তেঁতুলিয়ার অনাবাদী চরে তরমুজে সমৃদ্ধির দিগন্ত

প্রকাশ | ৩১ মার্চ ২০২৩, ১৪:১১

এমএইচ শিপন, বোরহানউদ্দিন(ভোলা)

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলা তেঁতুলিয়া নদীতে জেগে ওঠা বিভিন্ন অনাবাদী চরে গত চার বছরে রেকর্ড ভাঙ্গা তরমুজের বাম্পার ফলনে কৃষি অর্থনীতির নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে। ফলে চাষিরা দেখছেন সমৃদ্ধির হাতছানি। উৎপাদন ভালো হবার পাশাপাশি রমজানে ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকের মুখে হাসির আভা।

স্বল্প সময়ে(৮০-১২০ দিন) এতো লাভ আর কোন ফসলে হয়না। তাই তরমুজ চাষে দিন দিন চাষির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে মাটির গুণের কারণে ভোলার তরমুজ পুষ্টিগুণের পাশাপাশি আকারে বড়। স্বাদও তুলনামূলক বেশী।

তেঁতুলিয়া নদীতে জেগে ওঠা ওই চরগুলোতে ৫-৬ বছর আগেও অনাবাদী ছিল।

উল্লেখযোগ্য কোন ফসলের আবাদ হতোনা। ২-৩ টি চরে বছরে একবার বোরো ধানের আবাদ হত। চরগুলি ছিল মহিষের চারণভূমি। এখন রবি মৌসুমে বাণজ্যিকভাবে তরমুজ,বাঙ্গি,শসাসহ নানা ধরনের ফসল ফলে। গত ছয় বছর ধরে তেঁতুলিয়ার চরে ক্রমশ সবুজের বিপ্লব বাড়ছে। জানা যায়, চরগুলোর মধ্যে চর লতিফ, শরীফাবাদ, পাতার চর, রাম কানাই, ডুবার চর, রিভার ব্লক, চর রায়শ্যাম, কলাগাছিয়া,৫ নাম্বার চর ও শিকদার চরে অন্তত: ১ হাজার ২০০ একর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, গঙ্গাপুর ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া নদীর চরে উপজেলার মোট উৎপাদনের ৮০ শতাংশের বেশি তরমুজ উৎপাদন হয়। উপজেলায়  ১৪০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। ওই লক্ষ্যমাত্রা পাঁচগুণ ছাড়িয়ে ৭০০ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪০ মেট্রিক টন। তবে কৃষকরা বলছেন আরও বেশী পরিমান জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। যে- কোন  বছরের তুলনায় এটা সর্বোচ্চ চাষ ও ফলন।

কৃষি অফিসের তথ্যমতে ওজন হিসেবে এর পরিমান ২৮ হাজার মেট্রিক টন। তবে কৃষকরা বলছেন এর পরিমান আরও বেশী। টাকার অংকে পাইকারি বিক্রয়মূল্য প্রায় ৪২-৪৩ কোটি টাকা।

চাষিদের প্রশিক্ষণ, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, কৃষি অফিসের সর্বাত্বক তদারকি এবং ক্ষুদ্র চাষিরা প্রণোদনা পেলে তরমুজ চাষের পরিধি দিন দিন বাড়বে। ফলে ভোলার কৃষি অর্থনীতি নুতন মাত্রা পাবে বলে মনে করছেন তরমুজ চাষিরা।

সরেজমিনে গঙ্গাপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত তেঁতুলিয়া নদীর  বিচ্ছিন্ন চর শরীফাবাদ চরে গিয়ে দেখা যায় শত শত একর জমিতে তরমুজ ক্ষেত। খেতের এক কোনে শ্রমিকদের থাকা ও রান্নার ঘর। পাকের জন্য আছে বাবুর্চি।  দেখা যায়, দুইটি ট্রলিতে শ্রমিকরা তরমুজ তুলছে। তরমুজ ভর্তি ট্রলি আবার নদীর তীর সংলগ্ন স্থানে নিয়ে যায়। ওই যায়গায় শ্রমিকরা তরমুজ নামিয়ে মালবাহী জাহাজে তুলে দেয়। প্রত্যেক চরের একই রকম ব্যবস্থা। ওই চরের তরমুজ ক্ষেতের চাষি তাজল শাহাবুদ্দিন জানান, তিনি ৪০ একর জমিতে ড্রাগন জাতের তরমুজ চাষ করেছেন।

