সুবর্ণচরে বোরো চাষে গিলছে ভূগর্ভের পানি, জনজীবনে হাহাকার

প্রকাশ | ১৩ মার্চ ২০২৫, ১৫:১২

সুবর্ণচর (নোয়াখালী) প্রতিনিধি
ছবি: যায়যায়দিন

নোয়াখালীর দক্ষিনাঞ্চলীয় উপকূলীয় উপজেলা সুবর্ণচর জুড়ে সবুজের সমারোহ। একসময়ের শস্যের ভান্ডার নামে পরিচিত এ অঞ্চলের কৃষিতে শুস্ক মৌসুমে অবাবনীয় পরিবর্তন লক্ষনীয়। এখানে রবি মৌসুমে কৃষকরা শীতকালীন সবজি, বাদাম, মরিচ, ডাল, সরিষা, ছোলা বুট, রৌশন, পেঁয়াজ, মটর সুটি, খেসারি, ভূট্টা, তিল, মেথি, ধনিয়া, তরমুজ, কুমড়াসহ নানান জাতের রবিশস্য উৎপাদন করতেন কৃষক। 

গত একদশক থেকে এ জনপদে বদলে গেছে কৃষির চিত্র। একসময় রবি মৌসুমে পানি সেচ ছাড়াই কৃষক উৎপাদন করতো মুল্যবান রবিশস্য। আমনের মৌসুম শেষ হতেই রবি মৌসুমে এসব ফসল উৎপাদনে চলতো মহা কর্মযজ্ঞ। এ অঞ্চলে উৎপাদিত এসব রবিশস্য স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানী হতো সারা দেশে।

কালের বিবর্তনে কৃষিতে যুক্ত হলো উচ্চ পানি শোষন ক্ষমতা সম্পন্ন উফশী ধানের বীজ। যা উৎপাদনে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। উপকূলীয় এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক পানির আধার সৃষ্টি না করায় কৃষক সেচের ৮০ ভাগ পানি ভূগর্ভ হতে অপরিকল্পিত ভাবে উত্তোলন করে বরো (ইরি) ধানের পানির চাহিদা মেটাচ্ছে। এতে করে ভূ-গর্ভের সুপেয় পানির স্তর গাণিতিক হারে নেমে যাচ্ছে। ফলে শুস্ক মৌসুমে সুপেয় পানির চরম হাহাকার চলছে এ জনপদে। শুষ্ক মৌসুমে ধান চাষই এখন সুবর্ণচরের জন্য বড় ধরনের অভিশাপ!
সরেজমিনে উপজেলার আটটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, কৃষকরা মৌসুমী ফসল চাষ না করে ৭০ ভাগ ভূমিতেই বোরো (ইরি) ধানের চাষ করেছেন।

 যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই শুধু ধান আর ধান। মৌসুমি ফসলের চাষ তেমন চোখেই পড়ে না। যত্রতত্র ফসলী মাঠের পাশে, পুকুর পাড়ে নিজেদের ইচ্ছে মতো গভীর নলকূপ স্থাপন করে অপরিকল্পীত ভাবে তুলছে ভূগর্ভের সুপেয় পানি।  ধান চাষে ভূগর্ভের পানি অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে বাড়িঘরের (৭০০-১২০০ ফুট)  গভীর নলকূপে এখন আর পানি ওঠে না। এক কলসি সুপেয় পানির জন্য এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে ছুটছে মানুষ। এ যেনো এক কলসি পানির জন্য প্রাণপন যুদ্ধ। এতে গৃহস্থালির কাজেও দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। বিশুদ্ধ পানির অভাবে সুবর্ণচরের লাখ লাখ মানুষ দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

সুবর্ণচর উপজেলা কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্তর এর তথ্য মতে, সুবর্ণচরে ৩৮ হাজার ৫০০ হেক্টর আবাদি ভূমির মধ্যে ২০০০ সালে খালবিল ও পুকুরের পানি ব্যবহার করে মাত্র ২০০ হেক্টর ভূমিতে বোরো চাষ হতো। বাকি ভূমিতে কৃষক রবি ফসলের আবাদ করতো। ২০০০ সাল থেকে ক্রমাগত হারে সুবর্ণচরে চলতি মৌসুমে শুধু ১৮ হাজার হেক্টর ভূমিতে বোরো ধানের চাষ করেছে কৃষক এবং ২ হাজার ৭৫০ হেক্টর ভূমিতে খেসারিসহ অন্যান্য ফসলের আবাদ করা হয়েছে। এই বোরা ধান চাষে ৫০ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার ২৮০ কিউসেক পানি খরচ হচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ পানি ব্যবহার হয় উপরিভাগ থেকে। ৪ লাখ ১৪০ কিউসেক পানি খরচ হচ্ছে প্রতি হেক্টর ধান চাষে।

বিশেজ্ঞদের মতে, অতিমাত্রায় ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরশীলতায় ঝুঁকি বাড়াচ্ছে এ অঞ্চলে। বোরো (ইরি) ধান আবাদ কমিয়ে আনলে পানির সংকট ধীরে ধীরে কেটে যাবে। শুস্ক মৌসুমে ধান চাষাবাদে কৃষককে নিরুৎসাহিত করতে হবে। কৃষি কাজের জন্য প্রাকৃতিক পানির আধার সৃষ্টি করে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে তা মহাবিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। 

