসি শেষ করে চাকরিতে প্রবেশ করে খুব বেশি আরাম কিংবা একটু ভালো বেতন আশা করা প্রায় অবাস্তব। এরপর চাকরির চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের সাবজেক্ট সম্পর্কিত কিছু করার মনস্থির করেন। যাতে নিজে কাজ করার পাশাপাশি এবং অন্তত দু-চারজন লোক তার সঙ্গে কাজ করে উপকৃত হতে পারে। কৃষি বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের বসতবাড়িতে সবজি চাষ এবং পারিবারিক পুষ্টি চাহিদার প্রজেক্ট নিয়ে ভাবতে থাকেন। একই সঙ্গে এ বিষয়ে বাসায় কাজ করে সাফল্যের দেখা পান শাকিল। সে লক্ষ্য সামনে নিয়ে একটু বৃহৎ আকারে কাজ করতে ইন্টারনেট এবং ইউটিউবে সার্চ করে বাণিজ্যিক চাষাবাদের বিষয়ে জানতে থাকেন। ইউটিউবে কৃষিবিষয়ক চ্যানেলের ভিডিও থেকে তিনি স্কোয়াশ, শসা, তরমুজ ও বাঙ্গি চাষ সম্পর্কে ধারণা নিয়ে তার বাবাকে জানান। বাবার আশ্বাস পেয়ে তিনি ভিন্ন উপায়ে চাষাবাদ করার চিন্তা করেন।

 

শাকিল আহমেদ জানান, কম পরিশ্রমে অধিক ফলনের লক্ষ্যে ভারত থেকে আনা উন্নত প্রযুক্তির আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করেন তিনি। ফলে জমিতে অতিরিক্ত কোনো শ্রমিকের প্রয়োজন পড়েনি। প্রথমে তিনি স্কোয়াশ চাষ করে সফল হয়েছেন। এরপর তিনি শসা, তরমুজ ও বাঙ্গি চাষ করছেন। প্রথমে তিনি ৪৫ শতাংশ জায়গার মধ্যে ২৩ শতাংশ জায়গায় ১২ শতকে শসাগাছ লাগিয়েছেন। ১৫ শতকে তরমুজ বাকি জায়গায় তিনি বাঙ্গি চাষ করেছেন। এ প্রজেক্টে তার ১৮ হাজার টাকা খরচ হলেও ইতোমধ্যে তিনি গত ১৪ দিনে প্রায় ৫০ হাজার টাকার শসা বিক্রি করেছেন। এছাড়া প্রতিদিন সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকার শসা বিক্রি হচ্ছে।

 

আগামী সপ্তাহের মধ্যে বাঙ্গি ও ঈদুলফিতরের আগের সপ্তাহে তরমুজ তুলে বাজারে বিক্রি করতে পারবেন। এছাড়াও চারদিকে নেট দিয়ে বেড়া দিয়ে করোলা ও ধুন্ধলের (ধুম্ভা) চাষ করেছেন। বাঙ্গি ও তরমুজের বেডের ফাঁকা জায়গায় লাল শাক ও ডাটা চাষ করেও পাঁচ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন। তার প্রজেক্টে পোকা দমনের জন্য সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা হচ্ছে। তার এই চাষ পদ্ধতি দেখতে নিজ গ্রামসহ আশপাশের গ্রাম থেকে কৃষক পরিবারের যুবকরা দেখতে আসছেন।

 

শাকিল আহমেদ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে জানান, ‘উইনডো মাচাং’ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা ও স্থানীয় পরিচিত ও আত্মীয়দের কাছ থেকে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আশপাশের গ্রামসহ আতিয়া এলাকায় আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ পুরোপুরি নতুন ধারণা। আগে কখনও তারা এটি দেখেনি। এটা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা না থাকায় বিশ^বিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেওয়ার পরও সমালোচকরা তাকে ‘পাগল’ উপাধি দিয়েছে। সকল কটুকথা- ব্যঙ্গ, তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করে তিনি মনোযোগের সঙ্গে কাজ করে গেছেন।

 

