ব্যক্তির মালিকানায় ৬০ বিঘার বেশি কৃষিজমি নয়
প্রকাশ | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৪৩

জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ভূমি সংস্কার আইন অনুযায়ী কোনো একক ব্যক্তি ৬০ বিঘার বেশি কৃষিজমি রাখতে পারবেন না। যদি উত্তরাধিকার সূত্রে কেউ বেশি জমি পেয়ে থাকেন, তবে সেখান থেকে নিজের পছন্দমতো ৬০ বিঘা কৃষিজমি তিনি রাখতে পারবেন। অতিরিক্ত জমি তাকে ছেড়ে দিতে হবেÑ যা নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ দিয়ে সরকার খাস করতে পারবে। তবে কোনো কোম্পানি অনুমতি নিয়ে ৫০০ থেকে ১ হাজার বিঘা জমি রাখতে পারবে।
দলিল যার, জমি তার অর্থাৎ দখলে থাকলেই হবে না, জমির দলিলসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও থাকতে হবে, এই বিধান রেখে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিল২০২৩’ পাস হয়। এ বিলের বিষয়ে বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ভূমি মন্ত্রণালয়। সেখানে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, ভূমি সচিব মো. খলিলুর রহমান ও যুগ্ম সচিব মো. খলিলুর রহমান।
ভূমিমন্ত্রী মো. সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আপাতত এ আইনে কোনো ব্যক্তি ৬০ বিঘার বেশি জমি রাখতে পারবেন না। কোনো কোম্পানি অনুমতি নিয়ে ৫০০ থেকে ১ হাজার বিঘা রাখতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে আমরা দেখব কী কারণে তারা নিতে চায়। তবে ব্যক্তি ৬০ বিঘার বেশি জমির মালিক হতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আমলে এটি ছিল ১০০ বিঘা। এরশাদ সাহেব এসে ৬০ বিঘা করেছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো ব্যক্তির অর্জিত জমি ৬০ বিঘার বেশি হলে ভূমির মালিক তার পছন্দ অনুযায়ী ৬০ বিঘা জমি রাখতে পারবেন। বাকি জমি সরকার বিধি দিয়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে ক্ষতিপূরণ প্রদান করে খাস করতে পারবে।’
অনুষ্ঠানে সাংবাদিকেরা উত্তরাধিকার জমির বিষয়ে উদাহরণ তুলে ধরে জানতে চানÑ কোনো ব্যক্তির ৬০ বিঘা কৃষিজমি আছে, কিন্তু তখন তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে আরও ৬০ বিঘা বা কমবেশি কৃষিজমি পেলেন। তখন কী হবে?
উত্তরে ভূমি সচিব খলিলুর রহমান আইনের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত জমি ৬০ বিঘার বেশি হলে ভূমির মালিক নিজের পছন্দ অনুযায়ী ৬০ বিঘা ভূমি রাখতে পারবেন। অবশিষ্ট ভূমি সরকার বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ক্ষতিপূরণ দিয়ে খাস করতে পারবে। তবে সমবায় সমিতিসহ ৮টি ক্ষেত্রে ৬০ বিঘার বেশি কৃষিজমি রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে।’
বিষয়টি আরও স্পষ্ট করতে গিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (আইন) মো. খলিলুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘৬০ বিঘার বেশি কৃষিজমি না রাখার বিধানটি নতুন নয়। ১৯৮৪ সালে এ-সংক্রান্ত অধ্যাদেশও ছিল। কিন্তু ৪০ বছরেও বিধিমালা না হওয়ায় সেটি বাস্তবে কার্যকর হয়নি। এর মধ্যে আদালতের নির্দেশে সামরিক শাসনের সময়ে জারি করা অধ্যাদেশ বাতিল করে এখন নতুন করে আইন করা হচ্ছে। তাতেও ওই বিষয়টি রয়েছে।’
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আমরা আজকে (বুধবার) অত্যন্ত আনন্দময় মুহূর্তে প্রেস কনফারেন্স করছি। এটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত ও ঐতিহাসিক দিন আমাদের জন্য। গতকালকে (মঙ্গলবার) যে তিনটি বিল সংসদে পাস করলাম, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে বিলটি ছিল সেটি হলো ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন। যেটা অধিক আগ্রহের, দীর্ঘদিন ধরে দেশবাসী অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘অনেকে একটু হতাশ হয়ে গিয়েছিল, এটা মনে হয় আর আলোর মুখ দেখবে না। আল্লাহর অশেষ রহমত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান, সাহসিকতার কারণে আমরা জাতিকে একটি সুন্দর বিল উপহার দিতে সক্ষম হয়েছি। এটা আসলে খুবই প্রয়োজন ছিল।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমাকে প্রধানমন্ত্রী যখন পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন আমি আস্তে আস্তে উপলব্ধি করলাম, কীভাবে মানুষকে হয়রানি, প্রতারণা থেকে বাঁচানো যায়। ধীরে-ধীরে আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে এই জিনিসগুলোর প্রক্রিয়া শুরু করি। এটার দীর্ঘ সময় লেগেছে।’
