স্বপ্নের আগরগাছের বাগান করে দুঃস্বপ্ন দেখছে মালিকরা

প্রকাশ | ০৫ অক্টোবর ২০২১, ১৯:৫৯

জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল, টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইলের পাহাড়িয়া অঞ্চল মধুপুর ও ঘাটাইলের বাগান মালিকরা স্বপ্নের আগরগাছের বাগান করে এখন দুঃস্বপ্ন দেখছে। চারা লাগানোর ১০ বছরে বড় হয়ে পরিপক্ব হয়ে সুগন্ধি কষ বেরোনোর কথা। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পরও তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। গাছগুলো পরিপক্ব হতেই আরও ৫-৬ বছর সময় লাগবে বলে বন বিভাগ সাফ বলে দিয়েছে। ফলে স্বপ্নের আগর বাগান তাদের কাছে এক দুঃস্বপ্নের গাছে পরিণত হয়েছে। 

 

জানা গেছে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বন বিভাগ আগর বনায়নের প্রকল্প হাতে নেয়। আগর মূলত একটি গাছের নাম। আগর শব্দের আভিধানিক অর্থ উৎকৃষ্ট বা সুগন্ধবিশিষ্ট কাঠ। ওই সময় মধুপুর ও ঘাটাইলের পাহাড়ি অঞ্চলের লালমাটির কিছু এলাকায় আগরের বাগান করা হয়।

 

ওই সময় বন বিভাগ থেকে বলা হয়েছিল, আগর চাষ দারুণ লাভজনক। এর কাঠ বিশেষ কায়দায় খণ্ডবিখণ্ড করে প্রসেসিংয়ের পর এর নির্যাস বাষ্পীভবন ও শীতলিকরণের মাধ্যমে দামি সুগন্ধি আতর, ওষুধ, সাবান, শ্যাম্পু, পারফিউম এবং অবশিষ্ট অংশ আগরবাতি বানানোর কাজে ব্যবহৃত হবে। এভাবে আগর চাষে বাগান মালিকদের ভাগ্য বদল হবে। সে সময় ভাগ্য বদলের স্বপ্নে অনেকেই আগর চাষ করেছিলেন। বর্তমানে গাছের বয়স ১৩-১৪ বছর হলেও আগরগাছগুলো এখনও পরিপক্ব বা কষ বের হওয়ার উপযুক্ত হয়নি। বন বিভাগ বাগানের আগরগাছ থেকে কষ বের করার জন্য পেরেক মারার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। আগরগাছের কোনো নাম্বারিংও করেনি। এছাড়া টাঙ্গাইল জেলায় আগরগাছ প্রসেসিংয়ের কোনো কারখানা নেই। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায় কারখানা থাকলেও ফরেস্ট ট্রানজিট রুলসের কারণে সেখানে গাছ সরবরাহ করা কষ্টসাধ্য। 

 

সরেজমিনে জানা যায়, মধুপুর ও ঘাটাইল উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলের  কয়েকটি এলাকায় সারি সারি আগরগাছ দাঁড়িয়ে আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। তবে গাছগুলো এখনও পরিপক্ব বা প্রসেসিং করার উপযোগী হয়নি। রোপণের সময় বন বিভাগ জানিয়েছিল, আগর চারা লাগানোর ১০ বছরের মধ্যে তা প্রসেসিংয়ের পর কষ থেকে সুগন্ধি তৈরি করা হবে- যার দাম লাখ লাখ টাকা, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

 

ঘাটাইলের সাঘরদিঘী রেঞ্জের কামালপুর গ্রামের বাগান মালিক কামরুল হাসান জানান, তিনি দেড় একর পৈতৃক সম্পত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় খাস হওয়ার ভয়ে এক রকম বাধ্য হয়েই আগরগাছের বাগান করেন। যদিও বাগান করতে তখন তাকে লাখ লাখ টাকা লাভের স্বপ্ন দেখানো হয়। কিন্তু লাভ তো দূরের কথা দীর্ঘ ১৩-১৪ বছরেও আগরগাছ পরিপক্বই হয়নি। দেড় একর জায়গায় আগরগাছ লাগিয়ে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এটা থেকে কোনো আয় হবে কি না সন্দেহ রয়েছে। শুধু তিনি নন এলাকার অনেকেই আগরগাছ লাগিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

