দিলারা হাশেমের উপন্যাস :দেশ কাল ও শিল্পরূপ

প্রকাশ | ২৭ মে ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ২৭ মে ২০২২, ১১:৪৮

আহমদ মতিউর রহমান

উপন্যাস জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য মাধ্যম। বিশদ ও বিস্তৃত মাধ্যম তো বটেই। আধুনিক এই মাধ্যমের আঙ্গিকের নির্দিষ্ট কোনো ছক নেই। নানা লেখক নানানভাবে জীবন কাহিনী উপন্যাসের মাধ্যমে বর্ণনা করে যাচ্ছেন। উপন্যাস হচ্ছে-অ ভরপঃরঃরড়ঁং ঢ়ৎড়ংব হধৎৎধঃরাব ড়ৎ :ধষব ঢ়ৎবংবহঃরহম ঢ়রপঃঁৎব ড়ভ ৎবধষ ষরভব ড়ভ :যব সবহ ধহফ ড়িসবহ ঢ়ড়ৎঃৎধুবফ. 'গদ্যে লিখিত এমন এক বিবরণ বা কাহিনী যার ভেতর দিয়ে মানব-মানবীর জীবনযাপনের বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হয়ে থাকে।' আরো নানাভাবে উপন্যাসের সংজ্ঞা দেয়া হয়ে থাকে, তবে মূল কথা এটাই। ছোট গল্প আর উপন্যাস মিলে কথাসাহিত্য। দুটোরই ধারা ভিন্ন। তবে একটা বিষয়ে মিল আছে। বলা হয়ে থাকে কথাসাহিত্য মাত্রই আত্মজৈবনিক। পুরোটা না হলেও আংশিক। পুরো বাস্তব তুলে ধরলে তো আর সাহিত্য হলো না। সাহিত্য হতে তাকে বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে কিছুটা কল্পনার প্রলেপ তো দিতেই হবে। আর কল্পনার প্রলেপটা আসে বাস্তব জীবন অভিজ্ঞতা থেকে। বোধ করি সে কারণের সাহিত্য নিয়ে যারা কাজ করেন তারা আত্মজৈবনিকতার কথাটি বলে থাকবেন। আমাদের কথাসাহিত্যের একজন শক্তিময়ী লেখিকা দিলারা হাশেম। এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারিণী ছিলেন তিনি। একাধারে ছিলেন ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও ব্রডকাস্টার। সাফল্য পায়ে পায়ে ধরা দিয়েছে তার জীবনে। আবার অপ্রাপ্তির বেদনাও কম ছিল না। দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন প্রবাসে। তবু তিনি এ দেশের সাহিত্য অঙ্গনে যে কাজ করে গেছেন এক কথায় বলা যায় তা তুলনারহিত। সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহর মতো তিনিও দীর্ঘ প্রবাস জীবনযাপন সত্ত্বেও দেশ কালের চিত্র নিষ্ঠার সঙ্গে এঁকে গেছেন উপন্যাসের পর উপন্যাসে। এ জন্যই তিনি স্মরণীয় থাকবেন বহু কাল। দিলারা হাশেম ১৯৩৬ সালের ২১ আগস্ট যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পা রাখেন। ১৯৫৬ সালে সেখান থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ও মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। দিলারা তার সাহিত্যের স্বীকৃতি হিসেবে মর্যাদাবান বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৬), শঙ্খচিল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), উত্তর শিকাগো 'কালচারাল অ্যান্ড লিটারারি ইঙ্ক' সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৭), অলক্ত পুরস্কার (২০০৪), মুক্তধারা জিএফবি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৯) ও অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। পাকিস্তান আমলে তিনি যখন লেখালেখি শুরু করেন এবং তা প্রকাশিত হতে শুরু করে তখনই তিনি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। পাঠক একটা ভালো গল্প বা উপন্যাস পেলে তা লুফে নিয়েছে। এরও কিছু আগে কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্যধারা ঢাকা কেন্দ্রিক হতে আরম্ভ করে। রশীদ করিম, সরদার জয়েন উদ্দীন, শওকত ওসমান, সৈয়দ ওযালীউলস্নাহ, রিজিয়া রহমান, আলাউদ্দীন আল আজাদ, আকবর হোসেন প্রমুখ যে ধারাটিকে এগিয়ে নিতে শুরু করেন তাদের সঙ্গে যোগ দেন দিলারা হাশেমসহ কয়েকজন। শক্তিশালী লেখনী নিয়ে তারা শুরু করেন বলে নারী না পুরুষ এ প্রশ্ন তখন খুব একটা সামনে আসেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শেষ করে দিলারা স্বামীর কর্মসূত্রে যখন করাচি অবস্থান করেন তখন তিনি যুক্ত হন করাচি বেতারের সঙ্গে, বাংলা সংবাদ পাঠিকা হিসেবে। এরই পাশাপাশি চলেছে সাহিত্য রচনা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই তিনি প্রথমে ইউরোপ ও পরে আমেরিকা প্রবাসী হন। তিনি বেশ কিছু সাহিত্য সম্ভার রেখে গেছেন যেগুলোর পঠন পাঠন এখনো প্রাসঙ্গিক। সস্প্রতি তিনি বিদেশেই মৃতুু্যবরণ করেছেন। তিনি যতখানি শক্তিময়ী লেখিকা ছিলেন সেই অর্থে তার মূল্যায়ন হয়নি। অবশ্য সময় যে চলে গেছে তাও নয়। তবে আমরা বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি। আমরা অনেক কিছু ভুলে যাই, অনেক বড় বড় লেখক-লেখিকা বিস্মৃতির আবছা অন্ধকারে হারিয়েই গেছেন মনে হয়। এখানে দিলারা হাশেমের প্রধান কয়েকটি গ্রন্থের ওপর আলোচনা নিবদ্ধ রাখ ২. দিলারা হাশেমের প্রথম উপন্যাস 'ঘর মন জানালা' ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসে নগর জীবনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। উপন্যাসের নায়িকা নাজমার জীবনের সংগ্রাম তার যন্ত্রণা ও বিচিত্র প্রেমানুভূতির কথা বলা হয়েছে। লেখিকা এ দেশের মধ্যবিত্ত সমাজের সংগ্রাম ও ব্যর্থতাবোধের যে কাহিনী বিধৃত করেছেন তা নাজমাকে কেন্দ্র করে রূপলাভ করেছে। অপরিসীম জীবনীশক্তি কর্মদক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের গুণে সে প্রবেশিকা পাসের পর চাকরি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। সে মালেককে ভালোবাসত। ছোট বোন আসমার সরলতার সুযোগ নিয়ে এক লম্পট প্রেমের নামে তার সর্বনাশ ঘটায়। অবৈধ মাতৃত্বের দুঃসহ যন্ত্রণাকাতর আসমাকে উদ্ধারের জন্য নাজমা নিজের চরম ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। সে নিজের প্রেমিক মালেককে অনুরোধ করে আসমাকে বিয়ে করার জন্য। ঘটনার আকস্মিকতায় অপ্রস্তুত মালেক আসমাকে বিয়ে করে বিদেশে চলে যায়। কাহিনীর শেষে মৃতু্যপথযাত্রী আসমার পাশে মালেক আসে। কিন্তু আসমার মৃতু্য ঘটে। মালেক জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। নাজমার প্রেম তার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকলেও তার কোনো মর্যাদা থাকেনি। যে আসমার জন্য নিজের প্রেমকে বিসর্জন দিল সে আসমার মৃতু্যর ফলে তার ত্যাগ অর্থহীন হয়ে পড়ে। তবে আসমার মৃতু্যর সময় নাজমা ও মালেকের একসঙ্গে উপস্থিতি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা যেতে পারে। এই উপন্যাসে রোমান্টিক কাহিনীর পাশাপাশি বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের যে বাস্তব চিত্র দিলারা উপস্থাপন করেছেন, সমাজতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক উভয় অর্থেই তা মূল্যবান। এ উপন্যাস দিলারাকে প্রভূত খ্যাতি এনে দেয়। তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন 'ঘর মন জানালা'র লেখক হিসেবে। ১৯৭৩ সালে এই উপন্যাস নিয়ে 'বলাকা মন' নামে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় এবং দর্শক নন্দিত হয়। দিলারা হাশেমের উপন্যাসে মধ্যবিত্ত নারী জীবনের টানাপড়েন, ঘাত-প্রতিঘাতের কথা উঠে এসেছে বারবার। তার প্রথম উপন্যাস 'ঘর মন জানালা'ও এর ব্যতিক্রম নয়। এটি সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক সাহসী উপন্যাস। নাজমার মধ্যে লেখিকা মধ্যবিত্তের টানাপড়েন, সম্মান-অসম্মান বোধ, সমাজের নিয়ম শৃঙ্খলার বেড়ি পরিয়ে দিয়েছেন। সে চাইলেই তার প্রণয়ী ভালোবাসার মানুষ মালেকের সঙ্গে এক রিকশায় করে বাজার করতে যেতে পারে না। সমাজের রক্তচক্ষু তার মধ্যে দ্বৈতসত্তার সৃষ্টি করে। একবার তার মনে হয় তার যে অবস্থা সেখানে এই সস্তা আবেগের কোনো দাম নেই। নাজমা চরিত্রের মধ্যে আমরা দ্বন্দ্বমথিত চরিত্রের সাক্ষাৎ পাই উপন্যাসের এই বর্ণনায়, '... দূর ছাই, কি সব বাজে সেন্টিমেন্টের জন্য একটি পুরো টাকাই বেরিয়ে গেল রিকশা ভাড়ায়। গরিবের ঘোড়া রোগ সাজে না। ও চড়বে একশ বার চড়বে এক রিকশায়।' ঔপন্যাসিক আরেকটি চরিত্রকে এ উপন্যাসে প্রায় সমান গুরুত্ব সহকারে চিত্রিত করেছেন আর তা হচ্ছে নাজমার বোন আসমা। বান্ধবী নাসরিনের ভাই আখতারের প্রলোভনে পড়ে শরীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে সে। সেই সময়ে এই কাহিনী উপন্যাসের মাধ্যমে তুলে ধরে সমাজের বাস্তব চিত্র উপস্থাপন সাহসী কাজ বলেই গণ্য। এখানে ঔপন্যাসিক ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন তত্ত্বের প্রয়োগ করেছেন বলে সমালোচকদের অভিমত। দিলারা আসমার মনের গতিবিধিকে উপন্যাসে স্থান দিয়েছেন এভাবে, 'আখতারকে খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে তোমাকে ভালোবেসেছি একথা কবে আমি বলেছি? কিন্তু আখতারের দিকে চেয়ে একথা সে বলতে পারল না। মায়া জাগানো এক দুর্বলতা এলো নিজের মধ্যে। আখতারকে ভালো লাগতে লাগল। মনে হলে বুঝিবা ভালোবাসেও।' ৩. 'আমলকীর মৌ' দিলারা হাশেমের আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। এর আগে তার আরো দুটো উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। একদা এবং অনন্ত-১৯৭৫, স্তব্ধতার কানে কানে-১৯৭৭। বলা হয়, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নারীবাদী উপন্যাস আমলকীর মৌ। উপন্যাসের নায়িকা বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করে সন্ধ্যার পর ঢাকা ক্লাব থেকে বের হয়ে রিকশায় ওঠে এবং সিগারেট ধরায়। আজ থেকে প্রায় পঁয়তালিস্নশ বছর আগে এ রকম বর্ণনা উপস্থাপন সাহসী উচ্চারণই বলতে হবে। এটি ঘর মন জানালা থেকেও সাহসী রচনা। এ উপন্যাসে সামাজিক-পারিবারিক জীবনকে উপজীব্য করে তুলেছেন দিলারা। যুদ্ধ শেষ হয়েছে বলে যারা নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছেন তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দিলারা দেখিয়ে দিলেন একটা যুদ্ধের মীমাংসা হতে এখনো বাকি- যুদ্ধটা নারী স্বাধীনতার যুদ্ধ কিংবা আরও পরিষ্কার করে বললে, মানবতার মুক্তির যুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হলো, নারী স্বাধীন হয়েছে কি? এমন সব প্রশ্ন নিয়েই যেন হাজির হলো 'আমলকীর মৌ'। সত্তর দশকের ঢাকার পটভূমিতে রূপবতী সারাকে নিয়ে লেখা হয়েছে এই উপন্যাস। সেই সময়ের উপন্যাসে এমন নারী চরিত্র খুব বেশি বোধহয় পাওয়া যাবে না। ঔপন্যাসিক সারা সম্পর্কে বলেছেন, 'সে একে মহিলা, বিদুষী, তায় রূপসী। এমন ত্রিরত্ন যোগ সহসা দেখা যায় না। তার সঙ্গে কথায় কেউ পেরে ওঠে না। তাবৎ আঁতেলেকচুয়ালদের ব্যতিব্যস্ত রাখার জন্য সে একাই যথেষ্ট।' ঢাকা শহরে সিগারেট ফোঁকা অল্প কয়েকজন মেয়ের মধ্যে সারা একজন। তবে সিগারেট খায় বলেই সে নষ্ট মেয়ে তা নয়। কোনো কোনো সমালোচক বলছেন, উপন্যাসটি রাজনৈতিকভাবে চরম অস্থিরতার মধ্যে রচিত হলেও এটি ঠিক রাজনৈতিক উপন্যাস নয়। দিলারা সচেতনভাবেই ওই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে এড়িয়ে সামাজিক পারিবারিক জীবনকে উপজীব্য করে তুলেছেন এই উপন্যাসে। ...... যুদ্ধের মীমাংসা হতে এখনো বাকি। যুদ্ধটা নারী-স্বাধীনতার যুদ্ধ, এটা তিনি বুঝাতে চেয়েছেন। একটা সদ্যস্বাধীন দেশের স্বাধীন কিছু চরিত্র উপস্থিত করে দিলারা দেখালেন যে পুরুষকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় যেমন নারীরা জিম্মি, জিম্মি তেমন পুরুষরাও। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সারা তার যোগ্যতাবলে যোগ্য মানুষের মতো আচরণ করেছে। প্রচলিত সমাজকে ভেঙে নতুন করে গড়তে চেয়েছে। সম্পূর্ণ না পারলেও সমাজের কিছু মানুষকে অন্তত সে বোঝাতে পেরেছে, এভাবেও নারীরা বেঁচে থাকতে পারে। উপন্যাসটির চরিত্র সৃজন, বিস্তার, ভাষা ব্যবহার সম্পূর্ণ আলাদা। এখানেই দিলারার কথা সাহিত্যের সাফল্য। আপাত দৃষ্টিতে এই উপন্যাসের মূল ইস্যু হলো জেন্ডার বিভাজন। নারী কেন্দ্রিক উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে আরও অনেক লেখা হয়েছে। এরকম সাহসী উপন্যাস কম। সত্তর দশকে এক মধ্যবিত্ত পরিবারের নারী স্বামী-সন্তান ছেড়ে আলাদা হয়ে স্বাধীনভাবে বাস করছে, রাত নেই দিন নেই রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে, ইচ্ছে হলে পান করছে মদ কিংবা সিগারেট। ব্যাচেলর বন্ধুর ফ্লাটে ঢুকে পড়ছে যখন তখন। এটা ভাবতেই অনেক মেয়ের গা শিউরে উঠবে। বিশেষ করে সময়ের কথা বিবেচনা করে তো বটেই। সারা অস্তিত্ব সচেতন নারী। সে প্রশ্ন করেছে সমস্ত বৈষম্য নিয়ে। সারা তার বাবা-মার মধ্যকার অস্বচ্ছ দাম্পত্য সম্পর্কের ভেতর থেকে তাবৎ নারী-পুরুষের ভেতর একটা অস্বচ্ছতা দেখতে পায়। সারা এই ঘোলাটে সম্পর্কটা ধরতে পারে বলে সে তার স্বামী-সন্তান ফেলে চলে আসতে পারে। তার এই সাহসটার পেছনে ইন্ধন জোগায় তার অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা। সারার বোন সালেহা নারী-পুরুষ সম্পর্কের এই ফাঁকটা ধরতে পারলেও চলে আসতে পারে না। জাগতিক মুক্তির বদলে তাকে চিরন্তর মুক্তির পথ বেছে নিতে হয়- সে আত্মহত্যা করে। কারণ সে সারার মতো অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নয়। সালেহা স্বামী ছেড়ে আশ্রয় চেয়েছিল বাবার কাছে। বাবা সম্মান ও সমাজের ভয়ে তাকে আশ্রয় দেননি। সালেহাকে ধরে রাখতে পারেনি সমাজ। আবার অর্থনৈতিক ভিত মজবুত হলেই একক প্রচেষ্টায় সমাজের সব বিশ্বাস বা আচারকে ভাঙ্গা যায় না। তাই তো সারা মৃত খালার খাটিয়া ধরতে চাইলে মামা বলেন, 'তুই বয়ে নিয়ে যাবি? তুই তো মেয়ে মানুষরে। মুর্দা কাঁধে নিতে গেলে পুরুষ হতে হয়। ওটা তোর কাজ নয়।' এখানে এসেই আটকে যায় সারা। দিলারা হাশেম কোনো নগ্ন প্রতিবাদে নামাননি তার চরিত্রকে, তিনি খালি প্রশ্নটা ছুড়ে দেন। নারীবাদী উপন্যাসগুলোতে পুরুষদের বহুগামিতা উলেস্নখযোগ্য অংশজুড়ে থাকে। থাকে নারীদের শরীরের রগরগে বর্ণনাও। পুরুষদের খুব খারাপভাবিয়ে তুলে ধরতে পারলেই নারীবাদী উপন্যাস হয়ে গেল এমনটা দিলারা হাশেম ভাবেননি। তার অন্যান্য বিখ্যাত উপন্যাস হলো- হামেলা, শঙ্খ করাত, অনুক্ত পদাবলি প্রভৃতি। এসব উপন্যাসেও সমাজবাস্তবতার চিত্র আছে। তার ছোটগল্প গ্রন্থ- 'হলদে পাখির কান্না' (১৯৭০), 'সিন্ধু পারের উপাখ্যান' (১৯৮৮), 'নায়ক' (১৯৮৯)। এ ছাড়া ১৯৭৭ সালে তার কবিতার বই 'ফেরারি' প্রকাশিত হয়। ৪. দিলারা হাশেমের উপন্যাস দেশ-কাল-সমাজ এবং ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রচিত। এগুলোতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আশা-আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনা, প্রাপ্তি ও অচরিতার্থতার বেদনাবোধ, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব প্রভৃতি স্থান পেয়েছে। তার উপন্যাসের মূল প্রবণতা মধ্যবিত্তের সংকট এবং নারীকে কেন্দ্র করে। সামাজিক ইতিহাসের দলিল স্বরূপ বলা হয় উপন্যাসকে। সেই অর্থে দিলারা স্বার্থক। দিলারা হাশেমের গদ্যভাষাও অত্যন্ত চমৎকার ও বিষয়োপযোগী। চরিত্র চিত্রনে তিনি খুবই আন্তরিক। ফলে উপন্যাস পড়তে পড়তে পাঠক-পাঠিকা এক একটি চরিত্রের মধ্যে যেন নিজেকে খুঁজে পান। আর একনিষ্ঠভাবে উপন্যাসের রসাস্বাদনও সম্ভব হয়। এটা অবশ্যই দিলারার মুন্সিয়ানারই পরিচয়বাহী। চরিত্র সৃজনের পাশাপাশি প্রতিটি চরিত্রের মুখে তার সামাজিক অবস্থান, বাস্তবতা অনুসারে সংলাপ বসিয়েছেন তিনি। ফলে তা কাহিনী বিস্তারে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। তবে কোনো উপন্যাসে তার মনে হয়েছে কাহিনীবস্তুকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাননি, মাঝ পথে ছেড়ে দিয়েছেন। অবস্থাটা এমন পাঠক বাকিটুকু ভেবে নিক। এটা লেখকের ইচ্ছাধীন। সমালোচক বলতেই পারেন। দিলারা হাশেমের উপন্যাসগুলোর পঠন ও পাঠন অব্যাহত থাকুক এবং তার সঠিক মূল্যায়ন হোক এটাই চাইব।