রঙিন মাছের চাষে ভাগ্য বদল বিপ্লবের

প্রকাশ | ২৬ জুন ২০২১, ১৮:১৭

এবিএস লিটন/গোবিন্দগঞ্জ (গাইবান্ধ) প্রতিনিধি

এসএসসি পাসের পর বাবার সঙ্গে অভিমানে বাড়ি ছেড়েছিলেন তিনি। কাজের আশায় ঘুরেছেন বিভিন্ন স্থানে। খেয়ে না খেয়ে কেটেছে জীবনের অনেক দিন-অনেক রাত। সামান্য বেতনে চাকরি করেছেন পোশাক কারখানায়। কাজ করেছেন বেসরকারি একটি সংস্থায়। কিন্তু মনের মধ্যে লালিত হচ্ছিল বড় কিছু করার স্বপ্ন, স্বাধীন কোনো পেশায়। খুঁজছিলেন নতুন, আলাদা ধরনের কোনো ব্যবসার।

 

 সুুযোগ মিলে গেল ২০১৩ সালে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বেড়াতে গিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী শহর বালুরঘাটে দেখতে পেলেন রঙিন মাছের (অ্যাকুয়ারিয়াম ফিশ) একটি খামার। যেখানে উৎপাদন করা রঙিন মাছ বিপণন হয় ভারতের বিভিন্ন এলাকায়। জেনে নিলেন চাষের পদ্ধতি, বাজারজাতকরণের নিয়মসহ আনুষঙ্গিক নানা বিষয়। খুব সহজেই বেশ বড় আয়ের এমন একটি উৎস মনে দাগ কেটে গেল তার। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তখনই- শুরু করবেন এই ব্যবসা। সেদিনের স্বপ্নবাজ তরুণ, আজকের সফল উদ্যোক্তা গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জের বিপ্লবের সফলতার গল্পের শুরু এটি।

 

 তিনি জানান, দেশে ফিরে বাড়ির আঙিনায় ছোট্ট একটি চৌবাচ্চা বানিয়ে সামান্য কয়েকটি মাছের পোনা কিনে স্বল্প পরিসরে শুরু করলেন রঙিন মাছের চাষ। দু’বছরে আশাতীত সফলতাÑ এনে দিল তাকে আরও আত্মবিশ^াস। চাকরি ছেড়ে ২০১৫ সালে মাত্র ৩৫ হাজার টাকা ব্যয়ে বাড়ির পাশে দেড় বিঘা জমি লিজ নিয়ে গড়ে তুললেন রঙিন মাছের খামার। যেখানে মাছের ডিম থেকে রেণু ও পোনা উৎপাদন শুরু করেন তিনি। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। মাত্র পাঁচ বছরেই বিপ্লবের এ খামার আয়তনে যেমন বেড়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে এর অর্থনৈতিক ভিত্তিও। ৩৫ হাজার টাকার খামারে এখন মাছই রয়েছে ৩৫ লাখ টাকার বেশি। খামারের ৩৪টি ট্যাংকসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর মূল্য ১৫ লক্ষাধিক টাকা।

 

খামারের মধ্যে টিনের ছোট্ট চালা ঘরে কম্পিউটার, ওয়াইফাইসহ ছোট ছোট নানা প্রকার যন্ত্রের ব্যবহার করা হচ্ছে নিয়মিত।  অর্থাৎ পাঁচ বছরে বিপ্লবের রঙিন মাছের খামারের মূল্য এখন অর্ধকোটি টাকা। বিভিন্ন স্তরে মা মাছ পালন, ডিম সংগ্রহ, রেণু উৎপাদন ও পরিচর্যার জন্য বর্তমানে স্বল্পপরিসরে সর্বাধুনিক যান্ত্রিক ও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে বিপ্লবের এ খামারে।

 

 উপজেলার মহিমাগঞ্জ রেলস্টেশনের দক্ষিণ-পশ্চিম ও মহিমাগঞ্জ আলিয়া মাদ্রাসার দক্ষিণে পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিটের দূরত্বের জিরাই গ্রামে স্থাপিত বিপ্লবের এ খামারের নাম ‘অ্যাকুয়া ফিশ ল্যান্ড’। এ খামারে ১৩ জাতের ৩৬ প্রজাতির রঙিন মাছ উৎপাদন করা হচ্ছে। বিপ্লব এ প্রতিবেদককে জানান, শৌখিন মাছ পালনকারীদের মধ্যে চাহিদা বেশি মলি, গাপ্পি, প্লাটি, সোর্ডটেইল, জাপানি কইকার্প, বাটারফ্লাই কইকার্প, গোল্ডফিশ, এঞ্জেল, ফাইটার, জেব্রা দানিয়া, গোড়ামি ও কমেট জাতের মাছের। এখানকার একেকটি মাছ বা মাছের পোনা সর্বনিম্ন ১৫ টাকা থেকে শুরু হয়ে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এখন প্রায় প্রতিদিনই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ খামারে উৎপাদিত রঙিন মাছ বা পোনা সংগ্রহ করতে আসেন শৌখিন খামারি বা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। বিপ্লবের রঙিন মাছের খামারে এখন কর্মসংস্থান হয়েছে বেশ কয়েকজন মানুষের।

 

তিনি জানান, আগে প্রতি মাসে দেড়-দু লাখ টাকার রঙিন মাছ বা পোনা বিক্রি হতো। করোনা পরিস্থিতির কারণে এখন বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। সরকারি সহায়তা পেলে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধন করে ব্যবসা কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব। তবে খুব দ্রুতই করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠে আবার সুদিনের আশাবাদী তিনি।

 

সাম্প্রতিক সময়ে গঠিত ‘বাংলাদেশ অর্নামেন্টাল ফিশ কাউন্সিল’ নামের জাতীয় সংগঠনের আহ্বায়ক কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ আসাদুজ্জামান বিপ্লব জানালেন, এখন প্রতি বছর দেশের চাহিদা ৬শ’ কোটি টাকার রঙিন মাছের। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তি-উদ্যোগে গড়ে ওঠা ছোট ছোট খামার ৫০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে আসছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সর্বাধুনিক যান্ত্রিক ও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে রঙিন মাছ বা পোনা উৎপাদন করে দেশের শতভাগ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। 

 

 জেলার পলাশবাড়ী উপজেলা কৃষি অফিসে কর্মরত কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সাজু মিয়ার পুত্র শেখ আসাদুজ্জামান বিপ্লব অ্যাকুরিয়াম বা অর্নামেন্টাল ফিশ সংশ্লিষ্ট পেশার মানুষের চোখে একজন উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তার রঙিন মাছের খামার ‘অ্যাকুয়া ফিশ ল্যান্ড’ এলাকারও একটি গর্বের প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে।      

 

যাযাদি/এস