কৃষি উৎপাদনে ঝুঁকিতে যেতে চায় না সরকার
প্রকাশ | ৩১ মে ২০২৩, ১১:৫৩
বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো ঢালাও ভর্তুকির বিপক্ষে থাকলেও আসছে বাজেটে কৃষিতে ১০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বাড়ছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি রাখা হয়েছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বাড়ায় কৃষককে কিছুটা স্বস্থি দিতে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা করেছিল সরকার। এ আগের বছর ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা।
খাদ্য নিরাপত্তায় উৎপাদন বাড়াতে কৃষি গবেষণা কার্যক্রমেও অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এদিকে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে সরকারিভাবে সংগ্রহে ধান-চালের দাম বাড়াতে যাচ্ছে সরকার। অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি গবেষণার সঙ্গে জড়িত নয়টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৭০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে গবেষণা সংশ্লিষ্ট খাতগুলোয় বরাদ্দ রয়েছে ৫০২ কোটি টাকা। এ খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
আগামী অর্থবছরে মোট ভর্তুকি বরাদ্দ থাকবে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে যা ছিল ৮১ হাজার কোটি টাকা। জনগণের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে আসন্ন বাজেটে কৃষি, খাদ্য ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ বাড়ানো হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। কর্মকর্তাদের মতে, এই ভর্তুকির মাধ্যমে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি, সার ও খাদ্যের উচ্চমূল্যের ধাক্কা সামলে ওঠা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে কৃষিবিদ আব্দুল আজিজ বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে কৃষিকে অবশ্যই যান্ত্রিকীকরণ, ডিজিটালাইজেশন এবং আধুনিক কৃষিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি সংবলিত করতে হবে। সে জন্য স্মার্ট কৃষি-বাজেট প্রয়োজন। মাঠ পর্যায়ের কৃষকের এখন একটাই চাওয়া, আসন্ন জাতীয় বাজেটে কৃষির প্রতিফলন দেখতে চান তারা। কৃষি উৎপাদনকে প্রাধান্য দিয়ে সার ও সেচ কাজে বিদ্যুতে ভর্তুকি বাড়তে হবে। বিনামূল্যে সার ও বীজ দিতে হবে এবং কৃষি উপকরণ সহায়তা দিতে হবে। সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য তিন হাজার দুইশ’ কোটি টাকা বাজেট নির্ধারণ করেছে। এটাকে আরও বাড়াতে হবে। এর ফলে প্রোডাকশন কস্ট কমবে। প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে। উৎপাদন বাড়বে। ভোক্তারাও কম দামে কৃষি পণ্য কিনতে পারবে।
, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণ দিচ্ছে তাতে ভর্তুকি কমানোর শর্ত দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকও একই কথা বলছে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ যুগ যুগ ধরেই এই একই কথা বলে আসছে। তারা শুধু আমাদের মতো দেশের কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানোর কথা বলে। অথচ উন্নত দেশগুলো তাদের মূল জিডিপির ১০ শতাংশের বেশি কৃষি খাতে ব্যয় করে। বাংলাদেশ কৃষি খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে, সে জন্যই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে বাংলাদেশ। মহামারি করোনো ও মন্দায় একজন মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আগামী অর্থবছরে খাদ্য ভর্তুকিতে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ রাখা হতে পারে। টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে কমমূল্যে খাদ্যপণ্য দেওয়াসহ সরকার পরিচালিত খোলা বাজারে বিক্রয় (ওএমএস) এবং ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট (ভিজিডি) কর্মসূচিগুলোর সরবরাহ ঠিক রাখতে এই বাড়তি বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বাজেটে কৃষি খাতে (কৃষি, খাদ্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ) ৩৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গত অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৪ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এবারের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ৯ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা।
বিআইডিএসের সাবেক কৃষি গবেষক ডক্টর সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কৃষি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে হবে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ ভর্তুকি কমানোর চাপ দিলেও তা মানা যাবে না। বর্তমান বৈশ্বিক পেক্ষাপটে কৃষিতে ভর্তুকি বাড়ানোর বিকল্প কিছু হতে পারে না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নতুন বাজেটে কৃষি খাতে অন্তত ভর্তুকি কমপক্ষে ৪০ হাজার কোটি টাকা রাখা হোক। তিনি আরও বলেন, কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা বাবদ চলতি বাজেটে ৫০০ কোটি এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য ৮৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রের ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ বিলের ওপর ২০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। ডাল, তেল, মসলা, ভুট্টাসহ ২৪টি ফসল উৎপাদনের জন্য সুদ ভর্তুকির আওতায় ৪ শতাংশ সুদে বিশেষ কৃষিঋণ প্রদান আসন্ন বাজেটে অব্যাহত রাখতে হবে।’
বিশ্বব্যাংকের সাবেক কৃষি পরার্মশক ডক্টর নজরুল ইসলাম বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাজেটে কৃষি পুনর্বাসন এবং সার খাতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। দেশের সার্বিক কৃষি খাত ও আগামী অর্থবছরের বাজেটে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ খাতে, সেচে জ্বালানি তেল এবং বিদ্যুতের ভর্তুকি চালমান রাখা এবং কৃষি খাতে শস্য বিমা সুবিধা চালু করা। জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল কৃষি উদ্ভাবনে গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা সমস্যা, মাটির স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়া, কৃষির বহুমুখী পরিবর্তন ও মানুষের জীবনধারাকে সামনে রেখেই কৃষি গবেষণা শুধু ফসলের জাত উদ্ভাবন বাড়াতে ভর্তুকি দিতে হবে। টেকসই কৃষি উন্নয়ন করতে হলে অবশ্যই গবেষণা বাড়াতে হবে।
কৃষিমন্ত্রী ডক্টর আব্দুর রাজ্জাক গণমাধ্যকে বলেন, কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সারে ভর্তুকি বাড়ানো হবে। কৃষি উৎপাদনের বিষয়ে কোনো ঝুঁকিতে যেতে চায় না সরকার। তাই প্রধানমন্ত্রী সারে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
যাযাদি/ এস