টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনায় মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা জরুরি

প্রকাশ | ১৯ জুন ২০২১, ২০:২০

কৃষিবিদ কামরুল হাসান কামু

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট না করে, প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সম্পদ রেখে যাওয়ার অভিপ্রায়ে সম্পদের ন্যায্য বন্টনই হলো টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনা। টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনায় মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্যে ক্রপরোটেশন (শস্য আবর্তন) গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা রাখতে পারে। ক্রপরোটেশনে বাংলাদেশের কৃষকরা এখনো কাঙ্ক্ষিত আগ্রহ দেখাতে পারেনি। যেমন, ধান বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য। ফলে দেশের অধিকাংশ কৃষক ধান চাষ করে থাকে এবং এই ধানচাষের চর্চা বছরের পর বছর ধরে চলছে। বাংলাদেশ এখন ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং প্রয়োজনের অধিক ধান উৎপাদিত হচ্ছে বিধায় চাল রপ্তানির টাইমলাইনে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। যদিও সাম্প্রতিকসময়ে ধানচাষ ছাড়াও কৃষক অন্যান্য ফসলের দিকে আগ্রহী হচ্ছে।

 

আজকের আলোচনার গুরুত্ববহ একটি অংশ ক্রপরোটেশন বা শস্য আবর্তন। কৃষিবিদ ও গবেষকবৃন্দের মতে একই জমিতে একই ফসল বছরের পর বছর চাষ করলে মাটির যেমন উর্বরতা নষ্ট হয় তেমনি ফসলের কীটপতঙ্গের আক্রমণের অনুকূল পরিবেশ বেশি থাকে। এই প্রধান দুটি দিক একটু ব্যাখ্যা করা যাক।

 

একই জমিতে একই ফসল বার বার চাষ করার ফলে একই ধরনের সার জমিতে ব্যবহৃত হচ্ছে বছরের পর বছর। এতে মাটির গুণাগুণ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। মাটির সুস্বাস্থ্যের জন্যে মাটিতে সকল পুষ্টিমৌল সুসম থাকা জরুরী। প্রত্যেক ফসলের জীবনচক্র সম্পন্নের জন্যে মাটি থেকে একই অনুপাতে সকল পুষ্টিমৌল গ্রহণ করেনা। গাছ মূলত তার দেহের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নিজস্ব সিস্টেমে মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে থাকে। ফলে দেখা যায়, কোন মৌল বেশি ব্যবহৃত হয় এবং কোন কোনটা তুলনামূলক কম ব্যবহৃত হয়।আমাদের দেশের কৃষকরা মূলত যে মৌলটি গাছ বেশি ব্যবহার করে সেটির দিকে বেশি নজর দেয়। এভাবে একই জমিতে বার বার একই ধরণের সার ব্যবহার করার ফলে মাটির দেহে ইমব্যালান্স বা ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি হয় যা ভবিষ্যৎ কৃষিক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতির বিষয় হয়ে হাজির হবে। প্রত্যেক ফসলের নির্দিষ্ট ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ রয়েছে। এক ফসলের পোকা বিশেষক্ষেত্র ব্যতীত অন্য ফসলে আক্রমণ করেনা। একই জমিতে একই ফসল বার বার চাষের জন্যে সেই ফসলগ্রাসী পতঙ্গের রিপ্রডাকটিভ অংশ (প্রজনন অংশ) জমিতে, চাষযোগ্য বীজে কিংবা চাষকরার যন্ত্রপাতির সাথে থেকেই যায় যা পরবর্তীতে খুব সহজে ফসলের সংস্পর্শে আসতে পারে। শুধু তা-ই নয়, আবহাওয়ার অতিরিক্ত পরিবর্তনে এইসব কীটপতঙ্গ পরিবেশে টিকে থাকার জন্যে অভিযোজিত হয়ে নতুনরুপে আবির্ভূত হতে পারে এবং আবহাওয়ার আনুকূল্যে মাত্রাতিরিক্ত আগ্রাসী হতে পারে।