তিনি বলেন, পরিবারের সাপোর্ট ছিল বলে আজকে যখন আমি সফলতা অর্জন করেছি এবং সমালোচকরা আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের উপকারিতা  দেখছে - এখন তারা নিজেরাও এটা সম্পর্কে আগ্রহী হয়েছে। এটাই তার সাফল্য বলে মনে করেন শাকিল।

 

শাকিল আহমেদ জানান, করোনায় গ্রামে যার যার বাড়িতে ফাঁকা জমি ছিল সবাইকে তিনি সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং নিজ থেকে বীজ এবং পরামর্শ  দিয়েছেন। একসময় তার গ্রামে সব সময় সবাই এক ফসল চাষ করতেন। ধান চাষাবাদ ছাড়া তারা অন্যকিছু ভাবতেই পারেনি। স্থানীয় কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে- কয়েকটি উঠান বৈঠক করে আলু এবং ভুট্টা চাষে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি। তার তৈরি স্কোয়াশ, শসা, তরমুজ ও বাঙ্গির প্রজেক্ট দেখে গ্রামের বেশ কয়েকজন কৃষক পরিবারের যুবক আধুনিক চাষাবাদে আগ্রহী হয়েছেন। কৃষককে উন্নত কৃষি ব্যবস্থায় আগ্রহী করতে ধানের জন্য লাইন, লোগো,পার্চিং (এলএলপি) পদ্ধতি সম্পর্কে পরামর্শও দিচ্ছেন তিনি।

 

গোমজানি গ্রামের জাহিদুর রহমান, শহর আলী ও সেলিম আহমেদ জানান, এক সময় তাদের গ্রামে শুধু ধান চাষ করা হতো। আগে কখনও তরমুজ চাষ করা হয়নি। সবজি চাষের কোন চিন্তাও ছিল না। শাকিলের আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ দেখে প্রথমে পরিহাস করলেও এখন তার সফলতা দেখে তারা গর্বিত। তারা শাকিলের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তার মতো চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার চাষ পদ্ধতি দেখতে অনেক দূর থেকে লোক আসে বলেও জানান তারা।

 

গ্রামীণ কৃষি নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে কাজ করার স্বপ্ন দেখা শাকিল বলেন, বসতি জমি বাড়ছে। তবে কৃষি জমি দিন দিন কমছে। কৃষি নিয়ে বিশেষ করে গ্রামীণ কৃষি নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করার ইচ্ছা তার। তিনি এবং তার ৩-৪ জন বন্ধু মিলে এই কাজটি করতে চান। কীভাবে কম খরচে অধিক ফসল উৎপাদন করা যায়- তা নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি দালাল, ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে উৎপাদিত পণ্য সরাসরি ভোক্তাদের কাছে কীভাবে বিপণন করা যায় তা নিয়েও কাজ করবেন তিনি। আগামী বন্যার আগে আরেকবার সবজি চাষ করা হবে। বন্যায় কচুরি পানার উপর সবজি চাষ করার পরিকল্পনাও রয়েছে তার।

 

শাকিলের বাবা আব্দুল করিম জানান, শাকিলের প্রজেক্টে তিনিও সহযোগিতা করে থাকেন। প্রজেক্টে ফসলের ফলন দেখে তিনি মুগ্ধ। এমন সন্তানের বাবা হওয়ায় গর্বিত তিনি।

 

আটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. সিরাজুল ইসলাম মল্লিক জানান, শাকিল গ্রামীণ কৃষির চাষাবাদে বিপ্লব ঘটিয়েছে। তার অনুকরণে এখন অনেকেই চাষাবাদে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তিনি শাকিলের সুস্বাস্থ্য ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করেন।

দেলদুয়ার উপজেলা কৃষি অফিসার মো. শোয়েব মাহমুদ জানান, এক জমিতে একাধিক ফসল চাষ করে তিনি এলাকায় সাড়া ফেলেছেন। ফলনও বেশ ভালো হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে তাকে পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হচ্ছে। তার অনুকরণে এলাকার তরুণ-যুবকরা এগিয়ে আসায় তিনি আরও বেশি আনন্দিত।

 

যাযাদি/ এস