রক্তে মোর জাগে রুদ্রবীণা

নারীকে এখনো লড়াই করতে হয় মানুষ হিসেবে তাঁর নূ্যনতম অধিকারটুকুর জন্য। তাহলে এই পৃথিবী এই দুর্বার গতিতে চলমান সভ্যতা আদতে তার প্রকৃত শক্তিতে শক্তিমান হতে পারছে না। যদি পৃথিবীকে শক্তিমান করে তুলতে হয়, তাহলে ধরণীর বিপুল কর্মযজ্ঞে নারীর অংশগ্রহণকে করতে হবে বাধা-শঙ্কা আর ভয়মুক্ত। নারীশক্তির জয় হোক। কেননা, নারীই তো প্রাণের আধার।

প্রকাশ | ৩০ জুন ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ৩০ জুন ২০২১, ১২:০১

সঙ্গীতা ইমাম

এই লেখার শিরোনামটি কবিগুরুর যে কবিতার পঙ্‌ক্তি থেকে গ্রহণ করেছি, তার নাম সবলা, ১৯২৮ সালের আগস্ট মাসে কবিতাটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তীতে তাঁর মহুয়া কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয়। নারীমুক্তি বা নারীর স্বাধীনতার প্রশ্নে যতবার আমরা কথা বলেছি, লিখেছি এই কবিতার পঙ্‌ক্তিগুলো ফিরে ফিরে এসেছে। 'নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/ কেন নাহি দিবে অধিকার/ হে বিধাতা?'- কবিতার প্রথম চরণগুলোই আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। কিন্তু এই কবিতাটির ভাবনার সঙ্গে যদি নারীর মুক্তি বা স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি বিবেচনা করি, তবে খানিকটা খটকা তো লাগেই। 'নারীর স্বাধীনতা', 'নারীর মুক্তি' কিংবা এ জাতীয় প্রসঙ্গগুলোই কি এখন প্রশ্নবিদ্ধ নয়? 'স্বাধীনতা' বা 'মুক্তি' শব্দগুলো কি তবে নারীর জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য? কই, 'পুরুষের স্বাধীনতা' বা 'পুরুষের মুক্তি' নিয়ে কখনো তো লিখতে হয় না। এমনকি 'মানুষের স্বাধীনতা' নিয়েও কি খুব বেশি কথা বলতে হয়? হয় না। কারণ, আমাদের ভাবনার জগতে এই বিষয়গুলো তো প্রতিষ্ঠিত। একজন মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন, আলাদা করে তার স্বাধীনতার প্রসঙ্গে আলোচনা করতে হবে কেন? এই কথাগুলোই নারীর ক্ষেত্রে খাটাতে গেলে আমাদের খটমট লাগে। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার হলেও বিশ্বসভ্যতার মানসিকতায় সেটা যেন কেবল পুরুষের ক্ষেত্রেই সত্য। নারীর বেলা বন্ধনের হাজারটা যুক্তি আর যুক্তির লক্ষ-কোটি শিকল। সভ্যতার আজকের যে অগ্রগতি, তার মূলে নারীর যে অনস্বীকার্য অবদান, এসব কথা আজকে বইপত্রে লেখা থাকে বটে কিন্তু মানুষের মনোজগতে এখনও তার প্রভাব ঠিকঠাক পড়েনি। এখনও নারীকে খুব সহজেই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা যায়। যে কোনো যুদ্ধে এখনও নারী নির্মমতার প্রধানতম লক্ষ্য। এমনকি যুদ্ধ বা দাঙ্গাকালীন বাস্তবতায় নিপীড়িত মানুষদের প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করলে আমরা দেখি- নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে নিপীড়িত হবার ধরন যেমন আলাদা, তার যুদ্ধ বা দাঙ্গা পরবর্তী মানসিক ও শারীরিক ট্রমাও আলাদা। এসব নিয়ে এখন কাজ হচ্ছে। সাতচলিস্নশের দেশভাগের দরুন উদ্বাস্তু মানুষের ওপর যে নির্মমতার খড়গ নেমে এসেছিল, তার ভাষ্যগুলো এখন বই আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর চালানো নির্মম জেনোসাইডে নারীর প্রতি যে সহিংসতা, সেগুলোও এখন আলাদাভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এগুলো পড়লে বোঝা যায়, প্রতিটি বিপন্নতায় নারীর প্রতি নির্মমতার ভাষ্যগুলো আলাদা। এমনকি রাজনৈতিকভাবে নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলোকে অস্ত্র করে তোলার যে নজির ইতিহাসে রয়েছে, তা থেকেই বোঝা যায়, সমগ্র স্বাভাবিকতা আসলে নারীর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নয়। তাই স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার হলেও নারীর জন্য স্বাধীনতার প্রশ্নটি এখনও বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্নে মোড়ানো। কেবল বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই এখন এমন অবস্থা চলছে। নারীর অগ্রগতি যেমন হচ্ছে, আবার তাকে দমিয়ে রাখার নব নব কৌশলও আবিষ্কার করছে পুরুষতন্ত্র। আসলে এ সমাজ, বা আরেকটু মোটা দাগে বললে এই পৃথিবীর তথাকথিত সভ্যতা নারীকে স্বাধীনরূপে কখনো দেখতেই চায়নি। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ যেমন লিখেছিলেন, 'কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, ক্রমশ নারী হয়ে ওঠে'। এই কথার প্রসঙ্গ ধরেই যদি বলি, পুরুষ সৃষ্টি করেছে 'নারী' নাম ধারণাটি, রচনা করেছে তার সংজ্ঞা আর সামাজিক বৃত্তাবদ্ধ অবস্থান। এই যে পুরুষের সৃষ্টি করা ধারণা, তাতে কিন্তু নারীর নিজস্ব ধ্রম্নবপদটুকু নেই। তার ইচ্ছেটুকু নেই। এজন্যই নারী স্বাধীনতার প্রসঙ্গ এলে অনেকটা রাজনৈতিক ঢঙেই আমরা শুনি, 'আমরা নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি'। এই কথার যৌক্তিকতাকে অবশ্য অস্বীকার করা যায় না। কারণ, এখনও এই একবিংশ শতাব্দীতেও এমন অনেক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সমাজ, সম্প্রদায় ও দল পাওয়া যাবে, যারা নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয়। এমনকি নারীর নিজস্ব অস্তিত্বকে তারা স্বীকারও করে না। এ কারণেই সমাজ এবং সমাজপতিদের ধারণা- তারা নারীকে যতটুকু হাতে তুলে দেবেন ততটুকুতেই যেন নারীকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। বাড়তি চাওয়া-পাওয়া থাকলেই, কার্যত নিজস্ব অধিকারের ন্যায্য হিস্যাটুকু চাইলেই সমাজ ও সমাজপতিরা নারীকে নানা নঞর্থক বিশেষণে বিশেষায়িত করে। তাদের ধারণা অনুযায়ী, গড্ডলিকায় ভেসে, মাথা নিচু করে, অন্যায় অত্যাচার মেনে নিয়ে অন্যের পছন্দ মতো একটি জীবন কাটিয়ে দেয়াই সমাজের কাছে 'আদর্শ নারী জীবনের প্রতিচ্ছবি'। এই আদর্শ জীবনের নিয়মের বিরুদ্ধে যে-ই প্রতিবাদী হয়েছে সে-ই যুগে যুগে নির্যাতিত-নিষ্পেষিত হয়েছে, হয়েছে পরিবার-সমাজ এমনকি রাষ্ট্রচু্যত। এই আলোচনাটি যখন করছি, তখন এ প্রশ্নটিও মনে আসে- 'লক্ষ্ণী মেয়ের' ধারণাটা কী? সমাজের চোখে কারা 'লক্ষ্ণী মেয়ে' বা 'চিরন্তনী নারী'। জন্মলাভের পর থেকেই একজন নারী শিশুকে পুতুল আর রান্নাবাটি খেলার সরঞ্জাম হাতে তুলে দেয়া হয়। আজকাল শহরাঞ্চলে এই দৃশ্যের খানিকটা পরিবর্তন ঘটলেও, গ্রামাঞ্চলে অবস্থার তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। শিশুবেলা খেলার সামগ্রীর সঙ্গে পরিচিতির মধ্য দিয়েই তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়, তোমার জগৎ রসুইঘর আর সন্তান পালনেই সীমাবদ্ধ। তারপর চারপাশের পরিবেশ আর সামাজিক-ধর্মীয় বিধি-বিধান তো আছেই। এভাবেই একজন নারীশিশুর মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠে। পরিবারে একজন পুরুষশিশু থাকলে, তার প্রতি সদস্যদের আচরণের মধ্য দিয়ে গোটা পরিবার যেন নারীশিশুটির চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন- নারী আর পুরুষের বৈষম্য। মেয়েরা মৃদুস্বরে নম্রভাবে কথা বলবে। অন্যায় হলেও মুখে 'রা'টি করবে না। এমনভাবে কাজ করবে, যাতে কোনো শব্দ না হয়। জন্মের পর থেকে বাবা, ভাই ও অন্যান্য পুরুষ গুরুজনদের সাথে চোখ তুলে কথা বলা তো দূরের কথা, তাদের দ্বারা কোনো অন্যায় হলেও মুখ খুলবে না। শৈশব থেকেই একজন নারীর পোশাক, মেলামেশা, শিক্ষা, যাতায়াত এমনকি তার জীবনের ভবিষ্যৎ ভাবনাগুলোও নির্ধারিত হয় পরিবারের অন্যদের পছন্দ বা ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি- কত মেয়েকে দেখেছি বাবার ইচ্ছায় বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে, অথচ তার হয়তো চারুকলায় পড়ার ইচ্ছা ছিল। পরিবারের সকলে চিকিৎসা পেশায় আছেন বলে তাকেও চিকিৎসকই হতে হবে। এতে কেবল যে তার মানসিক