তিনি বলেন, ‘এটা একটা বিশাল জিনিস এবং এটা অনেক জটিল। এই জটিলে হাত দেওয়াটা একটা সাহসিকতার বিষয় ছিল এবং শুরুতে আমাকে অনেকেই বলেছিল যে এটাতে হাত দেওয়াটা কি উচিত হবে কিনা এবং হাত দিলে হাত পুড়েও যেতে পারে। কারণ এটা খুব সেনসিটিভ। এখানে আইনের অনেক বিষয় আছে। তাকে বললাম, আমারতো সিনসিয়ারিটি আছে এবং প্রধানমন্ত্রীও চান এ দেশের মানুষকে সেবা দিতে। আমরা সেবক হিসেবে থাকতে চাই। উনার যেহেতু সাপোর্ট আছে, আমার মনে হয় আল্লাহর রহমতে আমি যদি চেষ্টা করি, সেটা সম্ভব হবে।’
তিনি আরও বলেন, এটার পেছনে অনেক কাজ করতে হয়েছে। পেছনের চিত্র আপনারা অনেক কিছু দেখেননি। আমাদের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাই সার্বিকভাবে কাজ করেছেন। উনাদের আন্তরিকতার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। না হলে কিন্তু আমার একার পক্ষে এটা সম্ভব হতো না।’
৬০ বিঘা জমির মালিকানা নিয়ে যা আছে আইনে
ভূমি সংস্কার আইনের ৪ ধারায় ‘কৃষিভূমি অর্জনের সীমাবদ্ধতা’ উপ-শিরোনামে বলা হয়েছে- (১) ৬০ প্রমিত বিঘার বেশি কৃষি ভূমির মালিক বা তার পরিবার হস্তান্তর, উত্তরাধিকার, দান বা অন্য কোনো উপায়ে নতুন কোনো কৃষি ভূমি অর্জন করতে পারবেন না।
(২) তবে নিন্মোক্ত ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করা যাবে-
(ক) কোনো সমবায় সমিতির সব সদস্য তাদের ভূমির মালিকানা সমিতির অনুকূলে হস্তান্তর করে নিজেরা চাষাবাদ করলে; (খ) চা, কফি, রাবার বা অন্য কোনো ফলের বাগানের জন্য ব্যবহৃত ভূমি; (গ) কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কারখানায় ব্যবহৃত কাঁচামাল উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ভূমি ব্যবহার করলে; (ঘ) কোনো কাজের জন্য জনস্বার্থে সরকার কর্তৃক প্রয়োজনীয় বিবেচিত এমন কোনো ভূমি; (ঙ) কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শতভাগ রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্য বা কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের জন্য অথবা শতভাগ রপ্তানিমুখী বিশেষায়িত শিল্পের জন্য সরকারের অনুমোদন নিয়ে ব্যবহৃত ভূমি; (চ) কোনো সংস্থা কর্তৃক জনকল্যাণার্থে সরকারের অনুমোদনক্রমে ব্যবহৃত ভূমি; (ছ) কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শিল্প-কারখানা স্থাপন বা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে সরকারের অনুমোদনে ব্যবহৃত ভূমি এবং (জ) ওয়াকফ, দেবোত্তর বা ধর্মীয় ট্রাস্টের ক্ষেত্রে এর মালিকানাধীন ভূমির সম্পূর্ণ আয় ধর্মীয় বা দাতব্য কাজে ব্যয় হলে। তবে শর্ত থাকে যে, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে যদি ভূমির আয় আংশিক ধর্মীয় বা দাতব্য কাজে এবং আংশিক কোনো ব্যক্তির স্বার্থে ব্যয় হয়ে থাকে, তবে ভূমির যে অংশের আয় কেবল ধর্মীয় বা দাতব্য কাজে ব্যয় হয় সেই পরিমাণ ভূমির ক্ষেত্রে বিধান প্রযোজ্য হবে না।
(৩) ৬০ বিঘার কম কৃষি ভূমির মালিক বা তার পরিবার যে কোনো উপায়ে নতুন কৃষি ভূমি অর্জন করতে পারবেন, তবে এভাবে অর্জিত নতুন ভূমি তার মালিকানায় থাকা কৃষি ভূমিসহ একত্রে ৬০ বিঘার বেশি হবে না।
(৪) যদি কোনো ভূমির মালিক এই ধারার বিধান লঙ্ঘন করে ক্রয়সূত্রে কোনো নতুন কৃষি ভূমি অর্জন করেন, তাহলে যে পরিমাণ ভূমি ৬০ বিঘার অতিরিক্ত হবে তা সরকারের অনুকূলে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে সমর্পিত হবে এবং উক্ত সমর্পিত ভূমির মূল্য বাবদ কোনো ক্ষতিপূরণ প্রদেয় হবে না। তবে শর্ত থাকে যে, উত্তরাধিকার, দান বা উইলের মাধ্যমে অর্জিত ভূমির ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না।
(৫) উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত ভূমি ৬০ বিঘার বেশি হলে ভূমির মালিক তার পছন্দ অনুযায়ী ৬০ বিঘা ভূমি রাখতে পারবে এবং অবশিষ্ট ভূমি সরকার বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ক্ষতিপূরণ প্রদানপূর্বক খাস করতে পারবে।
যাযাদি/ এস