উচ্চ ফলনশীল ও উচ্চ পানি শোষন ক্ষমতা সম্পন্ন জাতের ধানের বীজ, সার, কীটনাশক এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বছরজুড়ে। এদিকে রবিশস্য ধ্বংস করে ধান চাষ বিস্তারের কারণে পুরো জনপদে পানিশূন্য হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমলেই নিচ্ছে না কৃষি বিভাগ। বিএডিসির ছাড়পত্র ছাড়াই সেচের জন্য যত্রতত্র বিদ্যুত সংযোগ দিচ্ছে বিদ্যুত বিভাগ। অন্যদিকে পরিকল্পনা বিহীন অনুমোদন ছাড়া স্থানীয় চাষিরা নিজের খেয়াল খুশি মতো বোরো চাষের জন্য ১৫শ থেকে ২ হাজার ফুট গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তোলার কারণে উপজেলাজুড়ে তীব্র সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সাধারণত নলকূপের গভীরতা হয় ৮০০-৯০০ ফুট; ব্যবহার করা হয় ১.৫ ইঞ্চি পাইপ। কিন্তু সুবর্ণচরের অনেক নলকূপে ৪.৫ ইঞ্চি পাইপ ব্যবহার করে ১৫শ থেকে ২ হাজার ফুট গভীর থেকে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। 

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্য বলছে, সুবর্ণচরের চাষাবাদের জন্য ২৪৫টি গভীর নলকূপের (সেচপাম্প) অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর  বাইরে চাষিরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরও তিন হাজারের বেশি সেচপাম্প স্থাপন করেছেন, তবে সেগুলো অনুমোদনহীন। একটি গভীর নলকূপ ভূগর্ভ থেকে প্রতি ঘণ্টায় ১ হাজার ৮০০ কিউসেক পানি তোলা হয়।

কোনো গবেষণা ও ভূগর্ভের পানির পারিমান সমীক্ষা না করে গভীর নলকূপ অনুমোদন দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ভূগর্ভে কী পরিমাণ পানির মজুদ রয়েছে কিংবা গভীর নলকূপ স্থাপনে পরিবেশ প্রকৃতি ও ভূগর্ভের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে সর্বোচ্চ পানি শোষণকারী উফশী জাতের বীজ কৃষকের হাতে সরবরাহ করেছে কৃষি বিভাগ। 

সুবর্ণচরের চরআমানউল্যাহ ইউনিয়নের বাসিন্দা বেলাল হোসেন বলেন, কখনও ভাবিনি সুপেয় পানির জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হবে আমাদেরকে। বাড়িতে গভীর নলকূপ থাকলেও পানি উঠছে না নলকূপে। অন্য গ্রাম থেকে অনেক কষ্টে সুপেয় পানি সংগ্রহ করছি।

চরমজিদ গ্রামের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মাত্র একটি গভীর নলকূপে পানি পাওয়া যায়। আর সেই নলকূপ ঘিরে শত শত মানুষের ভিড় এক কলসি পানির জন্য। সবার হাতেই কলস বা ড্রাম। চরমজিদের স্কুলশিক্ষক তাজ উদ্দিন বলেন, এই  নলকূপটি কয়েক গ্রামের মানুষের ভরসা। কয়েক কিলোমিটার দুর থেকে নারীরা এখান থেকে পানি নিতে আসেন।

চরক্লার্ক ইউনিয়নের ছেরাজল হক এর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের ভেতরে কলসি, ড্রাম, থালাবাটি, এমনকি পলিথিনে করেও পানি সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ যেনো চালের চেয়েও তাদের ঘরে এক ফোঁটা পানি অনেক মূল্যবান। 

সুবর্ণচরে পরিবেশ নিয়ে কাজ করে উপকূলীয় পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনের সুবর্ণচর শাখার আহ্বায়ক আবদুল বারী বাবলু বলেন, এখন ১৫ শত থেকে ২ হাজার ফুট নিচেও পানি মিলছে না। পানিতে লবণের পরিমাণ হঠাৎ বেড়েছে। গভীর বা অগভীর নলকূপ বসানো হয় দেড় থেকে তিন ইঞ্চি আকারের পাইপ দিয়ে। কিন্তু সেচকাজে ব্যবহারের নলকূপে পাইপ দেওয়া হয় ৪ থেকে ১০ ইঞ্চি। এতে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের মানুষের পানি সংকট সমাধানে অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে ভূগর্ভের পানির মজুতের পরিমাণ জরিপ করতে হবে। অন্যথায় পানির পরিস্থিতি আরও জটিল পড়তে পারে উপকূলীয় এই জনপদে। তিনি বলেন, সুবর্ণচরে বড় বড় খাল ও লেক সেচের আওতায় আনলে দুই লাখ হেক্টর জমি চাষ করা যাবে। ২০ কোটি কিউসেক পানি পাওয়া যাবে শুধু মেঘনা লেক কাজে লাগিয়ে। 

সুবর্ণচরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চন্দ্রকলির নির্বাহী পরিচালক শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, কৃষি বিভাগের ভুল নীতির কারণেই সুবর্ণচরে পানির জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। রবিশস্য অধ্যুষিত এলাকায় বোরো ধান চাষ না করার বিষয়ে কৃষি আইন আছে। অথচ স্থানীয় কৃষি বিভাগ এ আইন মানছে না।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ভূগর্ভের পানি রক্ষায় ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের লক্ষ্যে আমরা কৃষককে রবি মৌসুমে অন্যান্য লাভজনক ফসল চাষের পরামর্শ দিচ্ছি। বিএডিসির গভীর নলকূপ অনুমোদন বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা আছে। ফলে কত পরিমাণ জমিতে কেমন পানি লাগবে, সেই তথ্য নিরূপণ করা সম্ভব হয় না। চাষ অনুযায়ী গভীর নলকূপ বসানো হলে অবৈধ নলকূপ স্থাপন কমে আসত।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুরাইয়া আক্তার লাকী জানান, অবৈধ গভীর নলকূপের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।


যাযাদি/ এমএস