 

বাংলাদেশ সরকার খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে আমলে নিয়েছে। তাছাড়া ২০১৬-২০৩০ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) তে উল্লেখ আছে ক্ষুধা থেকে মুক্তি, খাদ্যের নিরাপত্তা বিধান, পুষ্টির মান উন্নয়ন এবং কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই কর্মপদ্ধতির বিকাশ সাধন। তাই শুধু বাহ্যিক উন্নয়নের দিকে নজর দিলেই হবেনা, মাটির উর্বরতা রক্ষণে গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে।কারণ মাটি সুস্থ না থাকলে ফসলও সুস্থ হবেনা এবং কাঙ্ক্ষিত ফসল পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে।

 

আপনাদের স্মরণ করে দিতে চাই, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে নদীগুলো পানি শূন্য হয়ে পড়েছে। বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসার কারণ নদীর জলে বয়ে আসা পলিমাটি জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি করে কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নানান কারণে সেই সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তাই পূর্বের সময়গুলোতে মাটির স্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব না পড়লেও আগামী দশকগুলোতে নির্মম প্রভাব পড়তে পারে।

 

তাই সময় এসেছে মাটির টেকসই উন্নয়নের কথা ভাবার।মাটির টেকসই উন্নয়ন কিংবা সুস্বাস্থ্যের জন্যে নিম্নোক্ত বিষয় গুরুত্বের সাথে দেখা যেতে পারে।

 

একই জমিতে একই ফসল পুনঃপুন না করে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ফসল করা। এতে মাটির পুষ্টিমৌলের সুষম ব্যবহার হবে এবং মাটির স্বাস্থ্য ভাল থাকবে।

 

প্রয়োজনমত সবুজসার ব্যবহার বিশেষ করে নির্দিষ্ট  ফসল চাষের পর ধইঞ্চা কিংবা এই জাতীয় গাছ বপন করে নির্দিষ্ট বয়সে সবুজ থাকা অবস্থায় মাটিতে মিশে দেওয়া। এতে মাটির গুণাগুণ ঠিক থাকবে।

 

সমন্বিত বালাইনাশক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। এতে উৎপাদন খরচ যেমন কম হবে তেমনি কৃষি জমির পরিবেশের সুরক্ষা হবে।

 

মাটির ক্ষয় রোধে জমির চারপাশে উঁচু আইল বা হেজক্রপস লাগাতে হবে। আইলে হেজ ক্রপস লাগালে মাটির ক্ষয়রোধের পাশাপাশি কৃষক অতিরিক্ত উপার্জন করতে পারবে যেমন ধানচাষ জমির আইলে লাউ, কুমড়ো ইত্যাদির চাষ করা যেতে পারে।

 

এগ্রোফরেস্ট্রি বা কৃষিবন বিষয়টি গুরুত্বের সাথে চর্চা করতে কৃষকগোষ্ঠীকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। এতে কৃষি জমির চারপাশে প্রয়োজনীয় বৃক্ষ থাকে বিধায় বৃক্ষের পাতা পচনের ফলে জমিতে অতিরিক্ত পুষ্টি উপাদান যুক্ত হয় যা মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

 

আবহাওয়া উপযোগী ফসলের জাত উদ্ভাবন ও কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে।

 

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন,

"ও ভাই   খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি

                                আমার দেশের মাটি।"

 

আমাদের দেশের এই খাঁটি সোনার মতোন মাটিকে রক্ষা করতে হবে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান দিতে কঠিন সময় পার করেছিলো বাংলাদেশ। আজ সেই অবস্থা নেই। কৃষিবান্ধব সরকারের অনন্য ভূমিকায় আমরা খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু শিল্পায়ন ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আবাসনের জন্যে কৃষি জমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাই যতটুকু জমি আছে সেটার গুণগত মান ঠিক রেখে বর্তমান চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

 

যাযাদি/এস