 

তিনি জানান, আগরগাছ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। বন বিভাগ জানিয়েছিল, এই গাছ থেকে এক ধরনের সুগন্ধি বের হবে- যা অনেক মূল্যবান।

 

কামরুল হাসান জানান, এক প্রকার জোর করেই তাদের দিয়ে আগরের বনায়ন করানো হয়েছিল। মূল্যবান আগরগাছের বাগান করলে তাড়াতাড়ি ধনী হওয়া যাবে। ১১ বছরের মধ্যে গাছগুলোতে নম্বর দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৩-১৪ বছরেও গাছে নম্বর ফেলানো হচ্ছে না। এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বন বিভাগকে বার বার অনুরোধ করা হয়েছে। 

 

একই এলাকার বাগান মালিক আব্দুস সামাদ জানান, চালায় (উঁচু জায়গা) আগরবাগান করতে হবে- না হলে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। এমন কথা বলে বন বিভাগ তখন আগরের বাগান করতে বাধ্য করে। তারা লাখ লাখ টাকার স্বপ্ন দেখায়। আগরগাছ থেকে কষ বের হবে। কষ থেকে সুগন্ধি হবে- যা অনেক মূল্যবান। কিন্তু গাছের বিষয়ে কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না বন বিভাগ।

 

সাঘরদিঘী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. ওয়াজেদ আলী ও ভুক্তভোগী অপর বাগান মালিক আব্দুল খালেক জানান, আগরগছের জন্য যে সময়সীমা দেওয়া হয়েছিল তা তিন বছর আগেই পার হয়েছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে আগরগাছের বাগান করা হয়েছিল। বন বিভাগ বলেছিল এগুলো থেকে বহু টাকা আয় হবে। তখন বন বিভাগের সঙ্গে বাগান মালিকদের দলিলের মাধ্যমে চুক্তিনামা হয়েছিল। সেখানে গাছের ১০ বছরের মেয়াদ ছিল। কিন্তু এখন ১৩-১৪ বছর পার হলেও গাছের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। প্রথম দিকে বন বিভাগ খোঁজখবর নিলেও গত কয়েক বছরে তারা কোনো খোঁজই নেয়নি। 

 

তারা জানান, ওই ভূমিতে অন্যান্য গাছ, বিভিন্ন সবজি বা ফল জাতীয় গাছ লাগালে ১৩ বছরে অনেক লাভবান হতে পারতেন। আগরগাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কষ বের হতে তারা দেখেন নাই। এ বিষয়ে বন বিভাগ কেনো উদ্যোগও নেয়নি।

 

মধুপুর উপজেলার কুড়াগাছা ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুল হক জানান, বন বিভাগের প্রভাবে দীর্ঘ একযুগ আগে তিনি দেড় বিঘায় আগরগাছ লাগিয়েছেন। আগর গাছে না কি সোনা ফলে- সোনার দামে তো দূরের কথা, সস্তা জ্বালানি কাঠ হিসেবেও ওই গাছ বিক্রি করা যাচ্ছে না।

 

টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক জানান, মধুপুর ও ঘাটাইলের পাহাড়িয়া অঞ্চলে সরকারি আগর প্রকল্পের গাছ এখনও পরিপক্ব হয়নি। তাদের আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। এখনও আগর প্রডাশনের অবস্থায় আসেনি। আগর সত্যিই অতি মূল্যবান গাছ। যখন আগর প্রডাকশন হবে তখন তাদের ভুল ভেঙে যাবে। তারা লাভবান হবেন।

 

তিনি আরও জানান, আগর গাছগুলো তিনি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। গাছগুলো এখনও যথেষ্ট চিকন এবং অপরিপক্ব। পরিপক্ব হতে আরও সময় দিতে হবে। আগামী ৫-৬ বছরের আগে গাছ পরিপক্ব হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। জেলায় প্রসেসিংয়ের ব্যবস্থা করা হলে তা থেকে খুব একটা লাভবান হওয়া যাবে না। গাছগুলো থেকে পুরোপুরি লাভবান হতে হলে মৌলভীবাজারে পাঠাতে হবে।

 

যাযাদি/ এস