৩শ কোটি টাকার সরিষা উৎপাদনের সম্ভাবনা নওগাঁয় সরিষা চাষে আগ্রহ বাড়ছে চাষিদের

প্রকাশ | ১৬ জানুয়ারি ২০২২, ১৭:৫৯

রুহুল আমিন, নওগাঁ প্রতিনিধি

উত্তরাঞ্চলের শস্যভান্ডার খ্যাত জেলা নওগাঁর ১১টি উপজেলার বিস্তৃত মাঠজুড়ে এখন সরিষার হলুদ ফুলের সমারোহ। সরিষা ফুলের ম-ম গন্ধে মুখরিত চারদিক। এ যেন প্রকৃতিতে এক অপরূপ সৌন্দর্যের আবির্ভাব ঘটেছে। স্বল্প সময়ে উৎপাদনশীল হলেও সরিষার ভালো দাম না পাওয়ায় গত কয়েক বছর আগে এই রবিশস্য চাষ থেকে অনেক কৃষক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। তবে বর্তমানে কৃষি বিভাগের প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে সার-বীজ প্রদান এবং বাজারে সরিষার ভালো চাহিদা ও দাম থাকায় সরিষা চাষে আগ্রহ বাড়ছে জেলার চাষিদের। চলতি মৌসুমে জেলায় প্রায় ৩শ কোটি টাকার সরিষা উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে বলছে কৃষি বিভাগ।

 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলার ১১টি উপজেলায় ৩২ হাজার একশ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ৩৩ হাজার ৬৪০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ২ হাজার ৩২০ হেক্টর বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে। যেখানে ৪৮ হাজার মেট্রিক টন সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জেলার ১১টি উপজেলার মধ্যে নওগাঁ সদর উপজেলায় ১ হাজার ৮২৫ হেক্টর, রানীনগরে ২ হাজার ৮০৫ হেক্টর, আত্রাইয়ে ১ হাজার ৭৩০ হেক্টর, বদলগাছীতে ৯৩৫ হেক্টর, মহাদেবপুরে ১ হাজার ৫০৫ হেক্টর, পতœীতলায় ৫ হাজার ৩০ হেক্টর, ধামইরহাটে ১ হাজার ৯৬০ হেক্টর, সাপাহারে ৩ হাজার ৭৫০ হেক্টর, পোরশায় ৩ হাজার ৬৭০ হেক্টর, মান্দায় ৪ হাজার ৪১০ হেক্টর এবং নিয়ামতপুরে ৪ হাজার ৪৮০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। এতে বারি-৯, বারি-১৪, বারি-১৫, বারি-১৬, বারি-১৭, বিনা-৪, বিনা-৯, টরি-৭ এবং সম্পদ জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। সরিষা চাষে আগ্রহ বাড়াতে জেলার প্রান্তিক পর্যায়ের ৫ হাজার কৃষকের মাঝে প্রত্যেককে ১ কেজি উন্নত জাতের সরিষা বীজ, ২০ কেজি ডিএপি (ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট) ও ১০ কেজি এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সার প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।

 

জেলার মান্দা উপজেলার সতিহাট, রাণীনগর উপজেলার ত্রিমোহণী হাট ও আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জ হাটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে প্রকারভেদে প্রতি মণ নতুন সরিষা ২ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায় এবং সদ্য শুকনা সরিষা প্রতি মণ ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি সরিষার তেল পাইকারী ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

 

নওগাঁ সদর উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের চুনিয়াগাড়ী গ্রামের কৃষক আশিক আরমান শাওন বলেন, ‘গত বছর দেড় বিঘা জমিতে বারি-১৪ ও ১৫ জাতের সরিষা আবাদ করে ১১ মণ সরিষা পেয়েছিলাম। শুকনা সরিষা ২ হাজার ৫০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করে ভালো লাভ হয়েছিল। তাই এ বছর ২ বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করেছি। সরিষার জমি প্রস্তুত ও আনুষঙ্গিক প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকায় সরিষার আবাদও ভালো হয়েছে। আশা করছি এখান থেকে কমপক্ষে ১৬ মণ সরিষা পাব। যেহেতু এ বছর সরিষার বাজার শুরু থেকেই বেশি তাই এ বছর সরিষা আরও বেশি দামে বিক্রি করতে পারব বলে আশা করছি।’

 

সাপাহার উপজেলার আশড়ন্দ গ্রামের কৃষক রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘প্রতি বছর  ১ বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করলেও এ বছর ভালো দাম পাওয়ার আশায় দেড় বিঘা জমিতে বারি-১৪ জাতের সরিষার আবাদ করেছেন। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে প্রণোদনার সার ও বীজ পাওয়ায় সরিষা আবাদে খরচ অনেকটাই কম হয়েছে তার। গত বছর ২ হাজার ৭০০ টাকা মণ দরে শুকনা সরিষা বিক্রি করেছিলেন। এ বছর আবহাওয়া অনুক‚লে থাকায় কমপক্ষে ১২ মণ ফলন পাবেন বলে আশাবাদী তিনি।

 

মান্দা উপজেলার কৈইকুড়ি গ্রামের কৃষক আবদুর রহমান বলেন, ‘এ বছর বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই সরিষার বাজার বৃদ্ধি পাবে জেনেই এ মৌসুমের শুরুতেই ৩ বিঘা জমিতে আগাম দেশীয় জাতের (টরি-৭) সরিষা আবাদ করেছেন। যেখানে জমি প্রস্তুত, বীজ, সার ও কীটনাশক প্রয়োগসহ যাবতীয় খরচ মিলিয়ে ১৫ হাজার টাকা খরচ করে ১৭ মণ সরিষা পেয়েছেন। ইতোমধ্যে ৫ মণ নতুন সরিষা বাজারে ২ হাজার ৩০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছেন। সরিষা চাষের সবচেয়ে বড় সুবিধা স্বল্প সময়ে ফসল পাওয়া যায়। আবার একই জমিতে সরিষা বিক্রির টাকা দিয়েই বোরো আবাদ করা যায়। এখন ওই জমিতে ২টি চাষ ও সামান্য পরিমাণ সার দিয়ে বোরো আবাদ করবেন তিনি।

 

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) উপ-পরিচালক শামছুল ওয়াদুদ যায়যায়দিনকে বলেন, ‘স্বল্প সময়ে উৎপাদনশীল রবিশষ্য হলেও গত কয়েক বছর আগে বাজারে তেমন চাহিদা এবং দাম না থাকায় স্বল্প সংখ্যক চাষি সরিষার আবাদ করতেন। যারাই চাষ করতেন তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বোরো কেন্দ্রিক। এই ফসল ঘরে তুলে এখান থেকে যে টাকা আসবে সেটার সঙ্গে কিছু টাকা দিয়ে বোরো চাষ করবেন। তবে বর্তমানে বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধিতে সরিষার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম বেড়েছে। তাই সরিষার আবাদে জেলার সকল পর্যায়ের কৃষকদের আগ্রহ বেড়েছে। চাষিদের সরিষা চাষে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি বিভাগ থেকে প্রণোদনার মাধ্যমে বিনামূল্যে সার ও বীজ দেওয়া হয়েছে। এ বছর আবহাওয়া অনুক‚লে থাকায় বিগত বছরের তুলনায় আবাদ ভালো হয়েছে। তাই উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। যেহেতু বিগত বছরের তুলনায় এ বছর বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেশি তাই সরিষার দাম বেশি হবে বলে মনে হচ্ছে। কৃষকদের উৎপাদিত সরিষা বাজারে প্রায় ৩শ কোটি টাকায় বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে।’

 

যাযাদি/ এস