ভেজাল ছত্রাকনাশকে পচন ধরেছে পেঁয়াজ ক্ষেতে, বিপাকে কৃষক
প্রকাশ | ০৩ মার্চ ২০২৫, ১৫:৫৩ | আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২৫, ১৬:০৪

ছত্রাকের আক্রমন থেকে পেঁয়াজের গাছ ভাল রাখতে ক্ষেতে ছত্রাকনাশক স্প্রে করেছিল চাষীরা। ভাল তো দুরের কথা, সেই কীটনাশকে নষ্ট হয়েছে পেঁয়াজের ক্ষেত। পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে বিঘার পর বিঘা পেঁয়াজ। মাথায় হাত চাষীদের।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার জাহাজপোতা গ্রামের কৃষক সেলিম উদ্দিন। তিন বিঘা জমিতে পেয়াজের চাষ করেছে। এই চাষে লাখ টাকা খরচ যোগাতে নিজের পোষা গরু বিক্রি করেছে। আশা ছিল এবার পেঁয়াজের ফলন ও দামে বেশ লাভবান হতে পারবে-তার এই স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে কীটনাশক কো¤পানী-মার্শাল কো¤পানীর য়োকরাল কীটনাশক ¯েপ্র করে পেঁয়াজ গাছে লেগেছে পচন।
তার মতো একই অবস্থা কিষানী রেবেকা আক্তার রুনার। পেঁয়াজের সাথে সাথী ফলস হিসেবে চাষ করা কচু, কলাগাছও মরে গেছে।
উপজেলার জাহাজপোতা, হুদাপাড়া, হরিরামপুর, মুন্সিপুর মাঠে ১৬ জন কৃষকের প্রায় ২০ বিঘা জমির পেঁয়াজ মার্শাল কো¤পানীর কীটনাশক ¯েপ্র করে এভাবে পচন লেগে নষ্ট হয়ে গেছে।
হুদাপাড়া গ্রামের কীটনাশক বিক্রেতার কাছ থেকে মার্শাল কোম্পানীর য়োকরাল নামের কীটনাশক কিনে ক্ষেতে স্প্রে করেছিল কৃষকরা।
সরেজমিন চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, ২০ জন পেঁয়াজ চাষী তাদের পেয়াজ ক্ষেতে মার্শাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ উৎপাদিত য়োকরাল নামক ছত্রাকনাশক স্প্রে করে তাদের প্রায় ৩০ বিঘা জমির পিয়াজ পচে সম্পূর্ন নষ্ট হয়ে প্রায় কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
চাষীরা জানিয়েছেন, তাদের ক্ষতির পরিমাণ কোটি টাকার মতো। বিঘা প্রতি পেঁয়াজ চাষে তাদের খরচ হয়েছে ৫০-৫৫ হাজার টাকার মতো। অপরদিকে তাদের ফলন হওয়ার কথা প্রতি কাঠায় ৮ মন হিসাবে বিঘায় প্রায় ১৬০ মন। গড়ে ২ লক্ষ টাকার উপরে তাদের মুনাফা হতো। আর মাত্র এক মাস পরেই তাদের উৎপাদিত পেয়াজ ওঠার কথা। এখন তাদের মাথায় হাত। এমন অবস্থায় ছেলে-মেয়ে নিয়ে তারা পথে বসে পড়েছেন। তার উপরে আছে বিভিন্ন এনজিও এবং মহাজনের কাছ থেকে চড়া সূদে নেয়া ঋণের বোঝা।
জাহাজপোতা গ্রামের পেয়াজ চাষী কৃষক সেলিম জানান, আড়াই লাখ টাকার গরু বিক্রি করে পেঁয়াজ চাষ করেছিলাম, আমার যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার নয়। আমার ৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সাড়ে তিন বিঘা পেঁয়াজের জমিতে মার্শাল কোম্পানীর য়োকরাল কীটনাশক প্রয়োগ করেছিলাম। আমি এখন মহাজনের এবং এনজিওর ঋণের কিস্তি কিভাবে পরিশোধ করবো, সেটা ভেবেই চরম অনিশ্চয়তার মাঝে এখন দিন কাটছে আমার। পার্শ্ববর্তী হরিরামপুর গ্রামের আরিফুলের দোকান থেকে কীটনাশক কিনে ব্যবহার করি। কোম্পানীর লোক ক্ষতিগ্রস্থ পেয়াজের জমি দেখে গেছে। ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা থাকলেও না দিয়ে কালক্ষেপণ করছে। দেখি ক্ষতিপূরণ দেয় কিনা। না দিলে আমি উচ্চ পর্যায়ে অভিযোগ করবো।
জাহাজ পোতা গ্রামের ফয়সালের স্ত্রী রেবেকা রুনা কান্না জড়িত কন্ঠে জানান, আমিও আমার আড়াই লাখ টাকা দামের গরু বিক্রি করে আমার দেড় বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলাম। হুদাপাড়া গ্রামের সারের দোকানদার ইমরানের কাছ থেকে কেনা য়োকরাল বিষ দিয়ে আমার জমিরও পুরো পেঁয়াজ পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। আমি এখন পথে বসে গেছি, আমার কি হবে? আমি এর বিচার চাই।
এ বিষয়ে জানতে দোকানী আরিফুলের সাথে কথা বললে তিনি জানান, আমার এ বিষের ডিলার কার্পাসডাঙ্গা বাজারের ব্রীজ মোড়ের কীটনাশক দোকানী হাসিবুর। আপনি তার সাথে কথা বলেন। আমি শুনেছি এলাকায় আরো অনেক কৃষকের ক্ষতি হয়েছে কোম্পানী তালিকা করে ক্ষতিপূরন দেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে। এ বিষয়ে কোম্পানীর ডিলার হাসিবুরের সাথে কথা বললে তিনি নিজের দায় এড়িয়ে বলেন, আমি কিছু জানিনা, কোম্পানীর লোক সব বলতে পারবে। কোম্পানীর বড় বড় অফিসার এটা দেখছে। আপনি এই কোম্পানীতে কর্মরত লোকনাথপুর গ্রামের আরিফের সাথে কথা বলেন।
