সৃষ্টিকর্মে অমর হুমায়ূন আহমেদ

প্রকাশ | ১৯ জুলাই ২০২৩, ১১:২১

জাহাঙ্গীর বিপ্লব

দেশে এখন এত টিভি চ্যানেল, প্রচুর নাটক। প্রতিটি চ্যানেলেই প্রতিদিন একাধিক ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, বর্তমানে কিংবা গত কয়েক বছরে এমনকি এক দশকে কোন ধারাবাহিক নাটকটি দর্শকের মনে দাগ কেটেছে? নাটকের নাম কি? আর কোন নাটকটি দেখার জন্য দর্শক অধীর আগ্রহ নিয়ে টিভি সেটের সামনে বসে থেকেছেন বা বর্তমানে অপেক্ষায় থাকেন? অনেক পাঠক অথবা দর্শই এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে কিছুটা থমকে যাবেন, ব্যর্থ হবেন। যারা বর্তমান সময়ের দুয়েকটি জনপ্রিয় বাংলাদেশি ধারাবাহিকের নাম বলতে পারছেন না, তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ কলকাতার ধারাবাহিকের নাম হয়তো ঠিকই বলতে পারবেন। দেশীয় সংস্কৃতির জন্য এমন তথ্য সত্যিই হতাশাজনক। অথচ এমন একটা সময় ছিল যখন বিটিভিতে নাটক শুরু হলে রাস্তাঘাট সব ফাঁকা হয়ে যেত। বাংলাদেশি নাটকের সেই স্বর্ণযুগের অন্যতম কারিগর ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। 

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন একাধারে অধ্যাপক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, গীতিকার ও সুরকার। যেখানেই তিনি হাত দিয়েছেন সেখানেই সাফল্যের আলোয় আলোকিত হয়েছেন। এতগুলো পরিচয়ের মাঝে কথাসাহিত্যিক সত্তাটাই তার সবচেয়ে বড় পরিচয়। জনপ্রিয়তার কথা বিবেচনা করলে ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের ধারাকাছেও কেউ ছিল না। তবে ঔপন্যাসিক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের এই জনপ্রিয়তার একটা বড় কারণ ছিল নাট্যকার হিসেবে তার আবির্ভূত হওয়া! উপন্যাসের মতো নাটকের জগতেও হুমায়ূন আহমেদ তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসে সেরা দশটি নাটকের তালিকা করা হলে সেখানে এক হুমায়ূন আহমেদেরই একাধিক নাটক জায়গা পাবে। 

আজ এই বহুমাত্রিক প্রতিভার ১১তম প্রয়াণ দিবস। ২০১২ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এই কিংবদন্তি। প্রতি বারের মতো এবারও নানা আয়োজনের মাধ্যমে দিনটি পালন করবে  তার পরিবার ও অসংখ্য ভক্তকুল।  টিভি চ্যানেলগুলোতেও থাকছে বিশেষ আয়োজন। 

নিজেকে সব সময় লেখালেখির জগতের মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতেই হুমায়ূন আহমেদ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। হুমায়ূন আহমেদের হঠাৎ প্রস্থান শুধুমাত্র বইমেলাকেই বিবর্ণ করেনি, টেলিভিশনে নাটক দেখার আগ্রহেও বিশাল এক ভাটা নিয়ে এসেছে। সৃষ্টির এই মহান কারিগরের প্রস্থান বাংলাদেশের শিল্পজগতে নিয়ে আসে বিশাল এক শূন্যতা। তবে অসময়ে চলে গেলেও হুমায়ূন আহমেদ যেসব অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম রেখে গেছেন, সেসবের মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল ধরে।

ছোটগল্পকার, নাট্যকার, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা বলে আলাদা পরিচয়ে খ্যাতি লাভ করলেও লেখক হিসেবেই নিজের পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় এই বাঙালি কথাসাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস শাখায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তার অবদানের জন্য ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। 

তবে টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র অঙ্গনে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র সমাদৃত হয়। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক ‘আগুনের পরশমণি’ (১৯৯৪)। ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ আটটি পুরস্কার লাভ করে। তার নির্মিত অন্যান্য সমাদৃত চলচ্চিত্রগুলো হলো ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ (১৯৯৯), ‘দুই দুয়ারী’ (২০০০), ‘শ্যামল ছায়া’ (২০০৪) ও ‘ঘেটু পুত্র কমলা’ (২০১২)। ‘শ্যামল ছায়া’ ও ‘ঘেটু পুত্র কমলা’ চলচ্চিত্র দুটি বাংলাদেশ থেকে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কারের জন্য নিবেদন করা হয়েছিল। এছাড়া ‘ঘেটু পুত্র কমলা’ চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

তিনি ১৯৮০ থেকে ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য টেলিভিশন ধারাবাহিক এবং টেলিফিল্ম রচনা শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে তার প্রথম টিভি কাহিনীচিত্র ‘প্রথম প্রহর’ বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এটি তাকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে। তার অন্যতম টেলিভিশন ধারাবাহিকÑ ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘অয়োময়’, ‘আজ রবিবার’, ‘নিমফুল’, ‘তারা তিনজন’, ‘আমরা তিনজন’, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম’, ‘সবুজ সাথী’, ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’, ‘খেলা’, ‘অচিন বৃক্ষ’, ‘খাদক’, ‘একি কাণ্ড’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘অন্যভুবন’ এবং ‘এই মেঘ এই রৌদ্র’। 

হুমায়ূন আহমেদ ১৯৮৭ সালে ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের পিজুলিয়া গ্রামে ২২ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত বাগানবাড়ি নুহাশ পল্লী গড়ে তোলেন। জীবনের শেষ সময়ে তিনি এই বাড়িতে থাকতে ভালোবাসতেন। মৃত্যুর পর তাকে নুহাশ পল্লীতে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুতে সারা বাংলাদেশে সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব আহাজারির সৃষ্টি হয়। বাংলা সাহিত্য এবং নাটক ও চলচ্চিত্র অঙ্গনেও অন্যরকম শূন্যতা বিরাজ করে। হুমায়ূন আহমেদ পাঠক, দর্শক ও ভক্তদের মাঝে অমর হয়ে থাকবেন তার সৃষ্টি কর্মের মধ্য দিয়ে।  

যাযাদি/ এস