আবদুল গাফফার চৌধুরী: কলাম ছিল যার গল্পের মতো আকর্ষণীয়

প্রকাশ | ২৬ মে ২০২২, ১২:৩৮

গোলাম মুরশিদ:

 


বৃষ্টির সময়ে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মাঠ-ঘাট পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। বিস্তীর্ণ হলেও, পানির গভীরতা কিন্তু হাঁটুর সমান। আজকাল আমাদের দেশে বিদ্যাও তেমনি। দিগন্ত-প্রসারী হলেও, তা নিতান্তই অগভীর। তাই বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামও অনেক শিক্ষিত লোক জানে না। কিন্তু আবদুল গাফফার চৌধুরীর নাম জানে না, এমন লোক শিক্ষিত সমাজে খুব বেশি নেই। তার কারণ সমাজের নানা ক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখেছিলেন। কতোটা নির্ভরযোগ্য ছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে আবদুল গাফফার চৌধুরী অত্যন্ত সুপরিচিত এবং জনপ্রিয় ছিলেন। এই জনপ্রিয়তার নানাবিধ কারণ। তিনি চমৎকার বাংলায় তাঁর কলামগুলো লিখতেন। পড়তে একটুও বেগ পেতে হতো না। দ্বিতীয়ত, তাঁর কলামগুলো ছিলো গল্পের মতো আকর্ষণীয়। বাস্তবকেও তিনি নানা রকমের উপাদান এবং বিশ্লেষণ মিশিয়ে গল্পের রূপ দিতে পারতেন, আবার গল্পকেও তিনি বাস্তব করে তুলতে পারতেন।

যখন আমি এমএ ক্লাসে পড়ি, তখন একদিন মুনীর স্যার (মুনীর চৌধুরী) পূর্ব বাংলার সাহিত্য নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে আমাদের বলেছিলেন যে, গাফফার চৌধুরীরশেষ রজনীর চাঁদএকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। আমি মুনীর স্যারের বিশেষ ভক্ত ছিলাম। কাজেই কথাটা বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু ঢাকা হলে থাকার সময়ে পকেটে টাকা পয়সার বিশেষ প্রাচুর্য ছিলো না। তবু মনের মধ্যে বইটি পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিলো। তাই বইটা কিনে ফেললাম। একটানা পড়েও ফেললাম। এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবার নিয়ে লেখা। হয়তো আত্মজৈবনিক। শুনেছি গাফফার ভাইও বরিশালের এক জমিদার পরিবারের সন্তান। (যদিও যখনকার কথা বলছি, তখন জমিদারী প্রথা লুপ্ত হয়েছিলো।)

উপন্যাসটি একটানা পড়তে পেরেছিলাম, কারণ উপন্যাসটি ঢাউস আকারের ছিলো না। তার থেকেও বড়ো কথা, উপন্যাসটি তার কাহিনী এবং ভাষার জন্যে পড়তে ভালো লেগেছিলো। সত্যি বলতে কী, এতোটাই ভালো লেগেছিলো যে, লেখকের আরও দুটি বই কিনে ফেললাম – ‘সম্রাটের ছবিআরসুন্দর হে সুন্দর।না, উপন্যাস নয়; ছোটো গল্পের বই। পড়ে ভালো লেগেছিলো। ভাষার জন্যে, আর গল্প বলার স্টাইলের জন্যে। কাহিনীর আকর্ষণ তো ছিলোই।


কয়েক বছর পরেআমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। গাফফার ভাই তখন পূর্বদেশ নামে এক দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক। অসাম্প্রদায়িক এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিলো এই পত্রিকার প্রধান দুই আদর্শ।

গাফফার ভাইবলছি বটে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে তখন পরিচয় ছিলো না। এমন কি, তাঁকে কোনো দিন দেখিওনি। তাঁকে প্রথম দেখি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে, কলকাতায়। আমি তখন আনন্দবাজার পত্রিকা আর দেশ পত্রিকায় লিখছিলাম। এই দুই পত্রিকার প্রধান সাংবাদিকদের প্রায় সবা্র সঙ্গেই পরিচয় ছিলো। তাঁদের মধ্যে অমিতাভ চৌধুরী ছিলেন আমার বড়ো ভাইয়ের মতো। কলকাতায় যাঁদের সহায়তায় মাস টিকেছিলাম, অমিতদা ছিলেন তাঁদের একজন। অমিতদার মাধ্যমেই গাফফার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো।