কোম্পানীর ফিল্ড অফিসার আরিফুলের সাথে কথা বললে, তিনি জানান, আমরা মাঠে তদন্ত করে একটা তালিকা করেছি। ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তাছাড়াও আমাদের কীটনাশকে ক্ষতি হয়েছে কিনা তার পরীক্ষা চলছে, ক্ষতি হলে আমরা দেখবো।
হুদাপাড়া গ্রামের য়োকরাল ছত্রাকনাশক বিক্রেতা ইমরান আলী বলেন, আমার কাছ থেকে দুইজন চাষী য়োকরাল বিষ কিনেছেন। তাতে ক্ষতি হয়েছে কিনা বলতে পারবোনা, তবে কোন কোন কৃষকের ক্ষতি হয়েছে এটা আগের য়োকরালেও হতে পারে। কো¤পানির লোকজন মাঠে গিয়েছে। ডেমো করে তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার তালিকা করেছে এবং তারা ক্ষতিপূরণ পাবে বলে আমি শুনেছি।
এ বিষয়ে কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মামুনের সাথে কথা বললে তিনি জানান, আমরা মাঠ তদন্ত করেছি। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের বলেছি কোম্পানী ক্ষতিপূরণ না দিলে আমাদের উপজেলা কৃষি অফিসে লিখিত অভিযোগ করতে। আমরা কৃষকের পাশে থাকবো। ক্ষতিগ্রস্থ পেঁয়াজ চাষী ও ক্ষতির পরিমাণ নিরুপনের কাজ শেষ হলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
হুদাপাড়া গ্রামের মৃত নিশিন্দ হালসনার ছেলে মহত আলীর দেড় বিঘা, মৃত সাহাদতের ছেলে ফয়সালের স্ত্রী রেবেকা রুনার দেড় বিঘা, মৃত নাসির কেয়ারের ছেলে কালো কয়ালের ১০ কাঠা, আলিবদ্দিনের ছেলে সাগরের ১০ কাঠা, মৃত ভগার ছেলে খোকনের ১০ কাঠা, দয়লা মোড়লের ছেল লিটনের ১৫ কাঠা, কার্পাসডাঙ্গার এম.মফিজুর রহমানের ছেলে সাঈদের ১৬ কাঠা, জাহাজপোতা গ্রামের শরীফ উদ্দিনের ছেলে সেলিম উদ্দিনের সাড়ে ৩ বিঘা, মৃত আবেদিনের ছেলে আব্দুর রাজ্জাকের দেড় বিঘা, হরিরামপুরের শাহজাহান আলী ডাক্তারের ছেলে ছাবদারের ২ বিঘা, মুন্সীপুরের কৃষক আব্দুর রাজ্জাকের ২ বিঘা জমির পেয়াজ সম্পূর্ন পচে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। উল্লেখিত গ্রামগুলির বেশিরভাগ কৃষক তাদের শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ জমিতে পেয়াজচাষ করে থাকেন। কারন এই এলাকার জমি সাধারনত পেয়াজ চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
হুদাপাড়া গ্রামের পেঁয়াজ চাষী মহত আলী জানান, তারা ভারতীয় সুখসাগর জাতের পেয়াজের বীজ এনে প্রতিবছর ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশী কয়েকটি গ্রামের শত শত বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করে থাকেন। কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের বয়রা, হুদাপাড়া, জাহাজপোতা, হরিরামপুর, কুতুবপুর, চন্দ্রবাস, শিবনগর, মুন্সিপুর, আটকবর, কানাইডাঙ্গা, এ সকল গ্রামের পেঁয়াজ চাষীদের মাথায় হাত। প্রায় ৩০-৪০ বিঘা জমির পেঁয়াজ পুড়ে শেষ। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও জেলা কৃষি কর্মকর্তার অবশ্যই মাঠ পর্যায়ে এসে ব্যাবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সেই সাথে কোম্পানী শুধু ক্ষতিপূরণ দিয়ে যাতে দায়মুক্তি না পায় কৃষকের সাথে প্রতারণা করায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবী জানান তিনি। একই গ্রামের পেঁয়াজ চাষী কাউল হোসেন বলেন, আমি চার লাখ টাকা খরচ করে আমার জমিতে চাষ করেছিলাম এর সবটায় পচে গেছে বিষ দিয়ে। এটা এখন আর হবে না।
এ ব্যাপারে দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার জানান, আমরা শুনেছি এবং সরেজমিন ক্ষতিগ্রস্ত মাঠ পরিদর্শণ করেছি। ঘটনার সাথে জড়িত কীটনাশক কোম্পানীর কর্মকর্তাদের ডেকে কথা বলেছি, তারা আমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্থ কৃষককে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। আমি আশা করব তারা শীঘ্রই ক্ষতিপূরণ দিবে। না হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বছর চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদা উপজেলায় ৭ হাজার ৩'শ ৩৫ বিঘা জমিতে জমিতে সুখসাগর ও তাহেরপুরী জাতের পেঁয়াজের চাষ হয়েছে। এর থেকে ৩০ হাজার ৭'শ ৭০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হবে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
যাযাদি/ এমএস