একরপ্রতি খরচ হয়েছে প্রায় ৯৫ হাজার টাকা। একর প্রতি বিক্রি নেমেছে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। পাশ্ববর্তী ডুবার চরের চাষি মো. সুমন হাওলাদার জানান, ৩০ একর জমিতে  ড্রাগন জাতের তরমুজ চাষ করেছেন। একরপ্রতি খরচ হয়েছে ৯৫ হাজার টাকা। একর প্রতি বিক্রি নেমেছে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

রিভার ব্লক চরের তরমুজ চাষি লিটন মেম্বার জানান, ওই চরে ২৪০ একর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। ওই চরে সে ৩০ একর তরমুজ চাষ করেছে। একরপ্রতি খরচ হয়েছে ৯০ হাজার টাকা। একরপ্রতি বিক্রি হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

শিকদার চরের চাষি সুজন হাওলাদার জানান, ১৫ একর জমিতে ড্রাগন জাতের তরমুজ চাষ করেছেন। খরচ হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে বিক্রি নামবে ২৮ লাখ টাকা। ওই চরের আরেক চাষি বাচ্চু সর্দার চাষ করেছেন ১০ একর। তারও একই রকম বিক্রি নামবে।  ড্রাগন  জাত ছাড়া চাষিরা কম-বেশী সুইট হানি, রেড ড্রাগন ও বারি-১ জাতের তরমুজের আবাদ করেছেন।

ওই সময় চাষিরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কৃষি অফিসের কোন কর্মকর্তা গত তিন বছরে তাঁদের এলাকায় আসেননি। তাঁদের কাছে কোন পরামর্শতো দূরের কথা নিজেরা যোগাযোগ করেও কোন সাঁড়া পাওয়া যায়না। তাঁরা আরো জানান, তরমুজ গাছে যখন ফুল আসে, তখন তাঁদের মধুর বাসা সরবরাহ করলে প্রাকৃতিক পরাগায়নে ফলন যেমন ভালো হতো পাশাপাশি খরচও কম হতো। এখন হাতে হাতে পুরুষ ফুল নিয়ে স্ত্রী ফুলে পরাগায়ন ঘটিয়ে নিষেক প্রক্রিয়া ঘটানো হয়। এছাড়া সরকারী ভর্তূকি মূল্যে সেচ পাম্প, পাওয়ার ট্রিলার পেলে অনেক টাকা সাশ্রয় হয়।

চাষিরা জানান, প্রথমে তরমুজ নৌপথে ট্রলার দিয়ে বরিশাল অংশে নেওয়া হয়।

তারপর কুমিল্লা, সিলেট, কুমারকান্দি, কাঠপট্টি, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী এলাকায় পাইকারদের পৌঁছে দেওয়া হয়।

স্থানীয় বাজারে তরমুজের দাম বেশি কেন-এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কৃষকরা জানান, ১০-১১ কেজি ওজনের একটি তরমুজ আমরা পাইকারি বিক্রি করি ১৭০ টাকা। এর সাথে আড়ৎ পর্যন্ত পৌঁছতে খরচ আরো ১৫ টাকা খরচ আছে। আড়তদার প্রতি পিচে ২০ টাকা লাভ করলে খুচরা বিক্রি সর্বোচ্চ ২৩০ টাকার বেশী হবার কথা নয়। কিন্তু ওই তরমুজ বিক্রি করে ৩৫০-৪০০ টাকা। এখন দেখা যায় আমাদের থেকে বেশি লাভ করে খুচরা বিক্রেতারা। প্রশাসন যদি মৌসুমী ফল বিক্রির খাজনা ফ্রি যায়গা করে দেন তাহলে ভোক্তারা অনেক কম মূল্যে এ ধরনের ফল পেতে
পারেন।

কৃষকদের অভিযোগের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জয়া ও গঙ্গাপুর(অতিরিক্ত দায়িত্ব) ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জম্মেন জয় দে জানান, তিনি চরে বীজ বপনের সময় একবার গিয়েছেন। এরপর আর যাওয়া হয়নি। তবে ভবিষ্যতে এরকম হবেনা।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এইচএম শামীম বলেন, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নেয়া হচ্ছে। কৃষকদের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মধুর বাসা, স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ আর ভর্তূকি মূল্যে ট্রাক, সেচযন্ত্র দেয়ার বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তপক্ষের নিকট জানানোর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

যাযাদি/ এস