গাফফার ভাইয়ের সঙ্গে তারপর দেখা হয় ১৯৯৪ সালের জানুযারি মাসে। দেখা হয় বিবিসিতে। আমি বিবিসিতে চাকরি নিয়ে গিয়েছিলাম। গাফফার ভাই তখন সপ্তাহে কয়েক দিন করে বিবিসিতে আসতেন সাময়িক প্রসঙ্গের আসরপ্রবাহএবং সকালবেলারপ্রভাত ফেরিঅনুষ্ঠানে কাজ করতে। সকাল দশটা-এগারোটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ। মাঝখানে বিরতি থাকতো ঘণ্টা দুয়েক। গাফফার ভাইয়ের সঙ্গে আমার সত্যিকার পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা তখনই। তাঁর সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার দরুন বাংলা বিভাগের প্রধান জন রেনার উপপ্রধান সিরাজুর রহমান উভয়ই তাঁকে খাতির করে চলতেন। তাই একজন আউট-সাইড কন্ট্রিবিউটার হিসেবে গাফফার ভাই নিয়মিত কাজ পেতেন, যদিও তাঁর উচ্চারণ ছিলো বরিশালের উপভাষার মতো এবং তাঁর কণ্ঠস্বরও ঠিক রেডিওর উপযোগী ছিলো না। তাই গাফফার ভাই বিবিসিতে দীর্ঘদিন কাজ করলেও, ঠিক ব্রডকাস্টার হয়ে ওঠেননি।

সাংবাদিক এবং কথা-সাহিত্যিক হিসেবেই তিনি সুপরিচিত হননি। গাফফার ভাইয়ের আর এক পরিচয়, এবং এই পরিচয়ই দীর্ঘকাল টিকে থাকবে, সে পরিচয় হলো ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে বিখ্যাত গানআমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি!’ রচয়িতা রূপে। তিনি ভুলতে পারেননি, একুশে ফেব্রুয়ারিকে। বাংলাদেশের লোকেরাও ভুলতে পারবে না তাঁর অমর গানআমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।

এই গানের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমি বিবিসি থেকে একটি অনুষ্ঠান করেছিলাম ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। গাফফার ভাই তখন ষ্টুডিওতে আসেন। এই গানের প্রথম সুরকারআবদুল লতিফও ঢাকা থেকে যোগ দিয়েছিলেন টেলিফোনে। গাফফার ভাই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, কিভাবে রক্তাক্ত একুশের রাতের বেলায় তিনি তাঁর বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন এবং ব্যথিত উদাস হৃদয় নিয়ে কিভাবে গানটি রচনা করেছিলেন। যদ্দুর মনে পড়ে তিনি বলেছিলেন তিনি তখন ইন্টারমেডিয়েট পাশ করে সবে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে শুরু করেছিলেন। [আমার ভুলও হতে পারি।] কিছু দিন পরে তিনি গানটি দেখান তাঁর পরিচিত একই জেলার মানুষ গায়ক আবদুল লতিফকে। আবদুল লতিফ সুর দিয়েছিলেন লম্বা এই গানটিতে। মাঝখানে বৈচিত্র্য আনার জন্যে দ্রুত লয়ে এবং ভিন্ন একটি সুরে গানের একটি স্তবক ছিলো। এই সুরেই গানটি পরের বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে গাওয়া হয়। সম্ভবত তার পরের বছরও। আবদুল লতিফ টেলিফোনে গানটির প্রথমাংশ গেয়ে শোনান।

তারপর করাচি থেকে আলতাফ মাহমুদ দেশে ফিরে আসেন। তিনি গানটিতে ভিন্ন একটি সুর দেন এবং গাফফার ভাই আবদুল লতিফকে গানটা গেয়ে শোনান। এঁরা তিনজনই বরিশালের লোক এবং আগে থেকেই বন্ধু। লতিফ ভাই আলতাফ মাহমুদের সুরটাকেই মেনে নিলেন। সুরটি ছিলো ধীর লয়ের; চার্চের হীমের মতো। সবাই এই সুরের প্রশংসা করলো। অতঃপর পরের বছর থেকে আলতাফ মাহমুদের সুরেই গানটা গাইলো।

গানের বয়স বছর হলো সত্তর বছর। এই প্রজন্মের লোকেরা, বিশেষ করে তরুণরা, একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্যও ভালো করে জানে না। কিন্তু তারাও একুশে ফেব্রুয়ারি গানটা জানে। বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা যতোদিন টিকে থাকবে, ততোদিন টিকে থাকবে গান। অমর এই গান, অমর এই সুর। এই গানের সঙ্গে অমর হয়ে থাকবেন এই গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী। তাঁর প্রতি রইলো আন্তরিক শ্রদ্ধা।

 

যাযাদি/ এম