মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জেলে থেকে বিশাল মৎস্য হ্যাচারির মালিক যতীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ

কমল সরকার, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
  ২৭ জুন ২০২১, ১৭:৪০

ছোটবেলা থেকে যতীন্দ্র চন্দ্র বর্মনের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। কিন্তু পরিবারের অভাব অনটন তার স্বপ্ন পূরনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সংসারের হাল ধরতে তখন কিশোর বয়সে বাবার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মাছ ধরার পেশায়। তার সম্বল বলতে ছিল তখন মাছ ধরার একটি ঝাঁকি (থাপা) জাল। সারাদিন খালে বিলে মাছ ধরে সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে যে সামান্য টাকা আয় হতো তা দিয়ে কোনমতে চলতো তাদের নয় সদস্যের সংসার। এভাবে অনাহারে ও অনিশ্চয়তায় কাটছিল তার জীবন। এটি প্রায় ৪০ বছর আগের কথা।

এদিকে দিন দিন নদী-নালা ও খাল-বিলে মাছ কমতে থাকায় সারাদিন মাছের দেখা পেতেন না যতীন্দ্র বর্মণ। এতে বন্ধ হয়ে যায় পৈত্রিক পেশা দিয়ে তার আয় রোজগারের পথ। তাই হতাশায় বসে না থেকে স্থানীয় মৎস্য খামারীর কাছ থেকে পানি ভর্তি পাতিলে পোনা নিয়ে তা কাঁধে ভারবাঁশ দিয়ে বহন করে সারাদিন ঘুরে ঘুরে সেই পোনা মৎস্য চাষীদের নিকট বিক্রি করতেন তিনি। এতে তার সংসার ভাল চলছিল না। পরে অন্যের মৎস্য খামারে শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগদান করেন। সেখানে পুকুরে জাল টানা ও মাছের পরিচর্চার কাজ করে যে টাকা আয় করতেন তা পুরোটাই ব্যয় করতেন তিনি নিজ সংসারে। কঠোর পরিশ্রম ও সততার কারনে পুকুরের মালিকগন অন্য শ্রমিকদের চেয়ে তাকে একটু বেশি পারিশ্রমিক দিতেন।

অন্যের পুকুরে শ্রমিকের কাজ করার সময় যতীন্দ্র চন্দ্র বর্মণের মাছ চাষে ভাল অভিজ্ঞতা হয়। একসময় স্বপ্ন দেখেন নিজেই পুকুরে মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার। সেই স্বপ্ন পূরণে অন্যের ডোবার মত ছোট একটি পুকুর ভাড়া নিয়ে অনেক কষ্টে জমানো ৫শ টাকা দিয়ে ৮০’র শতকের প্রথমদিকে শুরু করেন তিনি মাছ চাষ। মাছ চাষে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রথম বছর এ পুকুরে মাছ চাষ করে লাভের মুখ দেখেন তিনি। এভাবে মাছ চাষ করে প্রতিবছর ভাল মুনাফা পেতে থাকেন তিনি। একে একে পুকুর ভাড়া ও সরকারি ভাবে লীজ নিয়ে তার মাছ চাষের ব্যবসার পরিধি দিন দিন বড় হতে থাকে। এরপর আর তাকে পিছনে তাকাতে হয়নি।

যতীন্দ্র বর্মণ গৌরীপুর-রামগোপালপুর সড়কের পাশে বাহাদুরপুর এলাকায় ২ একর ৩৭ শতক জমি ক্রয় করে ২০০৫ সনে তাতে গড়ে তুলেন বর্মণ মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র (হ্যাচারি)। রেণু ও পোনা উৎপানের বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান এ হ্যাচারিতে রয়েছে ছোট বড় ১৫টি পুকুর। এছাড়া ভাড়া করা ও লীজ নেয়া পুকুর রয়েছে আরও ১০ টি। এতে ২০ জন স্থানীয় লোক শ্রমিক হিসেবে কাজ করে তাদের পরিবার নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। প্রতিদিন ভারবাহী পোনা ব্যবসায়ীসহ পিকআপ ভ্যান ও অন্যান্য যান নিয়ে মাছের পোনা এবং রেণু কিনতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মৎস্য চাষীরা আসেন এ হ্যাচারিতে। তবে এ হ্যাচারি থেকে সবচেয়ে বেশি মাছের পোনা ও রেণু সরবরাহ করা হয় সিলেট ও সুনামগঞ্জ এলাকায়।

কঠোর পরিশ্রম ও অদম্য মনোবল নিয়ে শূণ্য থেকে উঠে আসা একজন সফল মৎস্য চাষী যতীন্দ্র বর্মণ। মাছ চাষ ও উৎপাদনে স্থানীয়ভাবে অবদান রাখায় জাতীয় মৎস্য সপ্তাহে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ট হ্যাচারি মালিক হিসেবে দু’বার ও ২০১৮ সনে জেলা পর্যায়ে সম্মাননা লাভ করেন। ৬২ বছর বয়সেও থেমে নেই তার জীবন যুদ্ধ। এ বৃদ্ধ বয়সে নিজ হ্যাচারিতে শ্রমিকদের সাথে প্রতিনিয়ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি।

ছোটবেলা থেকে যতীন্দ্র বর্মণ ভাল গান গাইতে পারতেন। আর তার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে স্থানীয় জমিদার রুহিনী কান্তি লাহিড়ী ১৯৭৫ সনের দিকে তাকে কালিপুর বাগান বাড়ি এলাকায় এক টুকরো জমি দান করেছিলেন। সেই জমিতে বর্তমানে তিনি তার পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করে আসছেন।

যতীন্দ্র চন্দ্র বর্মন জানান, ‘সমাজে কোন কাজকে ছোট করে দেখতে নেই। আমাদের দেশে কাজকে ছোট করে দেখে বলেই বেকারত্বের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। জীবনে সফল হতে হলে নিজ কাজকে আন্তরিকভাবে গ্রহন করতে হবে। অদম্য মনোবল নিয়ে আত্নকর্মসংস্থানে নিয়োজিত থেকে পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন সম্ভব।’

উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জান্নাত-এ-হুর জানান, যতীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে শূন্য থেকে উঠে আসা একজন সফল উদ্যোক্তা। মৎস্য চাষ, পোনা ও রেণু উৎপাদনে স্থানীয়ভাবে অবদান রাখায় জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে তিনি একাধিবার শ্রেষ্ট হ্যাচারি মালিক হিসেবে সম্মাননা লাভ করেন।

যাযাদি/এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে