এক সময় প্রত্যন্ত চরের বালুময় পরিত্যক্ত জমিতে যেখানে অন্য ফসল ফলানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল, সে সব জমিতে শাকালু অর্থাৎ মিষ্টি আলুর চাষ করে ভাগ্য বদল করেছেন এই চরের চাষিরা। মাত্র এক দশকের মধ্যেই নিজেদের প্রচেষ্টায় গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বাঙালী নদীর রাখালবুরুজ, মহিমাগঞ্জ ও সাঘাটা উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের আংশিক এলাকায় সৃষ্ট এক সময়ের ‘দুঃখেরচর’ নামের বিস্তীর্ণ জমি গুলো এখন ‘সুখেরচর’ নাম নিয়েছে। মিষ্টি আলু বা শাকালু নামের তিন মাসে ফলনযোগ্য একটি ফসল বদলে দিয়েছে তাদের ভাগ্য।
কন্দল জাতীয় এ ফসলটি গাইবান্ধা জেলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শাকালু বা শ্যাখা আলু নামে পরিচিত। একসময় এই আলু মঙ্গাপীড়িত উত্তরাঞ্চলে চৈত্র-বৈশাখের অভাবের সময় ভাতের বিকল্প হিসেবে খেতে বাধ্য হতেন এ এলাকার দরিদ্র্য মানুষ। এক দশকে চৈত্র-কার্তিকের আকাল বা মঙ্গা বিদায় নিয়েছে মঙ্গাপীড়িত এ এলাকা থেকে। তাই এখন আর অভাবের জন্য নয়, শখ এবং স্বাদের জন্য এ আলু খান এখানকার লোকজন। প্রতি বছর উৎপাদণ বাড়ায় এখানকার আলু দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয় এখন। গত কয়েক বছর থেকে এখানকার আলু বাণিজ্যিকভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হচ্ছে। কেবল মাত্র গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের বাঙালী নদীর পাশর্^বর্তী কয়েকটি গ্রাম থেকেই প্রতিদিন গড়ে ৮শ’ থেকে এক হাজার মণ আলু রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হচ্ছে। পাশাপাশি গত বছর থেকে সরকারি সহায়তায় প্রদর্শনী প্লটের মাধ্যমে উন্নতজাতের শাকালু চাষ করে বিদেশে রপ্তানী শুরু হয়েছে। প্রতি বছর জানুয়ারী মাস থেকে শুরু হয়ে জুন মাস পর্যন্ত একনাগাড়ে চলে মিষ্টি আলুর উৎপাদন মৌসুম। তবে মার্চ থেকে মে মাস হলো এর পূর্ণাঙ্গ মৌসুম।
বর্তমানে আলুর পাশাপাশি আরও নানা ফসলের চাষ করছেন তারা। এর সাথে জড়িত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্ট অনেকেই নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করে ফেলেছেন ইতোমধ্যে। বালুয়া গ্রামের আলুচাষী খায়রুল আলম রাজা জানান, মাত্র তিন মাসে উৎপাদিত শাকালু জমি থেকে সংগ্রহের পর চরের এ সব জমিতে বোরো ধান বা পাট লাগানো হয়। সেই ধান বা পাট কাটার পর বন্যা আসার আগেই আবারও বর্ষালী ধান নামের আরেকটি স্বল্পসময়ে চাষযোগ্য ধান চাষ করা হচ্ছে। শাকালুর পরিত্যাক্ত গাছ ও ছোট আকারের আলু উৎকৃষ্ট মানের গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এ কারণে মাত্র এক দশকের মধ্যেই এক সময়ের ‘দুঃখেরচর’ নামের বিস্তীর্ণ জমি গুলো এখন ‘সুখেরচর’ নাম নিয়েছে।
উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের পুনতাইড় গ্রামের চরপাড়া ও বালুয়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, এখানকার বাঙ্গালী নদীর তীরবর্তী বালুয়া, বোচাদহ, গুজিয়া, বিশপুকুর, পারসোনাইডাঙ্গা, তালুকসোনাইডাঙ্গা এবং সাঘাটা উপজেলার কচুয়া ও রামনগর গ্রাম থেকে গরুরগাড়ি, রিক্সাভ্যান ও ভটভটিতে করে বস্তায় বস্তায় শাকালু এনে জড়ো করা হচ্ছে নদীপাড়ের বিভিন্ন পয়েন্টে। দিনভর চরপাড়া, বোচাদহ ও বালুয়া পয়েন্টে আলু মজুদ করে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ট্রাক ভর্তি করে ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করা হয়। চাষীরা জানিয়েছেন, চলতি মৌসুমে বাঙালী নদীর এ চরাঞ্চলে কম-বেশি প্রায় কমপক্ষে ছয়-সাতশ’ একর জমিতে মিষ্টি আলুর প্রায় চাষ হয়েছে। বাজার দর ভাল থাকায় এ চরের আলুচাষীরা এবার প্রায় ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার আলু বিক্রি করেছেন ইতোমধ্যে। এখনও বিক্রির বাকী আছে আরও চার থেকে পাঁচ কোটি টাকার শাকালু।
চাষীর জমি থেকে আলু কিনে রেখে বাইরে থেকে আসা পাইকারদের কাছে বিক্রি করা স্থানীয় ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম জানান, প্রতিদিন এখানকার ৩-৪টি পয়েন্ট থেকে ছোটবড় কয়েকটি ট্রাক ও পাওয়ার ট্রলিতে করে ৮শ’ থেকে ১ হাজার মণ শাকালু স্থানীয় বাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করা হচ্ছে। তবে চরের মধ্যে রাস্তা না থাকায় আলু পরিবহণের সমস্যাটিই শাকালু বিপণনে প্রধান অন্তরায় বলে তারা অভিযোগ করেন। সরকারী সহায়তা পেলে এই মিষ্টি আলুর চাষ আরও ব্যাপক আকারে করা সম্ভব। এতে এই এলাকার আরও বহু কৃষিজীবী মানুষ এর মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে পারবে বলে তাঁরা জানিয়েছেন।
এদিকে কন্দল ফসল উন্নয়ণ প্রকল্পের আওতায় উন্নত জাতের মিষ্টি আলুর চারাসহ আনুসঙ্গিক সহায়তা দিয়ে এর চাষ বাড়াতে এগিয়ে এসেছে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা কৃষি বিভাগ। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ রেজা-ই-মাহমুদ জানিয়েছেন, উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বাঙালী নদীর বিভিন্ন চরে ‘কন্দল জাতীয় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের’ অওতায় ৪০টি প্রদর্শনী ক্ষেতের মাধ্যমে উন্নত জাতের শাকালু চাষ করা হচ্ছে। গত বছর এ প্রকল্প থেকে ১৫ মেট্রিক টন শাকালু বিদেশে রপ্তানী করা হয়েছে। চলতি বছর ২০ মেট্রিক টন রপ্তানীর লক্ষ্যে শাকালু সংগ্রহ চলছে। আগামীতে দেশী শাকালু উৎপাদনকারীদেরও সার্বিক সহায়তা প্রদান করা হবে। দেশী ও উন্নত জাতের সহ উপজেলার বিভিন্ন চরে ৮৫ হেক্টর জমিতে এ মৌসুমে এ আলুর চাষ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট বিভাগ জানালেও বাস্তবে অনেক বেশি পরিমাণ জমিতে শাকালু চাষ হয়েছে বলে চাষীরা দাবী করেছেন।
যাযাদি/এসএইচ