অশান্তি হচ্ছে তা-ই নয়, অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি, সেই নারী শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবনে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভ করতে পারছেন না। কারণ, তার ইচ্ছে, আগ্রহ বা স্বপ্নটা ছিল জ্ঞানের অন্য একটি শাখাকে কেন্দ্র করে। এভাবেই বাবা-মা-চাচা-মামা-ভাই কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ন্যায্য-অন্যায্য সব নির্দেশ মেনে নিতে হবে বিনা বাক্যব্যয়ে। তাদের পছন্দে বা নির্দেশে তাদেরই নির্বাচিত পুরুষের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যেতে হবে অচেনা এক ঘরে। সেদিন থেকে সেই পুরুষটি হলেন নারীটির 'স্বামী' অর্থাৎ মালিক। এখন থেকে সেই স্বামী পুরুষটি এবং তার পরিবারের ছোট-বড় সকলের মন যুগিয়ে তাকে চলতে হবে। এটাই সমাজস্বীকৃত নিয়ম। নিজের ইচ্ছে মতো কথা বলা, খাবার খাওয়ারও সুযোগ থাকে না অনেক ক্ষেত্রে। এক কারাগার থেকে নারী এসে পড়েন আরেক কারাগারে। অথচ যে আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে আমরা অনবরত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে যাচ্ছি, সেই জনগোষ্ঠীর চোখে নারী সম্মানের আসনে আসীন। অনেক জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে নারীই পরিবারের প্রধান। তাঁদের জীবনধারা থেকে আমাদের যে শেখার আছে, এ কথা আমরা মানব কখন? আমাদের তো পাহাড়ের জমি দখল করতে হবে। ধর্মীয় উন্মাদনার জিগির তুলে আদিবাসীদের বাস্তুচু্যত করতে হবে। অনেকেই হয়তো ভাববেন, আমার কথাগুলো একপেশে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, একজন শিশু-কিশোর বা তরুণ বয়সের নারীর জন্য তার পরিবার কি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে বলতে হবে, একজন শিশু যেহেতু নিজের প্রতিপালনের দায় নিতে পারে না, তাই তার প্রতিপালনের বিষয়ে অবশ্যই পরিবার সিদ্ধান্ত নেবে এবং সেটাই সঠিক। কিন্তু শিশুটি যখন বড় হতে থাকবে, তখন তার ভেতরে নিজের একটি জগৎও তৈরি হতে থাকে। পরিবারের দায়িত্ব সেই জগতের বিকাশটি যেন কল্যাণকর হয়। সেই জগতের বিকাশে যেন কল্পনা থাকে, সৃষ্টিশীলতা থাকে, সে যেন নিজের জগৎটিকে বড় করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ইতিবাচক উপাদান পায়- এ বিষয়গুলো দেখাই পরিবারের দায়িত্ব। একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর থেকে একজন শিশুর সঙ্গে আলোচনা করেই তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। তার কোনো মতামত বা পদক্ষেপ যদি ভুল হয়, তবে তার সঙ্গে সেটি যুক্তি নিয়ে আলোচনা করা উচিত। পরিবারের সদস্যরা মনে করলেন আর একজন স্কুল পড়ুয়া নারীকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিলেন- এ তো কোনো কাজের কথা নয়। যদিও বাল্যবিয়ে নিরোধের আইন আছে আমাদের, কিন্তু কী পরিমাণ বাল্যবিয়ে হচ্ছে, তার পরিসংখ্যান আমরা মাঝে-মাঝেই পত্রিকায় দেখতে পাই। পরিবারের প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন। আমাদের পরিবারে নারীর স্বাধীনতা কতটুকু, সেটা কেবল পরিবারের নারী শিশুর অবস্থা দিয়ে বোঝা যাবে না। প্রতিটি পরিবারে মায়ের অবস্থান আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। একটা সময় বলা হতো, নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তার সার্বিক বিকাশের পূর্বশর্ত। গত দু দশক ধরে আমরা দেখছি, কেবল অর্থ উপার্জন করাটাকেই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বললে, তাকে খন্ডিত করা হয়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যেমন নারীর অর্থ উপার্জনের স্বাধীনতা, তেমনি নিজের উপার্জিত অর্থ খরচেরও স্বাধীনতা। অনেক পরিবারই আছে, যেখানে নারী উপার্জন করেন, হয়তো সে পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তিই তিনি, কিন্তু নিজের ইচ্ছে মতো তিনি তার সম্পদ খরচ করতে পারেন না। সেখানে হয় জীবনসঙ্গী না হয় পরিবারের অন্যদের মতামতের ওপরই তাকে চলতে হয়। এই চিত্র বাংলাদেশের ঘরে ঘরে রয়েছে। আর সেই পরিবারের কন্যাশিশু যখন এটা দেখতে দেখতেই বড় হয় যে, সংসারে মায়ের বক্তব্য আসলে সীমিত, তখন তারও ধারণা হয়- সংসারে এভাবেই চলতে হয়। তার সঙ্গে রয়েছে আমাদের সমাজের 'মানিয়ে চলার' প্রেসক্রিপশন। পরিবারে নারী নির্যাতনের শিকার হলেও সন্তান-সংসারের দিকে তাকিয়ে মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয় নারীকে। এই শিক্ষা নারী তার নিজের পরিবার থেকেই পায়। আর আমাদের সমাজ কাঠামোর যে চালচিত্র, তাতে একজন নারীর পক্ষে একা জীবনযাপন কেবল সংগ্রামই নয়, এ এক মহাসংগ্রাম। দুই এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন বাংলাদেশে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তোলপাড়। তার মধ্যে একটি ঘটনা বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অসংখ্য নারী নিপীড়নের ঘটনাগুলোই আমাদের মনে করিয়ে দেয়। নারীর প্রতি শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার যে নজির আমরা বিভিন্ন সময় দেখতে পাই, তার প্রতিকারের জন্য আমরা প্রতিবাদ করি, মানববন্ধন করি কিন্তু যদি নিজের কাছেই এই প্রশ্ন তুলি যে, কতগুলো অপরাধের বিচার হয়, তাহলেই আমাদের চোখ গিয়ে কপালে ঠেকে। নারীর প্রতি সহিংসতার যে উৎকট রূপ আমরা দেখে চলেছি, তাতে কে নিরাপদ? পোশাকশিল্পের শ্রমিক থেকে চলচ্চিত্রশিল্পী কে নিরাপদ? গণপরিবহণ থেকে ব্যক্তিগত ভ্রমণ কোথায় নারী নিরাপদ? এই প্রশ্নগুলোর যথাযথ উত্তর পেতে হলে আইনের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আমাদের বিকল্প নেই। আইনের প্রয়োগ ও তার সঠিক বাস্তবায়ন না ঘটলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকে। কারণ অপরাধীরা জানে, রাজনৈতিক প্রভাব, উর্দির প্রভাব বা ব্যবসায়ী পরিবারের ক্ষমতা এগুলো দিয়ে তারা অপরাধ করেও বেরিয়ে আসতে পারবে। আইনের সঠিক প্রয়োগ হয়নি বলেই আজও আমরা কল্পনা চাকমার অন্তর্ধানের কোনো বিচার পাইনি। আজও জানি না তনু হত্যাকান্ডের কোনো বিচার হবে কিনা। মুনিয়া হত্যাকান্ডের বিচারের সংবাদ পেতে আমাদের বেগ পোহাতে হয়। অথচ আইনের প্রয়োগে যে অপরাধের মাত্রা কমে আসে তার নজির এই বাংলাদেশেই আছে। এদেশে এক সময় অ্যাসিড সন্ত্রাস ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং যথাযথ নাগরিক উদ্যোগ এই সন্ত্রাসকে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে এসেছে। বর্তমানে নারী নিপীড়নের একটি প্রধানতম ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ব্যক্তিগত পর্যায়ে তো বটেই, এমনকি পাবলিক পোস্টে নারীকে যেভাবে হেয়-প্রতিপন্ন করা হয়, তার প্রমাণ পাঠকদের আর বলে দিতে হবে না। তার সঙ্গে যুক্ত আছে ইউটিউব আর ফেসবুকে প্রচারিত ওয়াজের নামে নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের অবাধ প্রচার। দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় সমাবেশের নামে এসব ওয়াজ মাহফিলে যেভাবে নারীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হয়, তা কোনো সভ্য রাষ্ট্রে ঘটতে পারে না। এইসব ওয়াজ মাহফিলের বক্তারা যে কোন পর্যায়ের ধর্মীয় জ্ঞান ধারণ করে, তা ইতোমধ্যে বেরিয়ে এসেছে। মিথ্যা, বানোয়াট আর উদ্ভট বক্তব্য দিয়ে তারা নারীর প্রতি যে অবমাননাকর বক্তব্য দিয়ে থাকে, তাকে প্রতিহত করতে প্রকৃত ধার্মিকদেরই এগিয়ে আসার কথা; কারণ এতে তো প্রকৃত ধার্মিকদের ধর্মকেও অপমান করা হচ্ছে। বলেছিলাম, দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা। দ্বিতীয় ঘটনাটি কেবল যে মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকেই অন্যায় তা নয়, এটি একই সঙ্গে সংবিধানেরও লঙ্ঘন এবং এই সংবিধান লঙ্ঘন করেছে স্বয়ং সংসদীয় কমিটি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনাবসানের পর তাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিকল্প ব্যক্তি চেয়েছে তারা। সংসদ সচিবালয়ের বিজ্ঞপ্তি মতে, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে তারা। সংসদীয় কমিটির এ হেন অসাংবিধানিক আচরণ নিকট অতীতে আর ঘটেছে বলে আমার মনে পড়ছে না। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করা রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধিদের এমন আহাম্মকি সুপারিশে সর্বস্তরের জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। রাষ্ট্র আইন করে রাষ্ট্রের নাগরিকের জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গভেদে মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে (মৌলিক অধিকার) ২৮ এর (১) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট লেখা আছে, 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না'। ২৮-এর (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, 'রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবেন'। আর সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতার বিষয়ে ২৯ এর (১) ও (২) অনুচ্ছেদ মতে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগের বিষয়ে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ বা বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না। এখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার যে নিয়োগ তা তো সংবিধানের ২৯-এর (১), (২) ও (৩) ধারা বলেই হয় আর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার জানানোটা তাদের চাকরির বিধান। তাহলে সংসদীয় কমিটি কীভাবে এমন অসংলগ্ন সুপারিশ করে? অবশ্য সংবিধান লঙ্ঘনের নজির কেবল এবারই ঘটল তা নয়। এই রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, তারা যে সংবিধান সম্পর্কে কতটুকু জানেন বা মানেন- পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং তাদের কার্যক্রম দেখে এই প্রশ্ন মনে জাগে। এই তো ক' মাস আগেই আমরা ক্ষোভে-বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলাম, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েও একজনকে শুধুমাত্র নারী হবার কারণে 'কাজী' পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যারা এসব সিদ্ধান্ত নেন, তারা কি ভোটাধিকারপ্রাপ্ত জনগণ অর্থাৎ নারী ও পুরুষ উভয়ের ভোটেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নন? নারীর ভোট ছাড়া কি তারা সংসদে গিয়েছেন? তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনার সময় তারা এমন বৈষম্যমূলক আচরণ করেন কীভাবে? নারীর অধিকারের প্রশ্নে সংসদীয় কমিটিরই যদি এই হাল হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের মনোজগতে কী বার্তা যাচ্ছে? রবি ঠাকুরের সবলা কবিতার প্রসঙ্গ দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম। আজ যখন পৃথিবী কোভিড আক্রান্ত। আজ যখন অতিমারির এই সময়ে পৃথিবী বিপর্যস্ত, তখন আমরা বুঝতে পারছি বিপুলা এই পৃথিবীকে আমরা এখনও সবলা করে গড়ে তুলতে পারিনি। কারণ এখনও কর্মে, জ্ঞানে, মেধায়, শিল্পে, সম্পত্তিতে আমরা নারীর সম্পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। \হনারীকে এখনও লড়াই করতে হয় মানুষ হিসেবে তাঁর নূ্যনতম অধিকারটুকুর জন্য। তাহলে এই পৃথিবী এই দুর্বার গতিতে চলমান সভ্যতা আদতে তার প্রকৃত শক্তিতে শক্তিমান হতে পারছে না। যদি পৃথিবীকে শক্তিমান করে তুলতে হয়, তাহলে ধরণীর বিপুল কর্মযজ্ঞে নারীর অংশগ্রহণকে করতে হবে বাধা-শঙ্কা আর ভয়মুক্ত। নারীশক্তির জয় হোক। কেননা, নারীই তো প্রাণের আধার।