শত বর্ষে ইউলিসিস

প্রকাশ | ২৪ জুন ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ২৪ জুন ২০২২, ০৯:৪৭

সালাম সালেহ উদদীন

বিগত একশ' বছর ধরে জেমস জয়েস ও তার বিশ্বখ্যাত উপন্যাস 'ইউলিসিস'-এর নাম পাঠক মহলে সরবে ও বলিষ্ঠভাবে উচ্চারিত হয়ে আসেছে। এই উচ্চারণের ভেতর রয়েছে নানা রহস্যময়তা ও উপলব্ধিগত দুর্বোধ্যতা। প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস পড়ে কে কতটুকু বুঝেছেন, সে প্রশ্নও সামনে চলে এসেছে। এই উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি পরিচিত হন বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে। 'ইউলিসিস' উপন্যাস জয়েসকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পরিচিত করে এক শক্তিশালী লেখক হিসেবে। হোমারের মহাকাব্য 'ওডিসি'র সমান্তরালে উপন্যাসটি তিনি বিশাল কলেবরে রচনা করেন। মহাকাব্যিক আখ্যান থেকে বের হয়ে এসে 'ইউলিসিস'-এ জেমস জয়েস নিয়ে আসেন এক আলাদা মাত্রা। তার 'ইউলিসিস'-এর নায়ক কোনো মহান সম্রাট অথবা কোনো বীর নন, এক অতি সাধারণ, সাদামাটা মানুষ, নাম লিওপোল্ড বস্নম্নম। তার রয়েছে নানা দোষ। তিনি ভাগ্যবিড়ম্বিত। উপন্যাসের নায়ক চাকরি থেকে বরখাস্ত হন, তার স্ত্রী অন্যের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। তিন খন্ডে বিভক্ত ১৮টি অধ্যায়ে ধারণ করা ঘটনাপ্রবাহ ওডিসি'র সমান্তরাল মনে হলেও বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। যেমন, পেনিলোপ তার স্বামীর অনুপস্থিতিতেও তার প্রতি চূড়ান্তভাবে বিশ্বস্ত, কিন্তু মলি বস্নম্নম তার স্বামীর প্রতি অবিশ্বস্ত। প্রতিটি অধ্যায় স্বতন্ত্র শৈলীতে রচিত, আর তা চরিত্রসমূহের ভেতর-বাইর এবং ব্যক্তি হিসেবে তাদের বিকাশকে তুলে ধরেছে। পৌরাণিক আখ্যান পেরিয়ে আসা এক অসাধারণ মানবিক উপাখ্যান এই উপন্যাস। মানুষের ক্ষুদ্র জীবনে নানা সংগ্রাম প্রতিটি মানুষকেই ঘিরে আছে এবং মানুষের জীবনের নিয়ন্ত্রক মানুষ নিজেই। আবার তার মধ্যে নিয়ন্ত্রণহীনতাও কাজ করে তীব্রভাবে। ডাবলিনে বসবাসকারী তিনজন মানুষ- স্টিফেন ডিডালাস, লিওপোল্ড বস্নম্নম ও তার স্ত্রী মলি বস্নম্নমের একটি দিনের ঘটনাপ্রবাহকে ধারণ করা হয়েছে এই উপন্যাসে। সময়ের নিরিখে যা এক অসাধারণ জীবন আখ্যান। জীবন সংগ্রামশীল স্বপ্নময় স্মৃতিকাতর ভয়াবহ এক নরককুন্ড অথবা সুখের হাতছানি। জীবন জীবন নয় কিংবা জীবন ক্ষণিকের। জীবন সম্পর্কে যত কথাই বলা হোক না কেন, জীবনের সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। কোনো কবি, সাহিত্যিক, মনীষী পন্ডিত ও দার্শনিক এ পর্যন্ত জীবনের সঠিক সংজ্ঞা দিতে পারেননি। জীবনকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না বলেই জীবন এত তাৎপর্যপূর্ণ বৈচিত্র্যময়, নানা রঙ ও রেখার দ্বারা জীবনের প্রতিটি পরত ও বাঁক আঁকা। তাই খুব সহজে কেউ জীবনের মায়া ত্যাগ করতে চায় না। সবাই আত্মপ্রেমে মশগুল থাকে। খ্রিস্টের জন্মেরও বহু পূর্বে তাই গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন- 'নিজেকে চেন'। তাই কোনো মানুষ এক জীবনেও নিজেকে চিনতে পারে না। অথবা এভাবে বলা যায় যে, নিজেকে চেনা সহজ নয়। নিজেকে চিনতে পারলে মানুষ ও জগৎ চেনা যায়। জীবনকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভাগ করা যায়। এ সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন- যাদের জীবন সম্পর্কে কোনো গভীর উপলব্ধি নেই। তারা মনে করেন জীবন একভাবে কেটে গেলেই হলো। এই উপন্যাসের নায়কের জীবন উপলব্ধি অত্যন্ত বাস্তবধর্মী, সহনশীল এবং সম্পূর্ণ আলাদা। সমাজের বাস্তব ছবি দেখার জন্য তিনি সরেজমিন ঘুরেছেন পথে-প্রান্তরে। জীবনের গল্প, সমাজের গল্প, মানুষের গল্পই এখানে প্রধান। তার জীবন উপস্থাপন বিশ্বস্ত ও চিন্তা উদ্রেককারী। নায়কোচিত কোনো গুণ না থাকা সত্ত্বেও জয়েস-এর নায়ক হয়ে উঠেছে নায়কের নায়ক, মহানায়ক, বিশ্ব নায়ক। তিনি ভিন্নভাবে জীবনকে চেনে ছুঁয়ে দেখেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন কঠিন বাস্তবতার নিরিখে। ১৩ জানুয়ারি, ১৯৪১ সালে পরলোকে পাড়ি দেওয়া এই লেখক ২ ফেব্রম্নয়ারি ১৮৮২ সালে জন্ম নেন আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিন শহরে। জেমস অগাস্টিন অ্যালওসিয়াস জয়েস নামের আইরিশ লোকটিই বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম আলোচিত নাম। মানুষের বীরত্ব ও ক্ষুদ্রতা, মহত্ত্ব ও শঠতার পাশাপাশি রেখে দেখেছেন তিনি। বলেছেন, 'অনুপস্থিতই সবচেয়ে বড় উপস্থিতি', 'জীবনে ভুল বলে কিছু নেই, প্রতিটি ভুলই একেকটি অভিজ্ঞতা।' এই কথার মাধ্যমে মূলত তিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। আশাবাদ ছড়িয়ে দিয়েছেন ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে। এই উপন্যাসে জয়েস তিনটি চরিত্রের ভেতর-বাইরের ঘটনা ও ভাবনাকে তুলে ধরে ব্যক্তি জীবনকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে চেয়েছেন। সেই সঙ্গে ভাষার পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালিয়েছেন খুব। এই উপন্যাসের ভাষা গীতিময় ও গতিশীল। বিংশ শতকের শুরুতে আধুনিকতাবাদ নামে যে সাহিত্যধারার সৃষ্টি হয়, ইউলিসিস তার উজ্জ্বল উদাহরণ। জয়েসের অভিনব গদ্যশৈলী, গদ্য নিয়ে বিচিত্র সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা এই উপন্যাসকে বিশিষ্টতা দিয়েছে, যা পাঠককে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। ইউলিসিসের কাহিনী একটিমাত্র দিনকে ঘিরে। ১৯০৪ সালের ১৬ জুন। এই সাধারণ একটি দিনে এক সাধারণ নাগরিক লিওপোল্ড ডাবলিন শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ান নানা কাজে। স্বল্প সময়ের অভিজ্ঞতালব্ধ সংগ্রামী জীবন যেন এক মহাজীবনের ছায়া। এই উপন্যাস পৌরাণিক আখ্যানকে ছাপিয়ে ব্যক্তিমানুষের অধিকার ও আধুনিকতার প্রতিফলন ঘটেছে। এই উপন্যাসের মাধ্যমে জীবনের সম্ভাবনাকে জয়েস উজ্জ্বল করে তুলেছেন। আধুনিক জীবন সংগ্রামকে মহাকালের নিরিখে ফুটিয়ে তুলেছেন। ইতিবাচকতা ও নেতিবাচকতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে জীবন। এই উপন্যাস সবকিছু ছাপিয়ে জীবনকে হা বলতে শেখায়। মানুষের ভেতরের সত্তাকে জাগ্রত করে অত্যন্ত উজ্জ্বলভাবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের একটি উপন্যাস লিখিত হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ফলে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে জেমস জয়েস হয়ত বা থেকে যাবেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।