শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নার্সারি কারিগর হাবিবের দিন-বদলের গল্প

এমএইচ শিপন, বোরহানউদ্দিন (ভোলা)
  ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:৫১

ভোলা জেলায় গত ৫-৬ বছর আগেও তেমন নার্সারি ছিলো না। বন বিভাগ অথবা কৃষি বিভাগ স্বল্প পরিসরে প্রদর্শনীর জন্য কিছু চারা উৎপাদন করতো। স্থানীয়রা গাছ লাগানোর মৌসুমে স্বরূপকাঠি থেকে আসা চারার উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু গত ৪-৫ বছর ধরে জেলার অনেক স্থানেই নার্সারি গড়ে উঠেছে। বোরহানউদ্দিন উপজেলায় এর সূচনা করেন হাবিব নামের এক বর্গাচাষি।

বোরহানউদ্দিনে প্রথম বাণিজ্যিক নার্সারির কারিগর মো হাবিব। পড়াশোনা বলতে স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন। উপজেলার কুতুবা ইউনিয়নের ছাগলা গ্রামে এক সময় বর্গা চাষী ছিল মো. হাবিব। কালক্রমে প্রায় পৌনে চার একর জমিতে গড়ে তুলেছেন বিশাল নার্সারি। শুরু থেকেই সাফল্য তাকে ধরা দিয়েছে। নার্সারির আয়ে তার পরিবারে এসেছে আর্থিক সচ্ছ্বলতা। অন্যদিকে তিনি প্রমান করেছেন, অন্য জেলা থেকে গাছের চারা বা কলম না এনে চেষ্টা, একাগ্রতা ও পরিশ্রম থাকলে নার্সারিতে উৎপাদিত চারা দ্বারা এলাকার চাহিদা অনেকটা পূরণ করা সম্ভব। হাবিবের অনুপ্রেরণায় স্থানীয় যুবকরা নার্সারি করার দিকে ঝুঁকছেন।

বোরহানউদ্দিন উপজেলা সদর থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরে। মিয়াবাড়ি-ঘোলপাড়-দালালবাজার সড়ক। সড়কের একপাশে ছাগলা হাসনাইনিয়া দাখিল মাদ্রাসা। অন্যপাশে ছাগলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। সড়কের পশ্চিশ পাশে সারি সারি ফলদ গাছের চারা, কলম আর মৌসুমী সবজীর চারা। বিভিন্ন প্রজাতির কলমে বারোমাসী আম, আমড়া, জাম্বুরা, আমলকি, পেয়ারা, লেবু সহ নানা ফল ধরে আছে। স্থানীয়দের কাছে এটি হাবিবের নার্সারি হিসেবে সুপরিচিত।

প্রায় দুই শতাধিক প্রজাতির ফলদ চারায় সমৃদ্ধ তার নার্সারি। দিন দিন তার নার্সারিতে গাছের প্রজাতির সংখ্যা বাড়ছে। থেমে নেই বিভিন্ন জাত সংগ্রহ। নতুন প্রজাতি বা গাছের খবর শুনলেই সেদিকে ছোটেন তিনি। এছাড়া তিনি প্রতি মৌসুমে প্রায় পঁচিশ প্রজাতির সবজীর চারা উৎপাদন করে বিক্রি করেন।

নার্সারীতে হাবিব জানান, বোরহানউদ্দিন সহ গোটা ভোলা জেলায় জলপথে স্বরূপকাঠি থেকে গাছের চারা আসত। এখনও আসে। ২০০২ সালে আমার মনে প্রশ্ন জাগলো সরূপকাঠিতে চারা উৎপাদন হলে আমাদের এখানে কেন হবেনা। এরপর আমি স্বরূপকাঠি যাই। রাতে হোটেলে থাকতাম, আর দিনে ওদের নার্সারিতে চলে যেতাম। ওরা কিভাবে গুটি কলম, শাখা কলম, গ্রাফটিং করে তা মনযোগ দিয়ে দেখতাম। কাজটা আমি আস্তে আস্তে শিখে ফেলি। তাপরপর স্বরূপকাঠি থেকে কিছু গাছ কিনে দেশে চলে আসি। আমার জমি ছিলনা। আট শতক জমি বর্গা নিয়ে কলম করার কাজ শুরু করি। তখন মাত্র চারভাগের মধ্যে এক ভাগ কলম হয়েছে। বাকিগুলো হয়নি। আবার স্বরূপকাঠি যাই। ভুলগুলো শুধরাই। ওদের পরামর্শ নেই। আর সমস্যা হয়নি।

এরপর বগুড়া, যশোর, রাজশাহী সহ দেশের অনেক এলাকায় কলম করা শিখতে গিয়েছি। এবছর চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে থাই-১ জাতের পেয়ারার জাত এনেছি। যেখানে যাই সেখান থেকেই আসার সময় মাতৃগাছ কিনে বাড়ি ফিরেছি। জাত বেড়েছে, প্রজাতি বেড়েছে। নার্সারিতে আমের ১৭ টি, কমলার ৫ টি, বড়ই’র ৭ টি, মাল্টার ৪ টি, পেয়ারার ৬ টি প্রজাতির কলমের চারা আছে। এরকম প্রায় সব ফলের ৫-৬ টি প্রজাতির চারা আছে। জাত-প্রজাতি বাড়ার কারণে নার্সারির জায়গা বাড়াতে হয়েছে। গাছের পাশাপাশি আমি উন্নত জাতের পেঁপে, বাধাকপি,ফুলকপি,শালগম, বেগুন, টমেটো, মরিচ, লাউ, সিম সহ নানা প্রজাতির সবজীর চারা উৎপাদন করি। গাছের কলম, চারা, সবজী চারা বেশীর ভাগই ক্রেতারা নার্সারি থেকে কিনে নিয়ে যায়। তবে উপজেলার বিভিন্ন হা্েটও বিক্রি করি।

হাবিব আরো জানান, নার্সারির আয় দিয়েই তার সংসার চলে। এর থেকে কিছু সঞ্চয় করেন। এছাড়া দেড় একর জমিও কিনেছেন। গড়ে প্রতিদিন তার নার্সারীতে ৭ জন লোক কাজ করে। গেল বছর ১৮ লাখ টাকা টাকা বিক্রিতে সাড়ে ৫ লাখ টাকা লাভ হয়েছে। এ বছর এখন পর্যন্ত ১৭ লাখ টাকার গাছের চারা, কলম ও সবজী চারা বিক্রি করেছেন। লাভের হিসাব হয়নি। তবে করোনার কারণে উৎপাদনের তুলনায় বিক্রি কম।

হাবিবের স্ত্রী মনোয়ারা শুরুর দিকে স্বামীর সাথে নার্সারীতে সমান তালে কাজ করত। এখন আর করেন না। তাদের ২ ছেলে ২ মেয়ে। বড় মেয়ে খাদিজা এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিবে। ছোট মেয়ে জান্নাত নবম শ্রেণিতে পড়ে। বড় ছেলে তানজিল তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ছেলে ইব্রাহিম পড়ে প্রথম শ্রেণিতে। হাবিবের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম জানান, নিজে এসএসসি পাশ করে আর পড়াশোনা করা হয়নি। কিন্তু সন্তানদের লেখাপড়া করিয়ে শিক্ষিত করবেন।

নার্সারির বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুক জানান, হাবিব খুব পরিশ্রমি। তাঁর এ নার্সারি বিশেষ করে বেকার যুবকদের জন্য একটি প্রেরণার বড় উদাহরণ।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে