অলিখিত সুখ

প্রকাশ | ১০ জুন ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ১০ জুন ২০২২, ০৯:২৫

চঞ্চল শাহরিয়ার

১. বাউরী বাতাসে ফের ভাসবো বলে নড়েচড়ে বসি। বৈশাখ শেষের বৃষ্টি আমাকে গাঢ় প্রেমের ইশারা করে। এই প্রেমে মজে আমি শিলাইদহের রবীন্দ্র কুঠিবাড়ীতে ছুটে যাই। ছুটে যাই দক্ষিণডিহি আর পিঠাভোগ। রোদ, বৃষ্টি আর বাউরী বাতাসে রবীন্দ্র সংগীত আমার সঙ্গী। হাত ছুঁয়ে আছে সারাক্ষণ আফসানা আফসানা। রবীন্দ্র কুঠিবাড়ীতে, পদ্মাপাড়ে, কাছারি বাড়ির আঙিনায় স্কুল কিশোরীর মতো কথা বলে যায় আফসানা। লালন শাহের মাজারে গিয়ে ওর বিস্ময় থামে না। আমি শুধু মিটি মিটি হাসি। দক্ষিণডিহির দোতলায় উঠি। আমার হাতের মুঠোয় আফসানার হাত। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। আমি রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতন আর জোড়াসাঁকো নিয়ে কথা বলি। আমি ফুলতলা, পয়গ্রাম কসবা আর বৃষ্টির রিমঝিম সুর নিয়ে কথা বলি। আফসানা মুগ্ধ হয়ে শোনে। রূপসা নদী পার হয়ে পিঠাভোগ গেলে আফসানা রবীন্দ্র মেলায় হারিয়ে যায়। আমি ওকে হারাতে দিই। কিছুটা সময় ও একলা থাকুক। আমাকে নিয়ে ওর ভুল ধারণাগুলো পাল্টে যাক। আমি চায়ের কাপে মুখ রাখি। পুকুর পাড়ের যুবতী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলি। গান ভেসে আসে। সেদিন দুজনে...। আঠারোবাকী নদী দেখে আফসানা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। রূপসা ব্রিজে আমার হাত ধরে ঘুরতে ঘুরতে বলে- আমি জীবনেও তোমার সঙ্গে কথা বলব না। আমি দূরের আকাশ দেখতে দেখতে বলি- এ আর নতুন কী? চকলেট কালারের ড্রেস পরা আফসানা, অভিমানে ভেঙে পড়া আফসানা আমার নীল জিন্সের পকেটে প্রজাপতি রেখে দেয়। সে প্রজাপতি উড়ে উড়ে আফসানার চোখেমুখে বসে। সে প্রজাপতি উড়ে উড়ে অভিসারের মুগ্ধতা বাড়ায়। রবীন্দ্র প্রেমে মজে যাওয়া দিন, আফসানা প্রেমে ডুবে যাওয়া দিন ভুলিয়ে দেয় সব একাকিত্ব। রূপসার জলে রেখে দিই মুঠো মুঠো অলিখিত সুখ। ২. সবুজে মিশে যাওয়া আমি আকাশ রাঙাতে চাই। এ আকাশে মেঘ এসে খুনশুটি করে। এ আকাশে চৈতন্য ফোন দিয়ে ওর মায়ের সুস্থতার গল্প শোনায়। মোবারক বাংলামটর সিগন্যালে দাঁড়িয়ে মগবাজার মোড় কোনদিকে যেতে হবে সেই পথ খোঁজে। আমি গৌতম বুদ্ধের মূর্তি, রাণী ভিক্টোরিয়ার ছবি আর জাদুঘরের ম্যাডামের ঘুম নিয়ে আয়েশী প্রহর কাটানোর আগে ফোন রিসিভ করি। ফোনের অপর প্রান্তে তুলি। জলপাই আচার খাবার জন্য বায়না করে। আমি হেসে দিই। তুলি আমাকে জিজ্ঞেস করে- আফসানা এপিসোড কতদূর? আমি বলি- অনন্তকাল। এ কোন কথা? কেন নয়? কতদিন হলো ঢাকা ছেড়েছিস। আফসানা আর তোর ঘুরাঘুরিই শেষ হচ্ছে না। আমি কার খালু তাই শুধু ভাবছি। তোর তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু সমস্যা যে হচ্ছে। কি সমস্যা? এই যে তোর পেছনে লাগতে পারছি না। তোর পেছনে না লাগলে আমার ঘুম হয় কখনো? আচ্ছা হাসিব, তুই ফেসবুকে ছবি ছাড়ছিস না কেন? ফেসবুকে কোন ছবি ছাড়ব? তোর আর আফসানার। এক সঙ্গে ঘুরিস যখন কেমন দেখায় তোদের, কেমন আদুরে প্রহর কাটাস তোরা; ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করে। বাগেরহাটে ষাটগম্বুজ মসজিদে গিয়েছিলি? খানজাহান আলীর মাজার জিয়ারত করে দীঘিতে ডুবিয়েছিস পা দুজনেই? তুলির কথা শেষ হওয়ার আগে ফোন কেটে দিই। সাদা গেঞ্জি আর নীল জিন্সপরা এক বিদেশিনী আফসানার হাত ধরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমার কাছাকাছি এসে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে। তারপর বলে- আমি ক্রিস্টিনা। আমি তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে চাই। ৩. রাত ভোর হয়ে যায়। তবু তোমার তুমুল সান্নিধ্য আমাকে আনমনা করে। আমি বারো তলার কফির আড্ডায় খুঁজি তোমার মায়াবী মুখ। খুঁজি দিনভর, রাতভর কীভাবে আমাকে জড়িয়ে থেকেছ এই কয়টা দিন। তুমি পাশে নেই। খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সবই। বেসিনে মুখ ধোঁয়ার সময় চাচ্ছি তুমি পাশে থাকো, হোটেল ডিএস প্যালেসের রাতের খাবার অপেক্ষা করে তোমার খই ফোটা কথাবার্তা শোনবার জন্য। রাতের বিছানা জুড়ে স্বপ্ন থাকে আরো একবার যমুনায় ডুব দেওয়ার বাসনা। এমন তো নয় যে, এই প্রথম তোমার সান্নিধ্য পাচ্ছি। ঢাকা ইউনিভার্সিটি, নীলক্ষেত, শাহবাগ, মতিঝিল, তেজগাঁও, গুলশান ২ নম্বরে কত উথাল-পাথাল দিন আছে আমাদের। বরিশালে তোমার বাসার ছাদ থেকে দেখা পূর্ণিমার চাঁদ আজও আমাকে অনুপ্রাণিত করে। তুমি আফসানা। তুমি প্রথম প্রেমের মন হারানোর অনুভব। তুমি আফসানা। তুমি একটা জীবন থেকে ছড়িয়ে দিয়েছ বেঁচে থাকার রঙ বেরংয়ের সতেজ আবির। সবকিছু দেরিতে বোঝা এই আমি, সবকিছু হারানোর পর ছটফট করা এই আমি তোমার সামনে দাঁড়ালেই শুধু অবুঝ কিশোর। কী ভীষণ বিশ্বাসে, কী ভীষণ ভালোবাসায় আমাকে আগলে রেখেছ তুমি। লোকজন মানার সময় তোমার নেই। যত্রতত্র অনায়াসে আমাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে বলো- ভালো আছো যুবরাজ? আমি ঢাকা ছেড়ে বরিশাল ফিরে যাচ্ছি। আমাকে ছেড়ে ঢাকা শহরে একা একা থাকতে পারবে তো পাগলা? বুকের কাঁপন বাড়ায়, যে কথার রেশ আমি সে কথার কি উত্তর দেব? অবশ্য আমার সব কথার উত্তর তুমি আশাও কর না। তুমি আফসানা। তুমি এফডিসির গেটে গাড়ি থেকে আমাকে নামিয়ে দিয়ে একবারও পেছন ফিরে তাকাও না। তুমি আফসানা। এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করার সময় শুধু মাথা নিচু করে থাক। দিন যায়। ভালোবাসা শিখি তোমার উষ্ণতায়। রাত যায় মনীষা কৈরালা মতো তোমার মুখটা খুব করে মনে পড়ে। আফসানা, ঘুমিয়ে পড়ার আগে একবার আমার মাথায় হাতটা বুলিয়ে দেবে? ৪. রিসোর্টের জানালা দিয়ে কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্য দেখি। আর খুব করে আফসানার মুখটা মনে করি। আফসানা সময় দেয়নি। আফসানা সময় নেয়নি। কারণ আফসানা বুকের ভেতর আগলে রেখেছে আরো কিছু স্বপ্ন। সে স্বপ্ন আজ নয় অন্যদিন পূরণ করবে। বিধিবাম বলে আমি আর দুঃখে ফিরিনি। ফিরেছি তুমুল বোহেমিয়ান স্রোতে। যে স্রোত কথা বলে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে। যে স্রোত কথা বলে রাঙ্গামাটির আদিবাসী মেয়েটির মতো। যে স্র্রোত কথা বলে বান্দরবানের বৃষ্টির মতোন চৈতালী মারমা হয়ে। আমি একা একা এসব দেখি। এক যুবক এক যুবতীর সঙ্গে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে, সিনেমার এক উঠতি নায়িকা পরিচালকের সঙ্গে কাপ্তাই লেকের লোকেশন নিয়ে বিস্তর আলাপে মগ্ন। নীল জিন্সের প্যান্ট লেকের জলে ভিজে যাওয়ার ভয়ে আমাকে আচমকা ছুঁয়ে দিয়েছিল ভীনদেশি যুবতীর ঠোঁট। আমি এসব গোপন চিঠির খাম, এসব রঙিন ঘুড়ির খুনশুটি, পাহাড়, বন, সমদ্র, ঢেউ আর লেকের জলের মায়াময় চাহনীকে উদার মনেই যত্নে রেখে দিই। রেখে দিই নীল নয়নার কামিজের ভাঁজে। রেখে দিই রিসোর্ট ছাড়ার মুহূর্তে হাত বাড়িয়ে দেয়া অধ্যাপিকার আতিথেয়তায়। আর ততোক্ষণে ঢাকা থেকে ফোন দেন জুবায়ের ভাই। ভ্রমণ রিপোর্ট কতদূর এগোলাম জানতে চান। আর আমি জয়পাহাড়ে ফেরার আগে, জামাল খান মোড়ে ফেরার আগে, চেরাগী পাহাড় মোড়ে ফেরার আগে, অমল বড়ুয়ার মোবাইল নাম্বার খুঁজতে থাকি। কারণ আফসানার অভিযোগ নিয়ে কথা হবে শুধু অমল বড়ুয়ার সঙ্গে। অমল দা, আপনি কেমন আছেন? ৫. এফডিসিতে ঢোকার মুহূর্তে মনটা খারাপ হয়ে গেল। পুরনো ফ্লোর সব ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখানে নতুন ফ্লোর তৈরি হবে। তবু পুরনো ফ্লোর আমাকে স্মৃতিকাতর করে। কত স্মৃতি সেইসব ফ্লোর, সেইসব রাস্তা, ঝরনা স্পষ্ট, ক্যান্টিন আর শিরীষ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নায়ক-নায়িকার ইন্টারভিউ নেয়ার দিন। নতুন সংখ্যা বিনোদন পত্রিকা হাতে নিয়ে প্রিয় পরিচালকের সঙ্গে দেখা করি। এখন মোবাইল ফোন আর টিভির পর্দায় সব খবর পায় সিনেমা প্রেমীরা। তবু ছাপা পত্রিকার একটা আলাদা মূল্য আছে। স্মৃতিময় ঘ্রাণ আছে। আছে বারবার পৃষ্ঠা উলটে দেখা রিপোর্টের ধরন। আমি চৈতন্যর ফোন পেয়ে কাওরান বাজার ঢুকি। ঢাকার বাইরে থাকার কারণে বহুদিন কারো মুখ আমি সরাসরি দেখিনি। চৈতন্যের মুখটা দেখে ভালো লাগে। ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করি। চৈতন্য জানায় মাকে সামনে মাসে আবারও ঢাকা আনতে হবে। মা আসতে চান না। চৈতন্যের মাকে আমারও খুব দেখতে ইচ্ছা করে। একবার সময় করে চৈতন্যদের বাড়ি বেড়াতে যাব। চৈতন্যের মা আর ছোটবোনের আন্তরিকতা আমি ভুলতে পারি না। আমার প্যান্টের পকেটে হুড়ুম দাড়াম করে মোবাইল ফোন বাজে। ফোন হাতে নিয়ে দেখি তুলি ফোন দিয়েছে। আমি ফোন রিসিভ করতেই তুলি বলে- ফোন ধরতে এত দেরী করছিস কেন? আফসানাকে নিয়ে শুয়ে আছিস?